প্রকাশ: ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ওটিটি’র যাত্রালগ্ন থেকে বাংলাদেশে এটি শিল্পী-নির্মাতাদের কাছে একটি সৃজনশীলতার নতুন ক্ষেত্র। যেখানে নেই কোনো সীমাবদ্ধতা। সেন্সরশিপের ঝামেলা না থাকায় সাহসী ও ভিন্নধর্মী গল্প বলার সুযোগ তৈরি হয়।
কিন্তু এতে বাধে বিপত্তি। সাহসী গল্প বলতে গিয়ে অনেক সময় অতিরঞ্জিত ও অতিরিক্ত রগরগে দৃশ্য ক্যামেরায় দেখিয়ে ফেলছেন নির্মাতারা। যদিও গল্পের কারণেই এসব দৃশ্য-এমনটাই দাবি নির্মাতাদের।
তবে বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের দৃশ্য অশ্লীলতাকে ইঙ্গিত করে। শুরু থেকে অনেক কনটেন্টের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ওঠে। সামাজিকমাধ্যম থেকে শুরু করে গণমাধ্যমে বিষয়গুলো নিয়ে লেখালেখি হয়। নড়েচড়ে বসেন নির্মাতা থেকে শুরু করে প্ল্যাটফর্ম কর্তৃপক্ষ। ওটিটিকেও সেন্সরশিপের আওতায় আনার দাবিও তুলেন অনেকে।
সিনেমার জন্য ‘চলচ্চিত্র সেন্সর সার্টিফিকেশন বোর্ড’ থাকলেও, অনলাইনের কনটেন্ট তাদের আওতার বাইরে ছিল। কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন হওয়াতে সব সিরিজ ও ফিল্মে উঠে আসছে অশালীন সংলাপ, সহিংসতা বা রাজনৈতিক ইঙ্গিত। দর্শকদের অভিযোগ, এসব কনটেন্ট পরিবার নিয়ে দেখা যায় না। আবার অনেকে বলছেন, এই স্বাধীনতাই ওটিটির সৌন্দর্য, নইলে তা আর টিভি নাটক থেকে আলাদা হবে না।
নির্মাতারা এখানে রয়েছেন দ্বিধায়। একদিকে তারা মুক্তভাবে গল্প বলতে চান, অন্যদিকে সেন্সরশিপের ভয়ে গল্পে কাটছাঁট করতে বাধ্য হন। নির্মাতাদের বক্তব্য, ‘যদি সেন্সরের কাঁচি চালানো হয়, তবে ওয়েব সিরিজ ও টেলিভিশনের নাটকের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না।’
একটা সময় দেশের ওয়েব সিরিজ ও ফিল্মে দর্শক টানার কৌশল হিসাবেও অশ্লীলতার আশ্রয় নেওয়া হতো। শুরুতে প্রায় অনেক কনটেন্টে এমন অশ্লীলতার ছড়াছড়ি ছিল। এরমধ্যে ‘বুমেরাং’, ‘সদরঘাটের টাইগার’, ‘আগস্ট ১৪’ নামে কনটেন্টগুলোর দিকেও আঙ্গুল উঠেছিল। সমালোচনার মুখে প্রথম দুটি কনটেন্ট অ্যাপ থেকে নামিয়ে ফেলা হয় এবং ‘আগস্ট ১৪’ নামের কনটেন্টের বেশ কিছু দৃশ্য সংশোধন করা হয়। এদিকে এ সিরিজটি বর্তমানে ইউটিউব প্ল্যাটফর্মেও দেখা যাচ্ছে।
এদিকে সমালোচনা থেকে বাদ যায়নি আলোচিত ‘তাকদীর’, ‘কাইজার’ কিংবা ‘উনোলৌকিক’ কনটেন্টগুলোও। এসব সিরিজের গল্পে বাস্তব জীবনের অন্ধকার দিক ফুটে উঠেছে, যা দর্শককে নতুন এক অভিজ্ঞতা দিয়েছে। আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই একটা সময় নির্মাতারা সাবধানতা অবলম্বন করেন।
গত দুই বছর ধরেই অশ্লীল সংলাপ ও দৃশ্যের ব্যবহার অনেকটাই কমেছে। কিন্তু হঠাৎ করেই গত কুরবানি ঈদে প্রচারিত ‘পাপ কাহিনি’ নামে একটি ওটিটি সিরিজ নতুন করে অশ্লীলতার উত্তাপ ছড়ায়। এটি নির্মাণ করেছেন শাহরিয়ার নাজিম জয়। সিরিজটির অন্যতম প্রধান চরিত্রেও অভিনয় করেছেন তিনি। তার সঙ্গে আরও আছেন রুনা খান, মৌসুমী মৌ, তানজিয়া মিথিলা প্রমুখ। এর এমন কিছু দৃশ্য রয়েছে যা পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেখা যায় না। সিরিজটি দেখলে মনে হবে গল্প, চিত্রনাট্য ও সিনেমাটোগ্রাফির বাইরে গিয়ে নির্মাতা বেশি মনোযোগ দিয়েছেন অশ্লীল সংলাপ ও রগরগে দৃশ্যে।
