সালমান শাহর মৃত্যু নিয়ে সামিরা সাক্ষাৎকারে যা বলেছেন
প্রকাশ: ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ দিয়ে বড় পর্দায় অভিষেকের পর রাতারাতি তারকাখ্যাতি পান সালমান শাহ। প্রথম ছবিতেই তিনি বাজিমাত করেন, অভিনয় দিয়ে মানুষের মনে জায়গা করে নেন। এরপর একের পর এক হিট সিনেমা উপহার দিয়েছেন তিনি। নব্বইয়ের দশকের ফ্যাশন আইকনে পরিণত হন তিনি। তাঁর চুলের কাট, সানগ্লাস, জিনস-টি-শার্ট—সবই হয়ে উঠেছিল ট্রেন্ড। তরুণ প্রজন্ম তাঁকে অনুসরণ করত চোখ বন্ধ করে। তাঁর স্বাভাবিক অভিনয়, সহজাত সংলাপ বলার ভঙ্গি, পর্দায় রোমান্টিক আবেগ ফুটিয়ে তোলার দক্ষতা বদলে দিয়েছিল ঢালিউডের চিত্র। কিন্তু হঠাৎ সব শেষ—১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মাত্র ২৫ বছর বয়সে বিদায় নিলেন তিনি। মৃত্যুর ২৯ বছর পার হলেও প্রশ্ন থেকে গেছে—আত্মহত্যা নাকি হত্যা?
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার ইস্কাটনে সালমান শাহর বাসা থেকে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় মামলা করেন সালমান শাহর বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী। দুই যুগ ধরে আদালতে ঝুলে থাকা মামলার প্রথমে তদন্তভার পায় পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), এরপর নানা সংস্থা ঘুরে ২০১৬ সালের ২১ আগস্ট পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। মামলার রায় না হওয়ায় সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে, নাকি তিনি আত্মহত্যা করেছেন, ২৯ বছরেও সেই জট এখনো খোলেনি।
চিত্রনায়ক সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী বরাবরই বলে আসছেন, তাঁর চিত্রনায়ক ছেলে আত্মহত্যা করেনি। পরিকল্পিতভাবে তাঁকে খুন করা হয়েছে। অন্যদিকে তৎকালীন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সাবেক প্রধান বনজ কুমার মজুমদার জানিয়েছিলেন, ‘সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছিলেন, তাঁকে খুন করা হয়নি।’ মৃত্যুর ২৬ বছর পরও যেন সালমানের মৃত্যুর রহস্য কাটছে না। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা অবস্থায় সালমানের হঠাৎ মৃত্যুকে কেউ আত্মহত্যা, কেউ হত্যা বলেছে।
২০২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সালমানের জন্মদিন উপলক্ষে দেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয় সালমানের সাবেক স্ত্রী সামিরার। সেখানে সামিরা জোর দিয়ে জানিয়েছেন, সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন। শুধু তা–ই নয়, এর আগেও তিনবার তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন।
