প্রকাশ: ১৭ আগস্ট, ২০২৫

কুরবানি ঈদের দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো জমে উঠেনি নাটকপাড়া। ঈদনাটক নিয়ে তারকাশিল্পীদের যে ব্যস্ততা ছিল সেটা এখন একেবারেই কম। বলা যায়, ঈদ পরবর্তী নাটকের শুটিংয়ে এখনো গতি ফেরেনি। কমে গেছে নির্মাণ। বেকার সময় পার করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়াও পার্শ্বচরিত্রের অনেকেই কাজ না পেয়ে, কঠিন সময় পার করছেন বলেও জানিয়েছেন। হাতেগোনা কয়েকজন তারকাশিল্পী ছাড়া অধিকাংশ শিল্পীই অলস সময় কাটাচ্ছেন। কিন্তু হঠাৎ করেই কেন কমে গেছে নাটক নির্মাণ? বিস্তারিত রয়েছে এ প্রতিবেদনে।
কুরবানি ঈদের পর নাটকপাড়ায় এখনো শুরু হয়নি শুটিং ব্যস্ততা। শুটিংহাউজগুলোও বেশিরভাগ সময় খালি থাকছে। একইসঙ্গে শিল্পী থেকে শুরু করে নির্মাতা এবং প্রোডাকশন সংশ্লিষ্ট অনেকেই বেকার সময় পার করছেন। তারকাশিল্পীরা অধিক পারিশ্রমিক নিয়ে কাজ করার ফলে, তাদের আর্থিক সমস্যা হয়তো হচ্ছে না; তবে পার্শ্বচরিত্রের অনেকেই কাজ না থাকায় পড়েছেন আর্থিক সংকটে। এছাড়া কিছু কাজ হলেও, সেখানে চরিত্রের সংখ্যা কম থাকায় কাজ পাচ্ছেন না অনেকেই। এমন অভিযোগও সম্প্রতি করেছেন একাধিক শিল্পী। তারকাশিল্পীদের পারিশ্রমিক বৈষম্যের কারণেই ক্যারেক্টার আর্টিস্টের কাজ কমছে বলেও জানান অনেকে। এমন অভিযোগ করে সম্প্রতি বেশ কয়েকজন অভিনয়শিল্পী সামাজিক মাধ্যমে মুখ খুলেছেন। বিষয়টি নিয়ে মিডিয়াপাড়া বেশ সরগরম।
অবশ্য এ অভিযোগ নতুন নয়, দীর্ঘদিন ধরেই নাটকে এমন বৈষম্য বিরাজ করছে। তারকাশিল্পী বা নাটকের নায়ক-নায়িকার পারিশ্রমিক মাত্রাতিরিক্ত হওয়াতে নাটক নির্মাণেও অনেকেই পিছিয়ে যাচ্ছেন, এমন খবরও সংবাদ মাধ্যমে উঠে এসেছে। শিল্পীদের পারিশ্রমিক বাড়ানো নিয়েও অনেকেই কথা বললেও এর কোনো সুরাহা আসেনি। ভিউ-বাণিজ্যের দিক বিবেচনা করে অনেকেই বাড়িয়েছেন পারিশ্রমিক। আবার অনেক প্রযোজনা সংস্থাও সেসব শিল্পী নিয়েই কাজ করছেন। ফলে তাদেরকে বেশি টাকা দিতে গিয়ে কমিয়ে ফেলছেন অন্যান্য চরিত্র। তাতে করেই এখন নাটক হয়ে গেছে নায়ক-নায়িকানির্ভর। ৩-৪টি চরিত্রের মধ্যে এখন নাটকের গল্প বন্দি হয়ে গেছে। কিন্তু এসব অভিযোগের মধ্যেই নাটকপাড়ায় কাজ চলমান ছিল। কিন্তু গত কুরবানি ঈদের পর থেকেই নাটকের কাজে গতি ফিরেনি। এর কারণ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ব্যাখ্যা, জনপ্রিয় সব তারকা এখনো নিয়মিত কাজে ফিরেননি। অনেকেই এখনো বিরতি কাটাচ্ছেন, কেউ কেউ রয়েছেন বিদেশে, কেউবা দেশেই বিশ্রাম নিচ্ছেন। এ কারণেই ঈদের পর নাটক নির্মাণে গতি ফেরেনি।
নাটকের জনপ্রিয় অভিনেতা জিয়াউল ফারুক অপূর্ব সাত মাস পর সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন। জোভান এখনো দেশের বাইরে রয়েছেন। দর্শকপ্রিয় অভিনেতা তৌসিফ মাহবুব এখনো কাজে নিয়মিত হননি। জনপ্রিয় জুটি নিলয় আলমগীর এবং জান্নাতুল সুমাইয়া হিমিও এখন দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তবে নাটকের জনপ্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিম কিন্তু ঈদের পরপরই অভিনয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অভিনেত্রী তানিয়া বৃষ্টির সঙ্গে জুটি বেঁধে একাধিক নাটকের কাজ করেছেন। আরও কয়েকজন অবশ্য কাজ করছেন, তবে সেটা সংখ্যায় একেবারেই কম। অন্যান্য তারকাশিল্পীর অনেকেই দেশের বাইরে রয়েছেন, আবার কেউ কেউ সম্প্রতি দেশে ফিরছেন, কিন্তু শুটিংয়ে ফিরেননি। তাহলে কি অভিনয়শিল্পী সংকটে নির্মাণ কাজ থেমে গেছে?
