Advertisement

শাবানা কি বাংলাদেশে নাকি যুক্তরাষ্ট্রে? কী বলছেন শাবানা ও তাঁর স্বামী

প্রথম আলো

প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ঢাকার বারিধারার বাসায় প্রথম আলোর ক্যামেরায় শাবানা ও ওয়াহিদ সাদিকছবি : মনজুর কাদের
ঢাকার বারিধারার বাসায় প্রথম আলোর ক্যামেরায় শাবানা ও ওয়াহিদ সাদিকছবি : মনজুর কাদের

‘দীর্ঘ বিরতির পর দেশে ফিরলেন শাবানা’, ‘পাঁচ বছর পর ঢাকায় শাবানা’, ‘৫ বছর পর দেশে ফিরলেন শাবানা’, ‘দেশে এসেছেন শাবানা’, ‘নীরবে দেশে এসেছেন শাবানা’, ‘৫ বছরের প্রবাসজীবনের পর ঢাকায় শাবানা: ভক্তদের উচ্ছ্বাস’—এই ধরনের শিরোনাম দুই দিন ধরে প্রকাশিত হচ্ছে। বরেণ্য অভিনয়শিল্পী শাবানার দেশে ফেরা নিয়ে এই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এক ইউটিউবার ভিডিও থেকে খবরটি ছড়ান। এরপর প্রথম আলোর সঙ্গে কথা হয় শাবানা ও তাঁর প্রযোজক স্বামী ওয়াহিদ সাদিকের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, ‘এই ধরনের খবর কারা ছড়ায়, কিছুই বুঝি না।’

দুই দিন ধরে গুঞ্জন, দেশবরেণ্য অভিনয়শিল্পী শাবানা এখন ঢাকায়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় এসে তিনি চুপচাপ সময় কাটাচ্ছেন। কারও সঙ্গে দেখা করছেন না, এমন খবর যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন প্রথম আলোকে ওয়াহিদ সাদিক বলেন, ‘তিন সপ্তাহ আগে আমার হার্ট অ্যাটাক হয়। হাসপাতালে গেলে দুটি ব্লক ধরা পড়ে। এরপর দুটি স্টেন্ট পরানো হয়। চিকিৎসক আমাকে মাসখানেকের বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। আমি এখন পুরোপুরি চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলছি। এই সময় তো দেশে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। আর দেশে যদি যাই, তাহলে কিছু মানুষ তো জানবেই। লুকোচুরি করার কিছু নাই।’

কথা প্রসঙ্গে ওয়াহিদ সাদিক বলেন, ‘একটা নির্দিষ্ট সময় পর আমাদের দেশে যাওয়া হয়। প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আবার আমেরিকায় ফিরে আসি। মাস দুয়েক আগে আমার বাংলাদেশে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু এখানে আরও কিছু জরুরি কাজ পড়ে যাওয়াতে আর যাওয়া হয়নি। এরপর তো অসুস্থ হয়ে পড়ি। তাই আপাতত যাওয়া হচ্ছে না।’

কথা হয় শাবানার সঙ্গেও। তিনি জানান, মায়ের সঙ্গে সময় কাটছে তাঁর। বয়স্ক মা তাঁর কাছে আছেন। বললেন, ‘আমিও শুনলাম, আমি নাকি বাংলাদেশে গেছি। চুপচাপ আছি। কারও সঙ্গে দেখা করছি না! শুনে আমি নিজেও অবাক। তবে এটা বুঝি, সবাই আমাকে ভালোবাসেন, তাই খোঁজখবর রাখেন। কিন্তু এমনভাবে গুজব ছড়ালে তো সমস্যা। যাঁরা শুরুতে ছড়ালেন, আমি ঢাকায় আছি তাঁরা তো বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবেন। তাই কোনো কিছু বলার আগে যাচাই–বাছাই করে নেওয়া উচিত।’

স্বামী ওয়াহিদ সাদিকের সঙ্গে ৫ বছর আগে শেষবারের মতো ঢাকায় এসেছিলেন শাবানা। প্রয়োজনীয় কাজ শেষে তাঁরা ফিরে যান। এরপর ওয়াহিদ সাদিক ঢাকায় এলেও আসেননি শাবানা।

