বসতবাড়ির ১৭ শতাংশ জমি দখলে, তিন সন্তান নিয়ে জোছনা অধিকারীর অসহায় দিনযাপন
প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

স্বামী, শাশুড়ি ও তিন সন্তান নিয়ে সুখের সংসার ছিল জোছনা অধিকারীর (৩৫)। আধা পাকা বাড়ি, উঠানের সামনে বড় পুকুর, সবজির খেত—সবকিছুই ছিল তাঁর। স্বপ্ন ছিল তিন সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করবেন। কিন্তু সব স্বপ্নই এখন ফিকে। স্বামী অশোক অধিকারী দ্বিতীয় বিয়ে করে নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে গোপনে বসতভিটা ও ফসলি জমির বেশির ভাগ অংশ বিক্রি করে দিয়ে গেছেন। তবে বসতবাড়ির ১৭ শতাংশ জমি এখনো অবিক্রীত। অথচ গত ৫ আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির সুযোগে সেই গোপন ক্রেতা লোকজন দিয়ে প্রকাশ্যে দখলে নিয়েছেন সবকিছুই। তখন থেকে ছোট তিন সন্তান আর বৃদ্ধা শাশুড়িকে নিয়ে অন্যের ঘরের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছেন জোছনা।
খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের শেখ-সরদারপাড়া গ্রামে এই পরিবারের বসবাস। গত ৬ আগস্ট বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হয় তাঁদের। এরপর কিছুদিন এখানে-সেখানে ঘুরেছেন। পরে গ্রামের একটি মুসলিম পরিবার তাঁদের আশ্রয় দিয়েছে।
গত শুক্রবার বিকেলে আশ্রয়দাতার ঘরের বারান্দায় বসে ছোট মেয়ে দিশাকে (৩) কোলে নিয়ে তার কান্না থামানোর চেষ্টা করছিলেন জোছনা। পাশে বসে মেজ মেয়ে অঙ্কিতা (৫) মায়ের কাছে কী যেন বায়না করছিল।
ঘরের সামনে অচেনা মানুষ দেখে এগিয়ে আসেন জোছনা। এ প্রতিনিধিকে বলেন, ‘স্বামীর ভুল সিদ্ধান্তে আমাগের কপাল পুড়েছে। আমার এই ছোট দুই মেয়ে ছাড়াও প্রান্ত (১৪) নামের আরেকটি ছেলে আছে। ভিটাবাড়িতে আশ্রয় নিতি পারলি অন্তত গতর খাটিয়ে তিন সন্তানকে মানুষ করতি পারতাম। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য! এখন অন্যের বারান্দায় আশ্রয় নিতি হইছে। সন্তানগুলোর ভবিষ্যৎও অন্ধকার। এইভাবে বাঁইচে থাকা যে কত কষ্টের, তা আমার মতোন আর কেউ বুঝবে না।’
বলতে বলতে গলা ধরে আসে জোছনার। পুত্রবধূর পাশে এসে বসেন বৃদ্ধা মায়া অধিকারী। মায়ের কোলে বসে শিশুটিও অপলক তাকিয়ে আছে। আঁচলে চোখের পানি মুছে অভিযোগ করে জোছনা বলেন, ‘স্বামীর নামের জমি বিক্রি করলেও আমার শাশুড়ির অংশ তো রয়ে গেছে। তা ছাড়া সব জমি তো সে বিক্রিও করিনি। সে হিসেবে বসতভিটাতে থাকার অধিকার ছিল আমার। কিন্তু গায়ের জোরে আমাদের ভিটাছাড়া করা হয়েছে। বিচারের জন্যি অনেকের কাছে গেছি। সবাই খালি আশ্বাস দেয়, বিচার করে না।’
জোছনা অধিকারীকে তিন সন্তান নিয়ে পথে পথে ঘুরতে দেখে প্রতিবেশী মাছুরা খাতুন তাঁদের সাময়িক আশ্রয় দিয়েছেন। মাছুরা বলেন, ‘আমারও স্বামী নেই। স্বামী ফেলে গেলে কী অসহায় অবস্থা হয়, তা আমি জানি। তাই অসহায় পরিবারটিকে আশ্রয় দিছি। কিন্তু কত দিন পারব, বলতি পারিনে। তাদের নিয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্যদের কাছে গেছি। এমনকি কয়েকবার পুলিশের কাছেও ধরনা দিছি। কিন্তু কেউ কোনো সমাধান দিল না।’
জোছনার শাশুড়ি মায়া অধিকারী বলেন, ‘আমার ছেলেটা মানুষ না। আমাগেরে পথে বসিয়ে পালাইছে। জমি বিক্রির কথাও আগে জানতাম না। শুনিছি, জমিটি যে কিনেছে, সে বিদেশে থাকে। তার পক্ষ নিয়ে হঠাৎ একদিন ২০-২৫ জন অপরিচিত মানুষ এসে আমাগে ঘর থেইকে টেনেহিঁচড়ে বাইর কইরে দেছে। আমাগে পরনে যা ছিল, তাই নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিছি। কার কাছে বিচার চাইব। কেউ তো সঠিক বিচার করে না। তাই ভগবানের ওপর বিচার দিছি।’
উত্তর বেদকাশী ইউপির চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদে কয়েক দফা সালিস হয়েছিল। সেখানে দেখা গেছে, জোছনার স্বামী অশোক অধিকারীর ৬৬ শতাংশ জমির মধ্যে মালয়েশিয়াপ্রবাসী গোলাম রসুল ৪৯ শতাংশ জমি কিনে নিয়েছেন। বাকি জমি এখনো অবিক্রীত আছে। যে কারণে তাঁদের বসত বাড়িটি রক্ষার জন্য চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সব জমি দখলে নিয়ে পরিবারটিকে ভিটাছাড়া করা হয়েছে। বিষয়টি অমানবিক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সরেজমিনে জোছনা অধিকারীর পুরোনো বসতভিটায় গিয়ে দেখা গেছে, আধা পাকা ঘরের বারান্দার গেটে তালা দেওয়া। ঘরের সামনের পুকুরে দুই শিশু সাঁতার কাটছে। তাদের কাছে জানতে চাইলে হাসান নামের এক শিশু জানায়, বাড়িটি এখন তাদের। তার বাবা মালয়েশিয়ায় থাকেন। ঘরে তার মা আছেন। কিন্তু তার মাকে ডাকাডাকি করা হলেও সাড়া দেননি তিনি।
প্রতিবেশী সুপ্রিয়া অধিকারী বলেন, ‘দলবল নিয়ে জোরজবরদস্তি কইরে জোছনাদের বের করে দেওয়া হইছে। প্রতিবাদ করায় আমাগের নামেও মামলার হুমকি দিছে। তাই ভয়ে আমরা আর কিছু বলিনে। বিষয়টি পুলিশও জানে। তা–ও কোনো কাজ হয়নি।’
জানতে চাইলে কয়রা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইমদাদুল হক বলেন, বিষয়টি সমাধানের জন্য দুই পক্ষকে ডেকে পরিবারটি যাতে বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ না হয়, সে জন্য চেষ্টা করেছি। শেষে জমিজমাসংক্রান্ত বিষয় হওয়ায় তাঁদেরকে আদালতে যেতে পরামর্শ দিয়েছি।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুলী বিশ্বাস বলেন, ঘটনাটি অমানবিক। যদি ওই অংশে তাঁদের জমি থেকে থাকে, তাহলে তা উদ্ধারের ব্যবস্থা করা হবে। সেই সঙ্গে পরিবারটির যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সেদিকেও খেয়াল নেওয়া হবে।