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিষয়টি অনেকটা এরকমই। তবে এটিকে সংকট বলতে নারাজ তারা। অভিনয়শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ মামুন অপু বলেন, ‘ঈদ পরবর্তী সময়টা একটু খারাপ যায়, কাজ কম হয়। সবাই টানা ঈদের কাজ করে একটু ছুটি কাটায়। তবে সময়টা সত্যিই একটু খারাপ যাচ্ছে। কিন্তু এ অবস্থা প্রতিবার ইন্ডাস্ট্রি কাটিয়ে ওঠে, এবার কতটা কাটিয়ে উঠতে পারবে সেটা বলা যাচ্ছে না।’ ইন্ডাস্ট্রির খারাপ অবস্থায় আছে বা সংকটাপন্ন এমনটা মানতে নারাজ কেউ কেউ। কারও কারও মতে, সরকারের পট পরিবর্তনের বিষয়টিও নাটক নির্মাণ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। তাদের মতে, দেশে ১৭ বছর পর সরকার পরিবর্তন হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে। সব সেক্টরের মতো সংস্কৃতি অঙ্গনেও বিগত সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগ করত। সেটা বন্ধ হওয়ায় কিছুটা কাজ কমেছে। এ পরিস্থিতিতে ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। তবে শিগগিরই এই অচলাবস্থা কেটে যাবে বলেও তাদের বিশ্বাস।
এদিকে স্পন্সর সংকটও নাটক নির্মাণ কমে যাওয়ার আরও একটি কারণ বলে অনেকে উল্লেখ করেছেন। এটিও ঘটেছে জুলাইবিপ্লব পরবর্তী সময়ে। তবে একটা সময় পর দুই ঈদ ও ভালোবাসা দিবসকে কেন্দ্র করে কিছুটা জমে উঠেছিল নাটকপাড়া। নির্মিত হয়েছে অনেক নাটক। যদিও আবার এরমধ্যে কিছু নাটক স্পন্সর জটিলতায় আটকে গেছে, সঠিক সময়ে মুক্তি পায়নি। আন্দোলনপরবর্তী খরা কাটিয়ে উঠেছে এ শিল্প, এমনটাই দাবি করছেন অনেকে। তবে এখনো যে একেবারে স্বাভাবিক, এটিও বলা যাবে না এমনটাও বলছেন কেউ কেউ। এখনো নাটকে রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাব রয়েছে। কাজের পরিমাণ কমে যাওয়ার এটিও একটি কারণ। বিষয়টি নিয়ে নাট্যপরিচালক ইমরাউল রাফাত গণমাধ্যমে বলেন, ‘এখন কাজের পরিমাণ কমে গেছে এটা সত্য। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এখন আর উৎসবের বাইরে সেভাবে ফিকশন নির্মাণ করছে না। কিছু ধারাবাহিক চললেও একক নাটক হচ্ছে না। এ ছাড়া ইউটিউব এবং ফেসবুক রেভিনিউ কমিয়ে দেওয়ার পর প্রযোজকরাও এখন আর আগের মতো প্রডাকশন করার সাহস পাচ্ছেন না। যার কারণে কাজ কমে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই শিল্পী-নির্মাতারা সংকট অনুভব করছেন।’
নাটকের সুসময়ে শুটিং হাউজগুলোও বছরজুড়ে ব্যস্ত থাকত। এখন মাসে দশদিনও শুটিং হচ্ছে না কোনো কোনো হাউজে। এ বিষয়ে শুটিং হাউজ অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, ‘এখন কাজ কমে গেছে। আমাদের এখানে আগে মাসের ২৫ দিন শুটিং হতো। এখন মাসে দশ থেকে বারো দিন শুটিং হয়। প্রতি মাসেই হাউজ মালিকদের লোকসান গুনতে হচ্ছে।’
রাজধানীর উত্তরায় লাবণী-৪ শুটিং হাউজের মালিক আসলাম হোসেন বলেন, ‘ঈদের পর এখনো কাজ শুরু হয়নি সেভাবে। অনেক শিল্পীই এখন ছুটিতে আছেন। তাই কাজ একটু কম হচ্ছে। গত মাসেও ১২/১৩ দিন হাউজ ভাড়া পেয়েছি। বলা যায়, লসেই হাউজ চালিয়েছি। এ ছাড়াও গত বছর থেকেই কাজের পরিমাণ কিছুটা কমেছে। নির্বাচন পর্যন্ত এভাবেই চলবে বলেই মনে হচ্ছে।’ এদিকে বাংলাদেশ প্রোডাকশন ম্যানেজার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আবু জাফর অপু বলেন, ‘নাটক ইন্ডাস্ট্রিতে সবচেয়ে অবহেলিত হচ্ছি আমরা। আমাদের সদস্য সংখ্যা সাত শতাধিক। অথচ মাত্র ৩০ জন কাজ করতে পারছেন নিয়মিত। কাজ না থাকায় অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। আমার অনেক প্রোডাকশন বয় এখন গ্রামে চলে গেছে। কেউ চায়ের দোকান দিচ্ছে, কেউ দিনমজুরের কাজ করছে।’
আরও পড়ুন