Advertisement

নারায়ণগঞ্জের এই বাড়ি স্থাপত্যের মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারে স্বর্ণপদক জিতেছে

প্রথম আলো

প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

চার বিঘা জমির ওপর তৈরি হয়েছে বাড়িটিছবি: মারুফ রায়হান
চার বিঘা জমির ওপর তৈরি হয়েছে বাড়িটিছবি: মারুফ রায়হান

বাড়ির প্রবেশমুখেই লোহার বিশাল একটি দরজা। সেটি পেরোলেই চোখে পড়ে কংক্রিটের কয়েকটি দেয়াল। সীমানাপ্রাচীর হিসেবে ব্যবহার করা এই দেয়ালগুলো যেন একেকটি ক্যানভাস। তাতে নানা গাছ, লতাপাতা ছাড়াও খোদাই করে লেখা, ‘দেয়ালবয়ান’। তাই দেয়ালগুলো শুধু দেখার নয়, পড়ারও। এই যেমন ‘সুখ-দুঃখের মাঝখানে ফাঁদ-বাস্তবতার নিয়মিত স্বাদ’। আমাদের সঙ্গে আসা কেউ কেউ দেয়ালগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে লেখাগুলো পড়তে শুরু করলেন। কেউবা বাক্যের মানে বোঝার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ আবার কথাগুলোর মানে নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন। এভাবে কংক্রিটের বাড়িটি যেন মানুষের সঙ্গে কথা বলছে অবিরাম।

বাড়ির মূল আঙিনায় উঠতেই পেভমেন্টের কংক্রিট স্ল্যাবে আটকে যায় চোখ! সবুজ পাতা ছড়ানো পথের মাঝখানে কংক্রিট স্ল্যাবে বিভিন্ন আকারের পাতার ছাপ! ঢালাইয়ের সময়ই স্ল্যাবগুলোতে আশপাশের গাছগাছালির পাতা দিয়ে ছাপগুলো তৈরি করা হয়েছে।

সদর দরজা একটি হলেও বিভিন্ন দিক থেকে দোতলা বাড়িটির ভেতর-বাহির করা যায়। কোথাও হয়তো দোতলার শয়নকক্ষ থেকে উঁচু টিলা ধরে বাড়ির সামনের বিশাল সবুজে নেমে আসা যায়। কোথাও আবার সরু হাঁটাপথ আপনাকে নিয়ে যাবে প্রশস্ত পুকুরপাড়ে, কোথাও–বা বড় বড় ধাপে সবুজে গিয়ে মিলেছে সিঁড়ি।

ঢাকার অদূরেই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার বিরাব বাজার, পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে শীতলক্ষ্যা। সেখানেই চার বিঘা জমির ওপর গড়ে উঠেছে এই বাড়ি, নাম ‘চাবি’। পারিবারিক বাড়িটিকে বলা হচ্ছে ‘বিকল্প গন্তব্য’। ইচ্ছা হলে যে গন্তব্যে গিয়ে কাটিয়ে আসা যায় একান্তে কিছু সময়। আবার দল বেঁধে হইহুল্লোড় করার জন্যও মিলবে সুবিশাল প্রান্তর। এ যেন একের ভেতরে অনেক—পুকুর, টিলা ও জলাধার মিলেমিশে একাকার!

বাড়িটির মালিক এ টি এম মাহবুবুল আলম চৌধুরী ও তাঁর সহধর্মিণী নাসিমা আফরোজ চৌধুরীর নিমন্ত্রণে বাড়িতে আসা। সঙ্গে আছেন প্রকল্পটির স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝরসহ কয়েকজন।

প্রকল্পটির নাম কেন ‘চাবি’, জানতে চাইলে স্থপতি বলেন, ‘চাবি বললেই মনে হয় তালা-চাবি! কিন্তু এই শব্দের আরেকটি মানেও তো হয়, আমি যেন কোনো একটি জায়গায় গিয়ে কাউকে কিছু চাইতে বলছি। এই চাবি কথাটার মধ্যে আবার একটা অধিকারও আছে—চাবি তবে পাবি!’