আইস্ক্রিনে সিরিজটি মুক্তি পর এর ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ সামাজিক মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ছে। যা থেকে প্রশ্ন উঠছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আর কতদিন নিয়ন্ত্রণহীন থাকবে?
আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মগুলোর দিকে একটু নজর দিলে দেখা যাবে, সম্প্রতি অশ্লীলতার অভিযোগে ভারতে ‘এএলটি বালাজি’, ‘উল্লু’, ‘বিগ শটস’সহ ২৫টি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ও সংশ্লিষ্ট মোবাইল অ্যাপ নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার। নিষিদ্ধ হওয়া ওই অ্যাপগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ, কয়েক বছর ধরেই আপত্তিকর বিজ্ঞাপন ও অশ্লীল কনটেন্ট দেখানো হচ্ছিল, যা জনমনে ভীষণভাবে প্রভাব ফেলে।
সরকারি কর্মকর্তারা ভারতীয় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ভারতের ডিজিটাল কনটেন্ট-সংক্রান্ত আইন লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তদন্তে দেখা যায়, এসব প্ল্যাটফর্মে আপলোড হওয়া ভিডিও এবং ওয়েব সিরিজে ছিল ‘যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ’ দৃশ্য, কোথাও কোথাও নগ্নতা ও যৌন কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত উপস্থাপনাও ছিল। এসব কনটেন্টকে ‘পর্নোগ্রাফিক প্রকৃতির’ বলেই মনে করেছে কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশে এর সমাধান কী হতে পারে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, ওটিটি প্ল্যাটফর্মে পুরোপুরি সেন্সর চালানো সম্ভব নয়, আবার সম্পূর্ণ স্বাধীন রাখাও ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ভারসাম্য রক্ষাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে, প্ল্যাটফর্মগুলো নিজেদের উদ্যোগে বয়সভেদে রেটিং ও সতর্কীকরণ ব্যবস্থা চালু করা, সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট নির্দেশিকা দেওয়া (যেমন ধর্মীয় অবমাননা বা ঘৃণা জন্মায় এমন বক্তব্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ) এবং দর্শকদের সচেতন করা যাতে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে কোনটা শিশুদের জন্য উপযোগী, আর কোনটা নয়।
ওটিটি সেন্সরশিপ নিয়ে বিতর্ক তাই শেষ হওয়ার নয়। কেউ মনে করেন সেন্সর ছাড়া সমাজে নৈতিক অবক্ষয় বাড়বে, আবার কেউ কেউ বলেন সেন্সর মানেই শিল্পের গলা টিপে ধরা। আসল প্রশ্ন হলো, আমরা কি এমন এক ভারসাম্য তৈরি করতে পারব, যেখানে নির্মাতারা সাহসী গল্প বলতে পারবেন, আবার সমাজও সাংস্কৃতিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতার নিরাপত্তা পাবে? ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই সূক্ষ্ম সীমারেখা কোথায় টানা যায় তার ওপর।