কেনিয়ার পথে এলসা হোম। জয় অ্যাডামসনের স্মৃতি, জর্জ অ্যাডামসনের স্বপ্ন আর বন্য প্রকৃতির প্রতি মানবতার অঙ্গীকার। আমাদের ভ্রমণের পথে যখন গন্তব্য ছিল কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি, ঠিক তখনই সামনে এসে দাঁড়ালো এক বিশেষ স্থান জয় অ্যাডামসন মিউজিয়াম, যেটিকে স্থানীয় মানুষজন ভালোবেসে ডাকেন এলসা হোম। প্রথমে নামটা শুনেই মনে হয়েছিল, হয়তো এটি কোনো সাধারণ জাদুঘর বা ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণের জায়গা। কিন্তু যখন এর ভেতরে প্রবেশ করলাম; তখন বুঝতে পারলাম, এটি কেবল একটি বাড়ি বা মিউজিয়াম নয় বরং মানবসভ্যতা ও বন্যপ্রাণীর সম্পর্ক নিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে লেখা এক অনন্য অধ্যায়।
বাড়িটিতে বসবাস করতেন জার্মান বংশোদ্ভূত দম্পতি জয় অ্যাডামসন এবং তাঁর স্বামী জর্জ অ্যাডামসন। তাঁরা ছিলেন প্রকৃত অর্থে প্রকৃতির সন্তান। আফ্রিকার বন্যপ্রাণীদের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা, মমতা আর সহানুভূতির জন্য আজও তাঁদের নাম উচ্চারিত হয় শ্রদ্ধার সঙ্গে। জয় অ্যাডামসন ছিলেন একজন প্রখ্যাত লেখিকা ও প্রাকৃতিক জীবনচিত্রকর। তাঁর লেখা ‘বর্ন ফ্রি’ বইটি প্রকাশের পর সারা পৃথিবীতে আলোড়ন তুলেছিল। বইটির মূল কাহিনি ছিল এক সিংহী এলসাকে কেন্দ্র করে। মানুষের হাতে লালিত এই সিংহীকে আবার প্রাকৃতিক জঙ্গলে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় পৃথিবীতে অনেকেই মনে করতেন, মানুষ লালিত বন্যপ্রাণী আর কখনো প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে না। কিন্তু জয় ও জর্জ প্রমাণ করেছিলেন, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে জানলে প্রতিটি প্রাণীই আবার ফিরে যেতে পারে তার আপন আস্তানায়।

১৯৬০ সালে প্রকাশিত বর্ন ফ্রি বইটি কোটি কোটি কপি বিক্রি হয়। শুধু ইংরেজি নয়, এটি পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়। এমনকি বাংলায়ও এর অনুবাদ পাওয়া যায়। বইটির সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে এটি চলচ্চিত্রে রূপ নেয়, যা পরবর্তীকালে অস্কারজয়ী হয়। ছবিটি শুধু সিনেমা নয় বরং মানুষের মনে এক চিরস্থায়ী চেতনা গেঁথে দেয় যে, বন্যপ্রাণী আমাদের প্রতিপক্ষ নয় বরং তারা আমাদের সঙ্গী, আমাদের সহযাত্রী।
আমরা যখন গাইডের বর্ণনায় এলসার কাহিনি শুনছিলাম, মনে হচ্ছিল যেন সেই দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ছোট্ট এক সিংহশাবক, মানুষের ভালোবাসায় বড় হয়ে উঠছে। কিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে আবার জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। সহজ সিদ্ধান্ত নয় এটি। কারণ প্রাণীটির সঙ্গে জড়িত হয়ে যায় মানুষের আবেগ। তবুও জয় ও জর্জ জানতেন, প্রকৃতির সন্তানকে প্রকৃতির কাছেই ফিরিয়ে দিতে হবে। এলসার সেই প্রত্যাবর্তন ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। এটি প্রমাণ করেছিল, মানুষ যদি চায়, তবে প্রকৃতির সঙ্গে সেতুবন্ধন তৈরি করতে পারে। বন্দিত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে আবার জঙ্গলে ফেরানো সম্ভব। এ ঘটনাই পরবর্তীতে পৃথিবীজুড়ে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণা হয়ে ওঠে।