যেখানে পদে পদে প্রশ্ন আসবে, যেখানে জানার ইচ্ছা থাকবে, তেমন কিছুই করতে চেয়েছিলেন স্থপতি নির্ঝর। আর তাঁর এই চাওয়ায় সায় দিয়েছিলেন মাহবুবুল–নাসিমা দম্পতি।

পুরো বাড়িতে স্থায়ী বাসিন্দা মোট চারজন। মাহবুব-নাসিমা দম্পতি ও তাঁদের দুই ছেলে-মেয়ে। চারজনের হিসাবে বাড়িটা বেশ বড়। সে কারণে বাড়িটিকে এমনভাবে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে যে চাইলেই এক বা একাধিক ভাগ বন্ধ করে রাখা যায়। তাই ঘরের একটি অংশ বাহির পরিসর, অন্যটি পারিবারিক পরিসর। দুই পরিসরের মাঝামাঝি একটি করিডর। আদতে যা সেতুর মতো কাজ করে।

মূল বাড়িতে ঢুকতেই সদর দরজার সামনে বসার জায়গা। চাইলে এখানে একটু জিরিয়ে নিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারেন। সদর দরজা পেরিয়ে বিশাল বসার ঘর, যার একদিকে জলাধার, অন্যদিকে সবুজ প্রান্তর। সোজা চলে এলে খাবার ঘর, কিছু অনাড়ম্বর বসার জায়গা। এই বসার জায়গাগুলোয় দুজন করে বসতে পারেন। কোনোটায় মুখোমুখি, কোনোটায় পাশাপাশি, কোনোটায় আবার পিঠাপিঠি।

বসার ঘর ও খাবার ঘরের মাঝখানে ‘স্মৃতি ফাঁদ’! ম্যাট টাইলসের মেঝের মধে৵ কাচের বাক্সে রাখা পুরোনো রেডিও, সুরমাদানি, স্টেথোস্কোপ। বাড়ির পূর্বপুরুষদের ব্যবহৃত নানা জিনিস পরম যত্নে এখানে সাজিয়ে রাখা আছে। অনেকটা জাদুঘরের মতো। স্পটলাইটে জ্বলজ্বল করছে অতীত। মেঝের নিচেই ছোট বাক্স করে এভাবে স্মারকঘর তৈরির বিষয়ে স্থপতি বলেন, ‘বাড়ির যে সদস্যরা আর নেই, তাঁদের স্মৃতিটা প্রত্নসামগ্রীর মতো। এসব জিনিস অনেকে শোকেসে রাখেন, পরিষ্কার করেন, স্পর্শ করেন। আমরা সেটিকে মেঝের নিচে রেখেছি। চাইলেই কেউ ধরতে পারবেন না। এটা আসলে স্মৃতি প্রত্নতত্ত্ব। অনেক প্রজন্ম পরে গিয়ে হয়তো তারা দেখবে, তাদের পূর্বপুরুষদের আসলে কী কী ছিল!’

এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সম্পর্কের বাঁধনটিকে উদ্‌যাপন করতে চেয়েছেন স্থপতি।

আর্ক এশিয়া স্থাপত্য পুরস্কারে স্বর্ণপদক পাওয়া ভীষণ আনন্দের ব্যাপার। স্বাধীনভাবে নিজের চিন্তা নিয়ে একটি কাজ করেছি, সেটি পুরস্কৃত হয়েছে, প্রশংসা পাচ্ছে। এই প্রকল্পে ‘ফর্ম ফলোজ ফাংশন’ না হয়ে ‘ফর্ম ফলোজ ফিকশন’ ব্যাপারটি ঘটেছে। মানুষের অনুভূতির সঙ্গে কীভাবে একটি স্থাপত্যকে মিশিয়ে দেওয়া যায়, সেই চেষ্টা করেছি। মনে হচ্ছে, তাতে অনেকটাই সফল হয়েছি। চিন্তাটা গ্রহণযোগ্য হয়েছে, পুরস্কার পেয়েছি। আমি ক্লায়েন্টের প্রতি কৃতজ্ঞ, তাঁরা আমাকে চিন্তার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।
এনামুল করিম নির্ঝর, স্থপতি

