ভারতে বিরল খনিজ রপ্তানি করবে চীন, নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে
ভারত ও চীনের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পথে বড় অগ্রগতি হয়েছে। সেটি হলো, প্রতিরক্ষা ও সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিরল খনিজ ভারতের কাছে রপ্তানি করবে চীন।
এত দিন ভারতে বিরল খনিজ রপ্তানিতে চীন যে বিধিনিষেধ দিয়ে রেখেছিল, তা তুলে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সার উৎপাদন ও অবকাঠামো ক্ষেত্রে ভারতকে প্রয়োজনীয় সাহায্যের বার্তা দিয়েছে চিন। সোমবার সন্ধ্যায় চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর যে বৈঠক করেছেন, সেখানেই আলোচনা হয়েছে নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে।
ইকোনমিক টাইমসের সংবাদে বলা হয়েছে, চীনের পক্ষ থেকে ভারতের মূল তিনটি উদ্বেগের বিষয় নিয়ে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। সেটি হলো, সারের জোগান অক্ষুণ্ণ রাখা, বিরল চৌম্বক খনিজ ও টানেল-বোরিং মেশিনের জোগান বজায় রাখা। ভারতের কৃষি, হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য এই তিনটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের বিশেষ উদ্বেগের কারণ হলো, চীনের আকস্মিক সার রপ্তানি-নিষেধাজ্ঞা রবি মৌসুমে ডি-অ্যামোনিয়াম ফসফেটের সরবরাহে বড় প্রভাব ফেলেছিল। একইভাবে টানেল বোরিং মেশিনের চালান আটকে যাওয়ায় বেশ কয়েকটি অবকাঠামো প্রকল্প স্থবির হয়ে পড়ে, যার মধ্যে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের চীনভিত্তিক কারখানায় তৈরি যন্ত্রও ছিল।
এ ছাড়া অটো ও ইলেকট্রনিক শিল্প খাত চীনের বিরল চৌম্বক খনিজ রপ্তানি বন্ধ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। সরবরাহ ঘাটতির কারণে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। মূলত সীমান্ত উত্তেজনার কারণে নিরাপত্তা-সংক্রান্ত যুক্তি দেখিয়েই বেইজিং এসব নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল।
এদিকে সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর রাজনৈতিক মতপার্থক্য নিরসন ও আস্থা তৈরির উদ্যোগ নেয় চীন ও ভারত। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং গত মাসে দুটি বৈঠকও করেছেন। সেই প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় এখন অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা শিথিল করার সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে দুই দেশ।
যুক্তরাষ্ট্র যখন ভারতের বিষয়ে ভারতের কঠোর অবস্থান নিয়েছে, তখন এই সমঝোতা গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে। রাশিয়ার সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক নিয়ে ওয়াশিংটন একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছে। রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনার কারণে ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে। ফলে ভারতের পণ্যে মোট শুল্ক দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশ।
একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র চীনের প্রতি তুলনামূলকভাবে শিথিল নীতি নিয়েছে। ওয়াশিংটন বেইজিংয়ের সঙ্গে বাণিজ্যবিরতি নবায়ন করেছে, শুল্ক আরোপ ৯০ দিন পিছিয়েছে; সেই সঙ্গে চীনের কাছে উচ্চপ্রযুক্তির চিপ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার দিকেও অগ্রসর হয়েছে।
রেয়ার আর্থ বা বিরল মৃত্তিকা খনিজ হলো ১৭ ধরনের উপাদান। আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষাশিল্পের জন্য এসব উপাদান অপরিহার্য। মুঠোফোন, কম্পিউটার চিপ, বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি, উইন্ড টারবাইন, স্যাটেলাইট এমনকি ক্ষেপণাস্ত্র ও রাডার তৈরিতেও এগুলোর ব্যবহার অপরিসীম। এগুলো ছাড়া আধুনিক ইলেকট্রনিক ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিপ্রযুক্তি প্রায় অচল।
চীন এই বাজারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। বিশ্বব্যাপী বিরল খনিজ উৎপাদন ও রপ্তানির ৬০–৭০ শতাংশই তাদের নিয়ন্ত্রণে। শুধু উৎপাদন নয়, খনিজ প্রক্রিয়াকরণ ও সরবরাহ শৃঙ্খলেও চীনের একাধিপত্য রয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান কিংবা ভারত—সব শিল্পোন্নত দেশই কোনো না কোনোভাবে বেইজিংয়ের ওপর নির্ভরশীল।
এই খনিজকে ‘২১ শতকের তেল’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। বৈশ্বিক অর্থনীতি ও নিরাপত্তাব্যবস্থায় এসব উপাদানের ভূমিকা এতটাই কৌশলগত। অনেক ক্ষেত্রে চীন রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবেও এসব উপাদানের রপ্তানি সীমিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের অংশ হিসেবে তারা এই উপাদানের রপ্তানি সীমিত করেছে। এর আগে ২০১০ সালে জাপানের সঙ্গে বিরোধের সময় তারা এই উপাদানের রপ্তানি সীমিত করেছে।
ফলে ভারত-চীন সম্পর্কেও বিষয়টি সংবেদনশীল। ভারতের অটো ও ইলেকট্রনিক শিল্পের জন্য এই খনিজ গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিরল খনিজ রপ্তানি শিথিল করার চীনের সিদ্ধান্ত শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক আস্থার বার্তাও বহন করছে বরে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।