প্রকাশ: ৭ আগস্ট, ২০২৫

মুঠোফোন, ল্যাপটপ-কম্পিউটার যখন ছিল না, এখনকার মতো ঘরে ঘরে যখন টেলিভিশন, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট ছিল না; তখন কেমন ছিল শৈশব-কৈশোর ও তারুণ্যের সেই সব দিন; মানুষের যাপিত জীবন। সেই সময়ের কর্মজীবী তরুণ তিন বন্ধুর গল্প, ভালোবাসা, সম্পর্কের টানাপোড়েন, হত্যা ও বিচারহীনতার করুণ বাস্তবতা ‘উড়াল’ সিনেমায় চিত্রিত হয়েছে।
একনজরে
চলচ্চিত্র: উড়াল
পরিচালক: জোবায়দুর রহমান
গল্প: সম্রাট প্রামাণিক
অভিনয়ে: মাহাফুজ মুন্না, সোহেল তৌফিক, শান্ত চন্দ্র সূত্রধর, কাব্যকথা, কে এম আবদুর রাজ্জাক, করবী দাশ প্রমুখ
চিত্রগ্রহণ: ইবাদত আলীম
সম্পাদনা: আশিকুর রহমান
সংগীত: খৈয়াম সানু সন্ধি
সিনেমার শুরুতেই স্বাস্থ্যবান এক তরুণকে পুরোনো ভাঙাচোরা সাইকেল চালাতে দেখা যায়। গাছপালায় ঠাসা দূরে গ্রাম। দুই পাশে সবুজ ধানখেত, মাঝখানে সরু মেঠো পথ দিয়েই ওই তরুণ সাইকেল চড়ে যাচ্ছে। সে এক অনিন্দ্য সুন্দর গ্রামীণ দৃশ্য। মন যেন অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, ‘ইশ্..., যদি এই পথে ধরে যেতে পারতাম!’ পরে দেখা গেল ওই তরুণের নাম বাচ্চু। সে সাইকেলের মেকার। স্বাস্থ্যবান হওয়ায় সবাই তাকে ‘ভোম্বল’ বলে ডাকে।
কিশোরী কুমকুমের ভীষণ প্রেমপ্রার্থী বাচ্চু। কুমকুম যখন স্কুলে যায়, পৃথিবীর সব মনোযোগ তার দিকে দিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে বাচ্চু। পাম্পার দিয়ে সাইকেলের চাকায় পাম্প দিতে দিতে চাকা ফাটিয়ে ফেলে। এ জন্য ভোম্বলকে শুনতে হয়, ‘শালা, চেংড়ি (মেয়ে) দেখোচো।’
বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের এই সংলাপ শুনে নব্বইয়ের দশকের কৈশোর-তারুণ্য কাটানো ছেলেমেয়েদের অন্তর-আত্মা নাড়া দিয়ে উঠবে। দোকান পাড়ে দাঁড়িয়ে, সেলুনে বসে কিংবা রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করে স্কুলগামী-কলেজগামী মেয়েদের দেখার স্মৃতি কার না আছে। পর্দায় পার্বতীপুর বালিকা পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের ফটকের সামনে তরুণদের উঁকিঝুঁকি দেখে নিজের জীবনের প্রিয় গার্লস স্কুলের কথা মনে পড়ে যাবে।
বাচ্চুর অপর দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু রঞ্জু ও মতি। রঞ্জু মহাজনের আড়তে চাকরি করে ও মহাজনের বাড়িতেই থাকে। মহাজনের মেয়ে কুমকুমের সঙ্গে রঞ্জুর নীরব-নিবিড় প্রেম। সে কথা কেউ জানে না, এমনকি দর্শকও বিষয়টি প্রথমে বুঝতে পারেন না। আর মতি পত্রিকার হকার। দিন-দুনিয়ার সব খবর জানা বলে কেউ কেউ তাকে ‘বিবিসি’ বলে ডাকে।
তিন বন্ধুর ঘোরাফেরা, আড্ডা, খুঁনসুটি, ট্রেন ও উড়োজাহাজের সঙ্গে সাইকেল চালানো প্রতিযোগিতা দেখতে দেখতে একঘেয়ে লাগা মুহূর্তে আকস্মিক গল্পের নতুন মোড় নেয়। কুমকুম বাড়িতে নেই, তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমন সময় পর্দায় ভেসে উঠল বিরতি। উত্তেজনা ও কৌতূহলের উদ্রেগ হলো। বিরতির পর দ্রুত গল্প এগিয়ে যেতে থাকল।
সিনেমার প্রথমার্ধে আনন্দ-উচ্ছ্বাস এবং দ্বিতীয়ার্ধ ব্যথা-বেদনায় মোড়ানো। বাচ্চু নিশ্চিত হলো রঞ্জুই তাঁর স্বপ্নের নায়িকা কুমকুমকে নিয়ে পালিয়েছে। তখন রঞ্জুকে প্রতারক ও বিশ্বাসঘাতক তকমা দিয়ে মনের দুঃখে এলাকা ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয় বাচ্চু। এলাকায় পড়ে থাকল মতি। তাকে কেন্দ্র করেই গল্প বয়ে যায় প্রান্তসীমা পর্যন্ত। বন্ধুত্বের এই ভাঙন দেখে অন্তরে অনুরণিত হতে পারে, সায়ানের সেই গান, ‘কেন বয়স বাড়লে ছোট্টবেলার বন্ধু হারিয়ে যায়?’