জয় অ্যাডামসন মিউজিয়াম বা এলসা হোমের ভেতরে ঢুকতেই এক অদ্ভুত আবহ আমাদের ঘিরে ধরলো। চারদিকে সাজানো রয়েছে জয় অ্যাডামসনের আঁকা অসংখ্য চিত্রকর্ম। প্রতিটি ছবিতেই বন্যপ্রাণীর জীবন্ত অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে। আফ্রিকার সিংহ, চিতা, জেব্রা, হাতি সবই যেন ক্যানভাসে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। বাড়ির ভেতরে সংরক্ষিত আছে তাঁদের ব্যবহৃত নানা জিনিস, বই, ডায়েরি, আলোকচিত্র। প্রতিটি জিনিস যেন বলছে তাঁদের জীবনের গল্প। একটি ঘরে রাখা ছিল পুরোনো টাইপরাইটার, যেটিতে জয় অ্যাডামসন লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত বইয়ের বহু অধ্যায়। গাইড যখন এসব গল্প শোনাচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিল আমরা শুধু কোনো প্রদর্শনী দেখছি না বরং ইতিহাসের এক বিশেষ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি।
আরও পড়ুন
পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী জলপ্রপাতের সঙ্গে দেখা
ভ্রমণের সময়ে এ বাড়িতে আমাদের কাটানো সময় সত্যিই ছিল অনন্য। চারপাশের শান্ত পরিবেশ, আফ্রিকার প্রাকৃতিক বাতাস, আর সেই বাড়ির প্রতিটি দেওয়ালে লুকিয়ে থাকা অতীতের গল্প সব মিলে মনে হচ্ছিল যেন আমরা এক স্বপ্নের মধ্যে এসে পড়েছি। আমাদের গাইড অত্যন্ত সুন্দরভাবে প্রতিটি বিষয় বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। তার বর্ণনায় প্রাণ ফিরে পেয়েছিল এলসার গল্প।
জয় অ্যাডামসনের অবদান কেবল একটি বই বা একটি সিংহীর গল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ছিলেন সেইসব মহীয়সী নারীদের একজন, যাঁরা সমাজের বাঁধাধরা গণ্ডি ভেঙে প্রকৃতি আর প্রাণীর জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়েছিলেন। তাঁর জীবন ছিল সাহস, ভালোবাসা ও মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

এ বাড়ির ইতিহাসে আরও একটি বিশেষ অধ্যায় হলো রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের আগমন। ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যরাও এ বাড়িতে এসেছিলেন। যা প্রমাণ করে, জয় ও জর্জ অ্যাডামসনের অবদান কেবল আফ্রিকার সীমায় আবদ্ধ ছিল না বরং তা ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা পৃথিবীতে।
এলসা হোম কেবল একটি মিউজিয়াম নয়, এটি মানবতা ও প্রকৃতির মেলবন্ধনের প্রতীক। এখানে এসে আমরা উপলব্ধি করেছি, মানুষ যদি চায় তবে সে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হতে পারে। পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে যেখানে মানুষ বন্যপ্রাণী হত্যা করে বা বনজঙ্গল ধ্বংস করে, সেখানে জয় ও জর্জ প্রমাণ করেছিলেন, সহাবস্থানই হলো টিকে থাকার মূলমন্ত্র।

আমরা যখন মিউজিয়াম থেকে বিদায় নিচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল যেন নিজের ভেতরে কিছু রেখে যাচ্ছি। আমাদের চোখে তখনো ভাসছিল এলসার মুখ, সেই বন্যসিংহী; যার জীবনের গল্প বদলে দিয়েছিল লক্ষ মানুষের হৃদয়। এখানে আসা কেবল একটি ভ্রমণ নয় বরং এক ধরনের আত্মশুদ্ধি। আমাদের মনে গভীরভাবে গেঁথে গেছে যে, প্রকৃতি ও প্রাণীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে পারলেই পৃথিবী সত্যিকার অর্থে সুন্দর হয়ে উঠবে।
নাইরোবির পথে আমাদের এ ভ্রমণ অভিজ্ঞতা শুধু আনন্দই দেয়নি, দিয়েছে এক অনন্য শিক্ষা। জয় অ্যাডামসন মিউজিয়াম বা এলসা হোম কেবল একটি বাড়ি নয়, এটি এক চেতনার নাম। জয় অ্যাডামসন ও জর্জ অ্যাডামসনের জীবন আমাদের শিখিয়ে দেয়, প্রকৃতিকে ভালোবাসা কতটা জরুরি।