Advertisement

সাদেক বাচ্চুকে সেদিন পাথরও ছুড়েছিলেন দর্শক...

প্রথম আলো

প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

24obnd

পাঁচ দশকের লম্বা ক্যারিয়ারে মঞ্চ, বেতার থেকে টেলিভিশন, পরবর্তী সময়ে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন ঢালিউড সিনেমায়। মেধাবী এই অভিনেতার নাম সাদেক বাচ্চু। তিনি সিনেমায় ক্যারিয়ার শুরুর পরে দর্শকদের মাঝে আলোচনায় আসতে শুরু করেন। নব্বই দশকে, এহতেশামের ‘চাঁদনী’ সিনেমায় খলনায়ক চরিত্রে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা পান সাদেক বাচ্চু। পরে ভেবেছিলেন হয়তো আর খুব বেশি সিনেমা করা হবে না। কিন্তু একের পর এক সিনেমাই তাঁকে দর্শকদের কাছে তুমুল আলোচিত করেছে। তাঁকে দর্শকদের কাছে বাঁচিয়ে রেখেছে সিনেমা।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, খল চরিত্রে জনপ্রিয়তার পরে পরিচালকেরা তাঁকে বেশির ভাগ খল চরিত্রে অভিনয়ের জন্যই ডাকতেন। খল অভিনেতা পরিচয়েই দেশজুড়ে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সাদেক বাচ্চুর। এই নিয়ে বেশ আফসোসও ছিল তাঁর। তবে দর্শকদের ভালোবাসা সেই আফসোস ঘুচিয়েছিল। খল চরিত্রের অভিনেতা হিসেবে বাস্তব জীবনেও তিনি নানা ঘটনার মুখোমুখি হন। যা প্রমাণ করে অভিনেতা হিসেবে তিনি ভক্তদের কাছে কতটা জনপ্রিয় ছিলেন।

খল অভিনেতাদের বিপত্তির শেষ নেই, পর্দার খল চরিত্রের সঙ্গে তারকাদের ব্যক্তিগত জীবনকে গুলিয়ে ফেলেন দর্শকেরা। সিনেমার কোনো কোনো খল চরিত্র দর্শকদের হৃদয়ে এতটাই দাগ কাটে যে সেই চরিত্র থেকে বের হতে পারেন না দর্শকেরা। সিনেমা হলে বসে দর্শকেরা খল অভিনেতাদের গালাগালি করেন, সরাসরি দেখা হলে উত্ত্যক্ত করতেও ছাড়েন না। খল অভিনেতা সাদেক বাচ্চুর জীবনেও তেমন ঘটনা ঘটেছিল সত্তরের দশক ও পরবর্তী নানা সময়ে।

টেলিভিশন ধারাবাহিকে রাজাকারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সাদেক বাচ্চু। দর্শক মহলে তুমুল আলোচিত নাটকের এক দৃশ্যে একজনকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেন সাদেক বাচ্চু। সেই পর্ব প্রচারের পরদিন বোনকে আনতে ট্রেনে জামালপুর গিয়েছিলেন তিনি। স্টেশনে তাঁকে দেখে দর্শকেরা বাদামের খোসা ছুড়ে মারেন, কেউবা আবার পাথর ছুড়তে থাকেন। সেই যাত্রায় কোনোমতে সেখান থেকে আসতে পেরেছিলেন এই অভিনেতা। তবে দর্শকদের বোঝাতে হয় এটা শুধুই অভিনয়।

পরবর্তী সময়ে ‘রামের সুমতি’ চলচ্চিত্রে পার্শ্বনায়কের চরিত্রে অভিনয় করে চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে সাদেক বাচ্চুর। এরপর ‘চাঁদনী’সহ বেশ কয়েকটি সিনেমায় খল চরিত্রে অভিনয় করে আলোচিত হন সাদেক বাচ্চু। বেশ আগে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘দর্শক আমাকেও বেশির ভাগ সময় চরিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে। মনে করে আমিও চরিত্রের মতোই। আবার দর্শকদের বুঝিয়ে বললে অনুধাবন করতে পারেন। এটা সব সময়ই উপভোগ করি। কারণ, দর্শক এর মধ্য দিয়ে চরিত্রকে মনে রাখে। এটাও একধরনের ভালোবাস।’

চাঁদপুরের সন্তান সাদেক বাচ্চু (প্রকৃত নাম মাহবুব আহমেদ) ১ জানুয়ারি ১৯৫৫ সালে চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কর্মজীবনে বাংলাদেশ ডাক বিভাগে চাকরি করতেন। ১৯৭০ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে চাকরিতে ঢোকেন। তাঁর বাবা ছিলেন ডাকঘরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তাঁর মৃত্যুর পর সাদেক বাচ্চুকে চাকরি দেওয়া হয়। ২০১৩ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। সেই সময়ে তিনি ক্যারিয়ার নিয়েও কিছুটা হতাশ হন।

কারণ, অভিজ্ঞতা অনুযায়ী তখন তিনি খুব বেশি কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পারছিলেন না। কমিয়ে দিয়েছেন অভিনয়। প্রথম আলোর এক সাক্ষাৎকারে সাদেক বাচ্চু জানিয়েছিলেন, ‘তিনি ইচ্ছা করে অভিনয় কমিয়ে দেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘যে চরিত্রে আমাদের মানায়, তেমন চরিত্র আমাদের কাছে আসে না। গল্পে আমাদের রাখা হয় না। পরিচালকেরা আমাদের কাছে আসেন না। গল্প আমাদের পছন্দ হয় না। ব্যাটে-বলে মেলে না।’

সাদেক বাচ্চু আক্ষেপ করে আরও বলেছিলেন, ‘এ দেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে মনে করা হয় অভিনয়শিল্পী সিনিয়র হয়েছেন মানে তাঁকে আর প্রয়োজন নেই। কীভাবে তাকে বিতাড়িত করা যায়, সেটা ভাবতে সবাই উঠেপড়ে লাগেন। ও সিনিয়র হয়ে গেছে? তবে ওকে বাদ দিয়ে দাও। অথচ যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে পৃথিবীর সব দেশ তাল মিলিয়ে নেয়। পুরোনো মানুষকে নতুন প্রজন্মের মানুষেরা ছাড়ে না। পুরোনোরা পুরোনো অভিজ্ঞতা দিয়ে নতুনদের সমৃদ্ধ করে। নতুনেরা তাদের আধুনিকতা দিয়ে পুরোনোদের বরণ করে নেয়। এই যে দেওয়া-নেওয়া, এই যে দুই দলের সংমিশ্রণ, বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যেখানে এসব মানা হয় না।’

সাদেক বাচ্চুর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘জজ ব্যারিস্টার পুলিশ কমিশনার’, ‘জীবন নদীর তীরে’, ‘জোর করে ভালোবাসা হয় না’, ‘তোমার মাঝে আমি’, ‘ঢাকা টু বোম্বে’, ‘ভালোবাসা জিন্দাবাদ’, ‘এক জবান’, ‘আমার স্বপ্ন আমার সংসার’, ‘মন বসে না পড়ার টেবিলে’, ‘বধূবরণ’, ‘ময়দান’, ‘আমার প্রাণের স্বামী’, ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘প্রিয়জন’, ‘সুজন সখী’ প্রভৃতি। ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান এ অভিনেতা। আজ এই অভিনেতার মৃত্যুবার্ষিকী।

Lading . . .