এখনও অনেক কিছু বাকি, সেটাই বাঁচিয়ে রাখে: প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশ: ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
অন্য সময় প্রাইম: প্রায় চার দশক লম্বা কেরিয়ার। এই সময়ে দাঁড়িয়ে একান্তে যখন আয়নার সামনে দাঁড়ান, নিজেকে কী বলেন?
প্রসেনজিৎ: সত্যি বলতে, দীর্ঘ ৪০-৪২ বছর ধরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সঙ্গে বলা কথাগুলো সময়ের সঙ্গে ক্রমশ বদলাতে থেকেছে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে নিজেকে যে প্রশ্নটা করি সেটা হলো, আর কী-কী চরিত্রায়ণ এখনও পর্যন্ত করে ওঠা হয়নি। একদিন জিৎ-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আর কী করা উচিত বল তো? খানিক ভেবে বলল ‘সবই তো টাচ করে গিয়েছো’। আর নিজেকে কী ভাবে ভাঙব, আর কোন কাজগুলো করব, এটাই আমাকে ভাবায়। বারবার একটাই উত্তর ফিরে-ফিরে আসে। মনে হয়, সমুদ্র থেকে একঘটি জল তুলতে পেরেছি। এখনও অনেক কিছু করা বাকি। সেটাই আমাকে বাঁচিয়ে রাখে।
অন্য সময় প্রাইম: ‘দেবী চৌধুরানী’ সিনেমায় ভবানী পাঠকের চরিত্রে অভিনয় কি সেই বৃত্ত পূরণের চেষ্টা?
প্রসেনজিৎ: একদমই তাই। কখনও বঙ্কিমবাবুর (চট্টোপাধ্যায়) কোনও উপন্যাসের ভিত্তিতে তৈরি সিনেমায় কাজ করিনি। আর কী করা বাকির তালিকায় এই অসম্পূর্ণ অংশটা ছিল। সেটাই সিনেমা করার জন্য রাজি হওয়ার প্রথম কারণ। দ্বিতীয়ত, ভবানী পাঠকের চরিত্র। গত দেড় দশকে লালন, নেতাজি, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির চরিত্রে কাজ করেছি। সাধক, যোদ্ধার পাশাপাশি যিনি ইতিহাসের দলিল হয়ে আছেন, এমন একজনের চরিত্রে কাজের সুযোগ উৎসাহিত করেছিল।
অন্য সময় প্রাইম: এমন চরিত্রের জন্য ঠিক কী আলাদা রকমের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?
প্রসেনজিৎ: এমন চরিত্রে হঠাৎ করে পরের দিন থেকেই কাজ করা যায় না। সেই প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময় দিতে হয়। প্রথমত লাগে মানসিক ভাবে শান্ত একটা ভাব। দ্বিতীয়ত শারীরিক প্রস্তুতি। অভিনেতা হিসেবে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ, সারা পৃথিবী ভুলে গিয়ে নিজেকে যে কোনও চরিত্রের সঙ্গে আত্মস্থ করে তোলা। সেটা করতে খানিক সময় লাগে। তবে গোটা প্রসেসটা সুবিধে হয়েছে, লালন চরিত্রে কাজ করার সুবাদে। এই ধরনের প্রস্তুতিপর্বে আমি সবকিছু থেকে খানিকটা আলাদা হয়ে যাই। বলতে পারেন, নিজের একটা জগৎ তৈরি করে নিই।
অন্য সময় প্রাইম: সামনেই পুজো, ছোটবেলার কোন নস্ট্যালজিয়া এখনও মনে পড়ে?
প্রসেনজিৎ: আমার দাদামশাই খুব বড় করে পুজোর আয়োজন করতেন। সেই পুজোতে একসঙ্গে সবাই মিলে আনন্দ করা, সবার সঙ্গে খাওয়াদাওয়া মিলিয়ে দারুণ একটা সময় কাটত। পুজোর ক’টা দিনে গোটা পরিবার একসঙ্গে হতো। এখন পুজোর সময়ে কাজের অনেক ব্যস্ততা থাকে। তবে ভোগ খাওয়াটা কোনও ভাবেই মিস করি না।
অন্য সময় প্রাইম: এ বারে পুজোয় একসঙ্গে চারটে বাংলা ছবি রিলিজ় করবে, সেটা কি সিনেমাগুলোর বক্স অফিস কালেকশনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে?