বাংলাদেশের সিনেমায় যখন অভিনয় নিয়ে খুব ব্যস্ত, ঠিক তখনই কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চলে যান শাবানা। হঠাৎ তাঁর এই দেশান্তরি হওয়ায় বিস্মিত হন ভক্ত, শুভাকাঙ্ক্ষী চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট সবাই। সবার প্রিয় শাবানা এখন থাকছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে। স্বামী, সন্তানেরাসহ সেখানেই তাঁর স্থায়ী আবাস। দেশের বাইরে থাকলেও মনে পড়ে দেশের কথা। নির্দিষ্ট সময় পর দুই সপ্তাহ কিংবা এক-দুই মাসের জন্য ছুটে আসেন বাংলাদেশে। প্রয়োজনীয় কাজ সারেন, নিজের মতো করে কাটিয়ে আবার ফিরে যান প্রবাসের সংসারে। সেখানেও যে রয়েছে ছেলে, মেয়ে, নাতি-নাতনিসহ অনেক আত্মীয়স্বজন।

২৫ বছর অভিনয় থেকে দূরে আছেন শাবানা, কিন্তু তাতে কী। আজও রাস্তায় বের হলে দেখে ফেললেই সামনে আসেন, কেউ–বা ছুঁয়ে দেখেন। কেউ আবেগে জড়িয়ে ধরেন। এখন আবার কেউ কেউ নাকি সেলফি তোলার আবদারও করেন। শাবনাও হাসিমুখে তাঁদের আবদার পূরণ করেন।

অনেকের আগ্রহ, যে শাবানা এত এত ছবিতে অভিনয় করেছেন, এখন তাঁর সময়টা কাটছে কীভাবে? শাবানা জানান, ‘আগে আমি অভিনয়ের চাপে যে কাজগুলো করতে পারিনি, এখন সেগুলো করছি। ঘর-সংসার করছি। জীবনের বেশির ভাগ সময় কাজ করতে করতে কেটে গেছে। বাচ্চাগুলো অনেক মিস করেছি। এখন ওদের দেখাশোনা করি, ওদের বাচ্চারা যখন নানুমণি বলে ডাকে, কাছে এসে খেলে, তখন মনে হয় জীবনে এর চেয়ে সুন্দর কিছু হতে পারে না! এর বাইরে যেটুকু সময় পাই, প্রার্থনা করে কাটাই। সংসারের তো অনেক কাজ। তবে আমার নাতি–নাতনিরা মাঝেমধ্যে ইউটিউবে দেখে। ওরা আমাকে বলে নানুমণি সত্যিই, রিয়েলি ইউ আর আ বিগ অ্যাকট্রেস! মাঝেমধ্যে এ-ও বলে আমরা যদি তোমার মতো অভিনয় করতে চাই, হতে পারব? খুব মায়া লাগে ওদের মুখ থেকে এ কথা যখনই শুনি।’

পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই প্রথম সিনেমার অভিনয়ে নাম লেখান শাবানা। এহতেশাম পরিচালিত ‘নতুন সুর’ ছবিতে তিনি শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন। ‘চকোরী’ ছিল নায়িকা শাবানার শুরু। এই ছবির পরিচালক এহতেশাম, সম্পর্কে শাবানার বাবার খালাতো ভাই। এহতেশামই তখন শাবানার বাবাকে বলেছিলেন, ‘তোর মেয়েটাকে আমি একটি ছবিতে নিতে চাই।’ শাবানার বাবা তখন নাকি এভাবেই বলেছিলেন, ‘রত্না (শাবানার ডাক নাম) কীভাবে অভিনয় করবে! সে এত লাজুক, কারও সামনেই আসতে চায় না।’ নাছোড়বান্দা এহতেশাম বলেছিলেন, ‘তোর মেয়েটার মতো একটা মেয়েই আমি খুঁজছি। এরপর শাবানার বাবা রাজি হন।’ ওই ছবির নায়ক-নায়িকা ছিলেন রহমান-রওশান আরা।