সাবেক স্বামী সালমান শাহর মৃত্যুর প্রসঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন সামিরা। বেসরকারি চ্যানেল টোয়েন্টিফোরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সামিরা বলেছেন, ‘আত্মহত্যা যারা করে, তারা তো কিছু বলে করে না। এখন নীলা চৌধুরী বারবার বলেন, সামিরাকে কেন রিমান্ডে নেওয়া হয় না। একটা বাসায় একটা বাচ্চা যখন আত্মহত্যা করে, সে বাচ্চার মা–বাবাকে কি আমরা উঠিয়ে নিয়ে চলে যাই? তাহলে আমাকে কেন উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে? ইট ইজ সুইসাইড।’
কেন এটি সুইসাইড, সেই ব্যাখ্যা নিজেই দিলেন সামিরা। বললেন, ‘ও (ইমন) মেন্টালি সুইসাইডাল বাই নেচার। এর আগে তিনবার সুইসাইডের চেষ্টা করেছে। মেট্রোপলিটন হাসপাতালের রেকর্ড চেক করলে জানা যাবে। ওখানে দুবারের রেকর্ড আছে। আরেক হাসপাতালে একবার আছে। তিনটাই আমার বিয়ের আগে। তিনটা ঘটনাই আমি জানি। একবার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে করেছিল। আরেকবার আমাকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য করেছে। আরেকবার ওর কিছু একটা হয়েছিল, সেটার জন্যও করেছিল।’
কথাপ্রসঙ্গে সামিরা এ–ও বললেন, ‘একটা কথা বলতে চাই, ইমন কিন্তু ছবিতে ক্যারিয়ার করতে চায়নি। সে পড়াশোনা করতে চেয়েছিল। কিন্তু ও যখন এসএসসিতে পড়ে, তখন একটা ঘটনার কারণে, এরশাদ (হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ)–সংক্রান্ত, নীলা চৌধুরীকে নিয়ে, সেই ঘটনায় ওই সময় নীলা চৌধুরী জেলেও যান, ময়মনসিংহ কারাগারে ছিলেন। ইমন কিন্তু একদিনও মাকে দেখতে যায়নি জেলে। কেন? তখন তো ওর লাইফে আমি নাই। আমার তো ১৯৯২ সালের ২০ ডিসেম্বর বিয়ে হয়েছে। আর এ ঘটনা জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি কিংবা মার্চের দিকের। ইমন কিন্তু তাঁর মাকে মা, আম্মা এসব ডাকত না। মহিলা বলে ডাকত। আমাদের সামনে অবশ্য ওভাবে বলত না। শুটিং সেটে যখন নীলা চৌধুরী যেতেন, তখন ইমন বলত, মহিলা আসছে। ডলি জহুর আন্টি একদিন সেটে থাকা অবস্থায় এমন ঘটনা ঘটেছিল। তখন বকা দিয়ে ইমনকে বলেছিল, “তুই এভাবে ডাকছিস কেন? তোর তো মা হয়।” ইমন তখন হেসে উড়িয়ে দিয়েছে।’
সামিরা আরও বললেন, ‘ইমনের মনে অনেক কষ্ট আগে থেকেই ছিল। ইমন অনেক কিছু দেখে বড় হয়েছিল, যেগুলো ওর দেখার দরকার ছিল না। এগুলো নিয়ে বাচ্চাদের হয় কী, আমরা এখন যেমন হিউম্যান সাইকোলজি নিয়ে অনেক পড়াশোনা করি, তখন তো এগুলো করতাম না। তখন আমাদের কোনো কাউন্সেলিংয়ের সুযোগও ছিল না। ছিল না রিহ্যাবিলিটিশেনরও। এখন রিহ্যাব আছে, কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা আছে। আমরা তেমন কিছু অনুভব করলে কারও সঙ্গে আলাপ করে তা ভাঙার চেষ্টা করি, বোঝার চেষ্টা। তখন তো ইমন এসব কাউকে বলতে পারেনি। সালমান শাহ হওয়ার পর তো আরও বলতে পারেনি। যাকে বলবে, এটা নিউজ হয়ে যাবে।’