প্রসেনজিৎ: পুজোর সময়ে বাইরের কোনও ছবি থাকে না, তাই বাংলা ছবির বক্স অফিস ফলাফল এমনিতেই ভালো হয়। ওই সময়ে উৎসবের মেজাজে মানুষ অনেক বেশি করে ছবি দেখেন। আর পুরো ব্যবসাটাই বাংলা সিনেমার বক্স অফিস ফলাফল। এই ব্যবসার জেরে তো ইন্ডাস্ট্রিটাই এগোবে।
এখন অনেকে লড়ালড়ির কথা বলেন, এক সময়ে পুজোয় আমার তিনটে ছবি রিলিজ় করেছে, যার মধ্যে দুটো গোল্ডেন জুবিলি ছিল। এ রকম বহুবার হয়েছে। তখন তো যেন বক্স অফিসে আমিই আমার বিরোধিতা করছি। এখন আমি ভালো কাজ করার জন্যই সিনেমা করি, ওয়ান-টু-থ্রি হওয়ার রেসের অঙ্গ অনেক দিনই আর হতে চাই না। কারণ, চল্লিশ বছরের বেশি কেরিয়ারে প্রায় ৩৫ বছর আমার ছবি পুজোতে রিলিজ় করছে। বিশেষ করে ‘অটোগ্রাফ’-এর পর থেকে।
অন্য সময় প্রাইম: এত দীর্ঘ যাত্রাপথের মাঝে ক্লান্তি বোধ করেননি? নিজেকে মোটিভেট করেন কী ভাবে?
প্রসেনজিৎ: সব সময়ে অডিয়েন্সই আমার মোটিভেশন। রোজ সকালে উঠে নিজেকে বলি, যে কোনও প্রজন্মের নতুন একজনকে যেন আজ আমার অনুরাগী তৈরি করতে পারি। একটা ঘটনা বলি, মুম্বইয়ে থাকলে আমি একবার মিস্টার বচ্চনের (অমিতাভ) সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করি। আমার নতুন যে কোনও কাজ ওঁকে দেখাই, সেটা দেখে উনি শুভেচ্ছা জানান। সেবার সৃজিতও (মুখোপাধ্যায়) ছিল আমার সঙ্গে। উনি ট্রেলার দেখে সৃজিতকে বললেন, ‘আই অ্যাম অমিতাভ বচ্চন, ইউ ক্যান থিঙ্ক অফ আ গুড ক্যারেক্টার ফর মি’। ওঁর মতো একজন অভিনেতা কাজের কথা বলছেন! এই যে কাজের খিদেটা, সেটা আমিও অনুভব করি। সঙ্গে দর্শকদের নতুন কিছু উপহার দেওয়ার চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসি। যে কারণে আমার ‘কাকাবাবু’-র মতো কাজ করা। যাতে বাচ্চারা না বলে ‘আমার মা আপনার ফ্যান’, বরং আমার কাছে জানতে চায় ‘তোমার ক্র্যাচটা কোথায়’?
অন্য সময় প্রাইম: বাংলার যে যুবক প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তাঁকে কী বার্তা দিতে চান?
প্রসেনজিৎ: আমি কোনও এলিয়েন জগৎ থেকে আসিনি। বাকি পাঁচজনের মতোই ধাপে-ধাপে নিজের জায়গা তৈরি করেছি। হ্যাঁ, জায়গা তৈরি করতে অনেক কষ্ট করতে হয়। তাই বলতে চাইব, এটা অস্বাভাবিক কোনও কাজ নয়। এমনকী প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের থেকে বেটার হওয়াটাও সম্ভব। বরং সেটা হওয়ারই চেষ্টা করা উচিত। বড় লক্ষ্য নিয়ে লড়াই চালালে সেই জায়গাটা না হলেও তার কাছাকাছি পৌঁছনো সম্ভব। তাই লক্ষ্যটা বড় হওয়া দরকার।
আরও পড়ুন