Advertisement

দিনে বিক্রি হয় ৫০০ প্যাকেট, কুকারস সেভেনের খিচুড়ির এত জনপ্রিয়তার রহস‍্য কী?

প্রথম আলো

প্রকাশ: ১৭ আগস্ট, ২০২৫

24obnd

‘নকশা’র শুটিংয়ে প্রথম আলো কার্যালয়ে এসেছিলেন কনটেন্ট ক্রিয়েটর রাবা খান। কাজ শেষ হতে হতে দুপুর। খাওয়ার কথা উঠতেই বলে উঠলেন, ‘আচ্ছা, কুকারস-৭ রেস্টুরেন্টে খাওয়া যাবে? আমার ছোটবেলার সঙ্গে এ রেস্টুরেন্টটি জড়িয়ে আছে।’
শুধু রাবা খান নন, ঢাকার অনেকের কাছেই কুকারস সেভেন এক প্রিয় খাদ্যগন্তব্য।

বিশেষ করে কারওয়ান বাজারের আশপাশেই যাঁদের অফিস। বাইরে মধ্যাহ্নভোজের পরিকল্পনা বা কোনো অতিথি আপ্যায়নে এই রেস্তোরাঁর জুড়ি নেই। ফাস্টফুড ও চায়নিজ খাবারও আছে। তবে সব পদ ছাড়িয়ে গেছে এখানকার খিচুড়ি।
কিন্তু সবাই যেমন বলেন, সেই স্বাদ কি এখনো আছে? উত্তর খুঁজতে ৩১ জুলাই ‘অফিস হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’ চলে গেলাম ৩৫ বছরে পা রাখা এই রেস্তোরাঁয়। অর্ডার করার ২০ মিনিটের মধ্যে সামনে এল গরুর মাংসের ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি। সঙ্গে শসা-টমেটোর সালাদ। মুখে দিয়েই মনে হলো দেখতে যেমন ভালো, স্বাদও কাউকে হতাশ করবে না।

খাওয়া শেষে কুকারস সেভেনের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ কামাল উদ্দীনের সঙ্গে আড্ডায় বসা গেল। শুরুর দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে একটু স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লেন। রেস্তোরাঁটা দেওয়ার পেছনে দুটি অনুপ্রেরণা কাজ করেছে।

প্রথমত, তাঁর মা ভালো রান্না জানতেন। ফলে কাছের আত্মীয়স্বজনের অনুষ্ঠানে মাকে যেতেই হতো। সঙ্গে থেকে বাহারি রান্নার আয়োজন দেখতেন ছোট্ট কামাল। তখন থেকেই রান্নার প্রতি আগ্রহ। পরে কাজের সূত্রে কিছুদিন জেদ্দায় ছিলেন। ওখানে মাঝেমধে৵ ‘হোটেল কাকি’ নামের একটি রেস্তোরাঁয় ঢুঁ মারতেন। রেস্তোরাঁ খোলার ব্যাপারে সেখান থেকেও পেয়েছেন অনুপ্রেরণা।

‘দেশে ফিরে শুরু করেছিলাম লঞ্চের ব্যবসা। যাত্রীদের ভালো খাবার দেওয়ার কথা তখন মাথায় আসে। তবে সেটি আর হয়ে ওঠেনি। নানা কারণে একসময় লঞ্চের ব্যবসা ছেড়ে শান্তিনগরে একটি খাবারের দোকান কিনি। তবে অন্যের কাছ থেকে খাবার কিনে হোটেল চালানো কঠিন হয়ে পড়ে।’

১৯৯১ সালে কারওয়ান বাজারের উল্টো দিকে কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউতে কফির দোকান হিসেবে যাত্রা শুরু করে ‘কফি কুকারস সেভেন’। আয়োজনে কফি ছাড়াও কিছু ফাস্টফুড ছিল।

উদ্বোধনের দিন গ্রাহকদের অনেকে আবদার করেন, নাশতার পাশাপাশি দুপুরের খাবারও চালু করুন। মালিকের অনুপস্থিতিতে ম্যানেজার নিজেই চালু করলেন খিচুড়ি। নাম দেন ‘বেগম বাহার’। ৩৫ টাকার সেই খাবার আজও চলছে। অবশ্য সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। বর্তমানে খিচুড়ির সঙ্গে মিলবে গরুর মাংস, মুরগির মাংস, ইলিশ মাছ ও সবজি। উপাদানভেদে দাম ২৯০ থেকে ৫৯০।
মূল নাম কফি কুকারস সেভেন হলেও লোকে ‘কফি’টা আর বলে না; কিন্তু নামের মধ্যে ‘৭’ কেন? সেই উত্তরও পাওয়া গেল। কফিশপ পুরোদমে যখন রেস্টুরেন্ট হয়ে যায়, তখন পাওয়া যেত ৭টা বিশেষ খাবার। খিচুড়ি, সেট লাঞ্চ (সেট মেন্যু), ক্লাব স্যান্ডউইচ, কাটলেট, লামসামসহ ৭টি আইটেম। এ জন্যই নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে ৭।

আরও তো খাবার আছে, খিচুড়িই কেন এত জনপ্রিয়? ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রাখঢাক না করে খিচুড়ি তৈরির প্রক্রিয়াটা এবার বললেন কামাল উদ্দীন। প্রথমেই আলাদা পাত্রে চিনিগুঁড়া চাল অর্ধেক সিদ্ধ এবং ডাল পূর্ণ সিদ্ধ করে ঠান্ডা করা হয়। এরপর বড় পাতিলে বাহারি মসলায় চলে রান্না।

সবশেষে মাংস ছাড়া বাকি উপকরণ একসঙ্গে মিশিয়ে রান্না করলেই তৈরি হয় এই খিচুড়ি। অন্যদিকে প্রস্তুত করা হয় মাংস। চায়নিজ স্টাইলে পাতলা করে ছোট ছোট টুকরা করা হয় হাড় ও চর্বিহীন মাংস। রান্না শেষে প্রথমে খিচুড়ি, তার ওপরে মাংস, এরপর আবার খিচুড়ি দিয়ে গ্রাহকের সামনে পরিবেশন হয় এই খাবার।
রেস্তোরাঁয় খেতে আসা কিছু বিখ্যাত মানুষদের নাম নিলেন কামাল উদ্দীন। তিনি বলেন, ‘সৈয়দ শামসুল হক এখানে আসতেন। আমাদের কাটলেটের প্রশংসা করে একদিন বলেছিলেন, “একেই বলে সত্যিকারের কাটলেট।” এ ছাড়া নির্মলেন্দু গুণ, ইমদাদুল হক মিলনের মতো অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তি কুকারস সেভেনে আসতেন। পছন্দ করতেন খিচুড়ি ও অন্যান্য খাবার।’ রেস্তোরাঁটির মালিক আরও বলেন, একসময় জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা পাশের পাঁচ তারকা হোটেলে থাকলেও মাঝেমধে৵ এখানে এসে খেতেন বা খাবার নিয়ে যেতেন। মাশরাফি বিন মুর্তজা, রুবেল হোসেনের সঙ্গে তার সরাসরি কথাও হয়েছে।

প্রতিদিন প্রায় ৫০০ প্লেট খিচুড়ি বিক্রি করে এই রেস্তোরাঁ। বিশেষ অর্ডার থাকলে সেটি আরও বাড়ে। তবে ‘টেক অ্যাওয়ে’ বা হোম ডেলিভারির অর্ডারই আসে বেশি। এই প্রসঙ্গেই কামাল বলেন, ‘সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপিকা ফোন করে জানান, তাঁর লন্ডনপ্রবাসী ছেলে আমাদের খাবারের ভক্ত। ছেলের ইচ্ছা পূরণে খাবার পাঠাতে চান। আমরা খাবার তৈরি করে এমনভাবে প্যাকেট করে দিয়েছিলাম, যেন লম্বা সময় ভালো থাকে।’
মাজমুনা খাতুনের বাসা বা অফিস, কোনোটাই এখানে না, তারপরও মাঝে মাঝে এখানে খেতে আসেন। এই রাস্তা দিয়ে গেলে বা আশপাশে এলেই এখানে চলে আসেন। খিচুড়িই খাওয়া হয় বেশি।
সম্প্রতি রেস্তোরাঁর সম্প্রসারণ ও সংস্কার কাজ হাতে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। উত্তরা ও ধানমন্ডিতে নতুন শাখা খোলার পরিকল্পনাও তাঁদের আছে।

Lading . . .