এদিকে চিত্রনায়ক সালমান শাহ মা নীলা চৌধুরী বলেছেন, সালমান শাহ আত্মহত্যা করে মরেননি। পরিকল্পিতভাবে তাঁকে খুন করা হয়েছে। প্রথম আলোকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ নিয়ে কথা বলেন। নীলা চৌধুরী বলেন, সালমান শাহ যেদিন মারা যান, সেদিন সকাল নয়টায় তাঁকে দেখতে বাসায় গিয়েছিলেন সালমানের বাবা কমরউদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী। বাসার গেট থেকে সালমানের স্ত্রী সামিরা আমার স্বামীকে বলেছিলেন, ‘সালমান টায়ার্ড, ঘুমাচ্ছে। তাকে ডাকা যাবে না।’ তখন তিনি আমাদের গ্রিন রোডের বাসায় চলে আসেন। এর দুই ঘণ্টা পর সালমানের বাসা থেকে এক ব্যক্তি টেলিফোন করে বলে, ‘সালমানের কী যেন হয়েছে। আপনারা আসেন।’
সালমানের মা আরও বলেন, সঙ্গে সঙ্গে ওই বাসায় গিয়ে দেখি, তাঁর নিজ রুমে সালমানের নিথর দেহ পড়ে আছে। পাশে তাঁর স্ত্রী। যখন বলছিলাম, “ওকে হাসপাতালে নিতে হবে।” তখন সামিরা চিৎকার করে আমাকে বলল, “গেট আউট ফ্রম হাউস।” এরপর সালমানকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলাম কিন্তু তার স্ত্রী কখনো আসেনি।’
তদন্ত প্রসঙ্গে নীলা চৌধুরী বলেন, ঠিকমতো তদন্ত হয়নি। হলে বেরিয়ে আসত, ‘সালমান আত্মহত্যা করেনি। পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে।’ প্রসঙ্গক্রমে ‘শাবনূর-সামিরা দুজনের আচরণ রহস্যজনক’ বলে মন্তব্য করেন নীলা চৌধুরী। নায়ক সালমান শাহ মারা যাওয়ার পর শাবনূর কোনো দিন সালমান শাহর মায়ের সঙ্গে দেখা না করার বিষয়টি নীলা চৌধুরীকে পীড়া দেয় বলে জানান তিনি। এ বিষয়ে নীলা চৌধুরী বলেন, ‘একটা মানুষ মারা গেলেও বন্ধুবান্ধব–শুভাকাঙ্ক্ষীরা শেষবিদায়ে আসে। কিন্তু শাবনূর আসে নাই। অথচ আমার সালমানের সবচেয়ে বেশি স্নেহের ছিল সে। দেশের বাইরে গেলেও সালমান শাহ তার জন্য অনেক কিছু কিনে আনত। এখন ইমনকে ঘিরে যে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে পিবিআই প্রতিবেদন রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, সেটা নিয়ে চুপ কেন শাবনূর। সে কেন প্রতিবাদ করে লিখিতভাবে কিছু বলছে না। কেন বলছে না এটা মিথ্যা, এটা ষড়যন্ত্র। শাবনূরের এত ভয় কিসের। কেন ভয়ে পালিয়ে আছে এত দিন। তার কারণ ইমন যে হত্যার শিকার হবে, শাবনূর সবই জানত। সে জেনেও আমাদের কিছু জানায়নি। আমার রাগটা এখানেই। ইমন মারা যাবার পর সেই সামিরার সঙ্গে শাবনূরের দোস্তি হয়ে গেল। তারা বান্ধবী। যদি প্রেম থাকত, তাহলে শাবনূর সামিরার বান্ধবী হলো কী করে?’ নীলা চৌধুরী আরও বলেন, ‘ইমন (সালমান) মারা যাবার পর সামিরার সঙ্গে শাবনূরের সম্পর্ক আরও ভালো হলো। তারা বান্ধবী হয়ে গেল। এটা কোন ধরনের বন্ধুত্ব হলো? এখন বেহুদা শাবনূর আমার ছেলের ওপর কলঙ্ক দিচ্ছে।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে নীলা চৌধুরী বলেন, ‘সামিরা আমার ছেলেকে সবচেয়ে বেশি টর্চার করেছে। ২৪ বছর ধরে সামিরাও আমার সঙ্গে কথা বলে না, তার কারণ সে ফেঁসে যাবে। এখন ন্যাকামি করে। আগে নাম ধরে বলত নীলা চৌধুরী, এখন বলে আমার আগের শাশুড়ি, ইমনের মা, ইমনের আম্মা। এত ভালোবাসা হঠাৎ কোথা থেকে আসে।’
(প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে)