সিঙ্গাপুর একসময় চীনের মূল ভূখণ্ডের ধনী পরিবারের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল। কিন্তু ইদানীং সেই সুনাম ম্লান হচ্ছে। হংকং ও জাপানের মতো সম্পদশালীদের কেন্দ্রগুলোর ক্ষতির বিনিময়ে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ সেখানে প্রবাহিত হয়েছিল, এখন তা উল্টো পথে যাচ্ছে।
২০১৯ সালের পর সিঙ্গাপুরের প্রতি ধনী চীনা পরিবারের আকর্ষণ বাড়তে শুরু করে। সেই সময় হংকংয়ে গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বেইজিং কঠোর দমননীতি গ্রহণ করে এবং ২০২০ সালে জাতীয় নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করে। এতে হংকংয়ে বসবাসরত চীনের মূল ভূখণ্ডের পরিবারগুলো বেইজিংয়ের প্রভাব থেকে দূরে সরে আসার পথ খুঁজতে থাকে।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, পরিবারভিত্তিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান গঠনে সহায়ক নীতি, স্বাধীন আদালত ও মান্দারিন ভাষার প্রচলন—এসব কারণে সিঙ্গাপুর ধনী চীনা নাগরিকদের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু ২০২৩ সালে ৩০০ কোটি সিঙ্গাপুরি ডলার (২৩০ কোটি মার্কিন ডলার) পাচার কেলেঙ্কারি বা ‘ফুজিয়ান কেসের’ পর দেশটির নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও ব্যাংকগুলো কঠোর পদক্ষেপ নেয়। নিয়মকানুন কঠোর করা হয়, ধনী গ্রাহকদের নতুন করে যাচাই-বাছাই শুরু হয়।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক আইনি প্রতিষ্ঠান বে-ফ্রন্ট লর পরিচালক রায়ান লিন বলেন, ফুজিয়ান কেলেঙ্কারির খবর ছড়িয়ে পড়ার পর অনেক ধনী চীনা নাগরিক সিঙ্গাপুর ছেড়ে চলে যান। প্রায় সবাই হংকং, মধ্যপ্রাচ্য বা জাপানে চলে গেছেন। এর পর থেকে এই ধারা আরও ত্বরান্বিত হয়েছে।
নিয়মের কড়াকড়ি
রায়ান লিন জানান, ২০২২ সালের তুলনায় এখন মূল ভূখণ্ড চীন থেকে আসা ব্যক্তিদের ফ্যামিলি অফিস বা স্থায়ী আবাসন স্থাপনের আবেদন প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে। এতে নতুন কমপ্লায়েন্স চেক ও নিয়মকানুন কড়াকড়ি হওয়ার প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে ক্রিপ্টো খাতের বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি কমেছে।
২০২৫ সালে সিঙ্গাপুরের নতুন বিধান চালু করা হয়। ক্রিপ্টোকারেন্সি, স্টেবলকয়েন বা টোকেনাইজড ইকুইটি (কোনো কোম্পানির মালিকানা বা শেয়ারকে ডিজিটাল টোকেন আকারে ব্লক চেইনে রূপান্তর করা) জাতীয় পণ্য বিদেশি গ্রাহকদের কাছে সরবরাহ করতে হলে এই বিধানের আওতায় প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স নিতে হয়। সিঙ্গাপুরের কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, এই অনুমোদনের পরিমাণ খুবই সীমিত হবে এবং খরচও বেশি, কমপক্ষে আড়াই লাখ সিঙ্গাপুরি ডলার মূলধন রাখতে হবে, সঙ্গে অর্থ পাচারসংক্রান্ত কঠোর আইন ও প্রযুক্তিগত ঝুঁকিবিষয়ক নীতি মানতে হবে।
রায়ান লিন বলেন, ক্রিপ্টো খাতে যাঁরা ছিলেন, নতুন আইনের কারণে তাঁরা সবাই চলে গেছেন। সিঙ্গাপুরে লাইসেন্স পাওয়া আগেও খুব কঠিন ছিল, তার ওপর নতুন বিধান বিদেশি গ্রাহকসেবার ওপরও চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে সবাই চলে গেছেন।