সেই সময়কার স্মৃতিচারণা করে শাবানা প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘ছবিতে আমার প্রথম দৃশ্য ছিল এমন, খুশিতে আমি দৌড়ে এসে বলব, “ভাইয়া ভাইয়া আপুর বিয়ে।” আমাকে জড়িয়ে ভাইয়া বলবে, তাই নাকি রে!’ প্রথমবারে শট ওকে! তার পর থেকে মায়ের চেয়ে বাবাই সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করতেন, অনুপ্রেরণা দিতেন। মার বাবাও কিন্তু দুটি ছবি পরিচালনা করেছিলেন। ‘মুক্তি’ ও ‘মালকাবানু’। এর মধ্যে তো ‘মালকাবানু’ সুপারহিট। গানগুলো এখনো মানুষ গায়।

যে রত্নাকে শুরুতে বাবা চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে দিতে চাননি, পরে সেই বাবাই তাঁর অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন। শাবানাও হয়ে ওঠেন বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের একটা বিরাট অধ্যায়। এ অধ্যায়ে তিনি শেষ করেন ২৯৯টি সিনেমার কাজ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন আলমগীরের বিপরীতে। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের সুদর্শন এই নায়কের বিপরীতে তাঁর অভিনীত ছবির সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১৩০। এরপরই যাঁর সঙ্গে বেশি অভিনয় করেছেন, তিনি হলেন নায়করাজ রাজ্জাক।

অভিনয়নৈপুণ্য যে রত্না শাবানা হয়ে উঠলেন, দেশ-বিদেশের মানুষের মনে এখনো উচ্চাসনে বসত গেড়ে আছেন, তিনি কেনই-বা ২৫ বছর আগে পাড়ি জমালেন যুক্তরাষ্ট্রে, এমন প্রশ্ন সবচেয়ে বেশি।

শাবানা বলেন, ‘লাখো-কোটি মানুষের ভালোবাসায় শাবানা হলাম। হঠাৎ মনে হলো সন্তানদেরও তো সময় দেওয়া দরকার। আমার বড় মেয়ে সুমী তখন এ লেভেল শেষ করল। উচ্চশিক্ষার জন্য তাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হলো। কিছুদিন পর ছোট মেয়ে ঊর্মি আর ছেলে নাহিনও যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেল। ওদের সবার বয়সই–বা তখন আর কত। বাচ্চারা আমাকে খুব মিস করছিল। দেশে যখন ছিল, তখন তো আমার চোখের সামনেই ছিল। কাজের ফাঁকে দেখতাম। তখন আমিও ভাবলাম, মা হিসেবে আমার তো কিছু দায়িত্ব আর কর্তব্য আছে। সন্তানদের যদি ঠিকভাবে গড়ে তুলতে না পারি, তাহলে আমার এই অভিনয়জীবন দিয়ে কী হবে! তাই কষ্ট হলেও সিনেমা ছেড়ে সন্তানদের ব্যাপারে মনোযোগী হলাম। এ জন্যই যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সাদিক সাহেবও ওখানে কিছু ব্যবসার ব্যবস্থা করলেন। আমিও দেখলাম অনেক দিন তো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে ছিলাম, এবার ঘরের দিকে মনোযোগী হই। তাই চলে গেলাম। তবে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিও কিন্তু আমার কাছে একটা পরিবারের মতো ছিল। সেখানে আমি রাত-দিন অবসরবিহীন কাজ করেছি। সহশিল্পী, পরিচালকদের সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক গড়ে উঠল। কাউকে ভাই, আবার কাউকে চাচা ডাকতাম। সবাইকে খুব মিস করি। কিন্তু মানুষের জীবনে একটা সময় আসে, যখন কোনো উপায় থাকে না। জীবনের ধাপে ধাপে কিছু সময় আসে, সে সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব দরকার। সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া, আমি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি।’

যে সন্তানদের জন্য শাবানা অভিনয়জীবন ছাড়লেন, তাঁরা এখন পরিণত বয়সের অধিকারী। পাট চুকিয়েছেন পড়াশোনার। বড় মেয়ে সুমী ইকবাল এমবিএ করেছেন। বিয়ে করে এখন সে পুরোদস্তুর গৃহিণী। ছোট মেয়ে ঊর্মি সাদিক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। ছেলে নাহিন সাদিক রটগার্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি করছেন।

Lading . . .