সহজ-সরল সাদাসিধে গল্পের এই সিনেমায় তিন তরুণের অভিনয় ছিল সাবলীল ও চমৎকার। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার উচ্চারণ, প্রক্ষেপণও ছিল দারুণ। বোঝার কোনো উপায় ছিল না বড় পর্দায় কুমকুমের এটি প্রথম অভিনয়।
কুমকুমের বাবা মহাজন স্থানীয় প্রভাবশালী হিসেবে ভাবগাম্ভীর্য ও ঠাটবাট ছিল পরিমিত। পরে জেনে অবাক হতে হলো কুমকুমের মা চরিত্রে যে নারী অভিনয় করেছেন, তিনি বাস্তব জীবনেও কুমকুমের মা। অল্প সময় পর্দায় থেকে দুই-একটি সংলাপে আলাদা করে নজর কেড়েছে বাচ্চুর সাইকেল মেরামতের সাহায্যকারী ঘেটু চরিত্রের শিশুটি। মহাজনের ডানহাত ও ক্যাডার ভাবভঙ্গি ধারণ করা বিল্লার উপস্থিতি মানানসই। তবে কুমকুমকে খুঁজতে সে বেশি সময়ক্ষেপণ করায় বিরক্তি লেগেছে।
এখন কথা হচ্ছে, নব্বইয়ের দশকে মফস্সল শহরের সিনেমা হলে যেসব দর্শক ডিসিতে ১২ টাকা ও থার্ড ক্লাসে ৫ টাকা দিয়ে সিনেমা দেখেছেন, তাঁরা যদি বড় শহরের মাল্টিপ্লেক্স ৪০০ বা ৫০০ টাকা খরচ করে ‘উড়াল’ দেখেন, তবে তাঁদের পয়সা উশুল হবে কি? তাঁদের উশুল হবে কিন্তু যাঁদের জন্ম শহরে; গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ যাঁদের বিচ্ছিন্ন, তাঁদের এই সিনেমা দেখে ভালো নাও লাগতে পারে। তবে বন্ধুর প্রতি, গ্রামের প্রতি ও মফসস্ল শহরের প্রতি যাঁদের ন্যূনতম মমতা আছে, তাঁদের এই সিনেমা খারাপ লাগার কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।
যাঁদের কেবল রোমান্টিক, অ্যাকশন বা থ্রিলার পছন্দ, তাঁদেরও এ সিনেমা ভালো নাও লাগতে পারে। বর্তমান প্রজন্মের ছেলমেয়েরাও ছবিটা দেখে তাঁদের আগের প্রজন্মের জীবনাচরণ সম্পর্কে ধারণা পেতে পারেন।
সিনেমার শেষ মুহূর্তে রঞ্জুর জন্য মতির আর্তনাদ ও হাহাকার দেখে চোখে পানি চলে আসতে পারে। মনে হতে পারে, সেই তো প্রকৃত বন্ধু, যার সঙ্গে অবস্থানগত দূরত্ব বাড়লেও হৃদয়-মননে গুরুত্ব কমে না বিন্দুমাত্র।