লিনের ভাষায়, এই চলে যাওয়ার মূল কারণ কঠোর আইন। নিয়ম যত কড়া হচ্ছে, চীনারা বলছেন, ‘আর কুলাচ্ছে না, ধৈর্য শেষ।’
সিঙ্গাপুরের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবশ্য জানিয়েছে, অর্থ পাচারের ঘটনায় তাদের নিয়ন্ত্রণ নীতির মানদণ্ড পাল্টায়নি। এমএএসের এক মুখপাত্র বলেন, ‘সিঙ্গাপুর বৈধ সম্পদকে স্বাগত জানায়। কার্যকর ও দক্ষ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা বজায় রাখতে আমরা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করছি।’
করপোরেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান জেঙ্গার প্রতিষ্ঠাতা আইরিস শু জানান, অর্থ পাচার কেলেঙ্কারি এবং থ্রি অ্যারোজ ক্যাপিটাল ও এফটিএক্সের মতো ক্রিপ্টো বিপর্যয়ের পর ২০২৪ সালে সিঙ্গাপুরে ব্যাপক কড়াকড়ি চালু হয়। ব্যাংকগুলো নতুন করে গ্রাহক যাচাই, ফ্যামিলি অফিস পুনর্মূল্যায়ন ও এমনকি কিছু হিসাব বন্ধ করে দেয়। ফলে অনেক ধনী চীনা গ্রাহক বিপাকে পড়েন।
অন্যদিকে স্থায়ী বসবাস ও ফ্যামিলি অফিসের আবেদনকারীদের জন্য ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পটভূমি প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ বিষয় অনেকেই অনধিকারচর্চা বলে মনে করছেন। লিন বলেন, ‘তাদের প্রশ্ন, সিঙ্গাপুরে বিনিয়োগ করতে গিয়ে কেন আমাকে অবৈধ সম্পদ সম্পর্কেও জানাতে হবে?’
আকর্ষণ হারাচ্ছে সিঙ্গাপুর
সিঙ্গাপুরের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে সিঙ্গাপুরে ধনীদের অভিবাসনের হার অর্ধেকে নেমে আসবে। ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর মাত্র ১ হাজার ৬০০ জন মিলিয়নিয়ার (কমপক্ষে ১০ লাখ ডলারের মালিক) সিঙ্গাপুরে যাবেন। ২০২৪ সালে এই সংখ্যা ৩ হাজার ৫০০ জন হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল।
অন্যদিকে হংকং এখন ধনী বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতে করছাড়সহ নানা প্রণোদনা দিচ্ছে। সম্প্রতি পুঁজি বিনিয়োগকারীদের জন্য স্থায়ী বসবাসের শর্তও শিথিল করা হয়েছে।
আইনি প্রতিষ্ঠান বে-ফ্রন্ট লর পরিচালক রায়ান লিন আরও বলেন, ‘আমার মনে হয়, অনেক ধনী চীনা নাগরিক তাড়াতাড়ি ভুলে যান। তাঁরা ভুলে গেছেন, কেন তাঁরা সিঙ্গাপুরে এসেছিলেন।’
যাপিত জীবনের ক্ষেত্রে যে পার্থক্য হচ্ছে, তারও ভূমিকা আছে। তরুণ ধনীরা হংকং বা দুবাইয়ের নির্ঘুম রাত কাটানোর জীবনধারাকে সিঙ্গাপুরের তুলনায় বেশি উপভোগ্য মনে করছেন।
হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের গ্রুপ প্রধান ডমিনিক ভোলেক বলেন, কঠোর নিয়মকানুন, বাড়তি তদারকি আর সামাজিক পরিবর্তনগুলো হয়তো তাঁদের গোপনীয়তা ও নমনীয়তার খোঁজে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছে।
করপোরেট সেবাদাতা জেঙ্গার শু মন্তব্য করেন, সিঙ্গাপুর গত কয়েক বছর ছিল একেবারে রমরমা জায়গা; এখন একটু তা ম্লান হচ্ছে, যে ময়লা জমেছিল, তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে, এটাই স্বাভাবিক।