বসার ঘর আর খাবার ঘরের পাশে আকাশখোলা জলাধার, তার মাঝখানে একটি গাছ, পাশ দিয়ে উঠে গেছে মেহগনি কাঠের সিঁড়ি। পুরো বাড়িতে এমন সিঁড়ি আছে একাধিক। কোনো সিঁড়ির নাম ‘জানা সিঁড়ি’ তো কোনোটার ‘টানা সিঁড়ি’। জানা সিঁড়িটা উঠে গেছে থেমে থেমে, নিয়মিত সিঁড়িগুলোর মতো। আর টানা সিঁড়িটা সোজা গন্তব্যে নিয়ে যায়।

বাড়ির এই প্রথম অংশে জলাধারের পাশেই রয়েছে অতিথিকক্ষ, রান্নাঘর, গৃহকর্মীদের ঘর, নিচের রান্নাঘর থেকে ওপর তলার রান্নাঘরে যাওয়ার সার্ভিস সিঁড়ি।

খাবার ঘর পেরিয়ে বাড়ির দ্বিতীয় অংশে যেতে পড়বে লম্বা একটি করিডর। যার একদিকে সুইমিংপুল, অন্যদিকটায় আরেকটি জলাধার। তার পাশ দিয়ে উঠে গেছে দ্বিতীয় তলার পারিবারিক আঙিনায় চলে যাওয়ার আরেকটি সিঁড়ি। সুইমিংপুল পেরিয়েই বারচেয়ারসহ ছোট্ট একটা রান্নাঘর, হোমথিয়েটার, জিম, টেবিল টেনিস খেলার জায়গা আর বাড়ির শেষ প্রান্তে পুকুরপাড়।

এই পারিবারিক বসার ঘর দিয়েই পারিবারিক আঙিনার শুরু। এই বসার ঘরের পাশেই আকাশখোলা কাঠের পাটাতন। জায়গাটার নাম ‘ঠিকানা ডেস্ক’! এখানে কলরেডি মাইকসহ একটি মঞ্চ রয়েছে। বাড়ির কেউ যদি সবাইকে কিছু জানাতে চান, তবে চলে আসতে পারেন এই মঞ্চে। কিংবা একাকী নিজের মনে আবৃত্তি করতে পারেন দুই লাইন কবিতা বা গুনগুন করতে পারেন প্রিয় কোনো গানের পঙ্‌ক্তি। শ্রোতা থাকুক বা না থাকুক।

বাড়িজুড়েই খণ্ড খণ্ড সবুজ, আকাশখোলা জলাধার; বাড়ির অন্দরেও আছে রোদ, বৃষ্টি, ঝড় ও দখিনা হাওয়ার মতো প্রাকৃতিক উপাদানকে স্বাগত জানানোর ব্যবস্থা। তাই বলে অন্দরের গোপনীয়তা যে নষ্ট হয়েছে, তা কিন্তু নয়। পারিবারিক বসার ঘরটি পেরিয়ে এলেই সরু একটি করিডর। করিডরের মুখেই নেমে গেছে একখানা সিঁড়ি। সেটি পেরোলেই তিনটি শোবার ঘর। একটিতে থাকেন চৌধুরী দম্পতি, অন্য দুটিতে দুই ছেলে-মেয়ে।

ব্যক্তিগত পরিসর বজায় রেখেও একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগের স্থান যেন এই সরু করিডর। করিডরে ছেলেমেয়েরা হেঁটে যাচ্ছে কিংবা পায়চারি করছেন বাবা; অথবা শোনা যাচ্ছে মায়ের হাতের চুড়ির রিনঝিন—যে যার নিজের ঘর থেকেই এই ছোট বিষয়গুলো টের পাবেন। এ বিষয়ে স্থপতি বলেন, ‘কেউ যখন লম্বা করিডরের এ পাশে, তখন তো সে ওই পাশে কী হচ্ছে দেখতে পাচ্ছে না। তখন একজন হয়তো ছুটে গিয়ে দেখবে কে যায়। এই যে মুখোমুখি হওয়া, দেখা হওয়া—এটা তো সব খোলামেলা রাখলে সম্ভব হতো না। তখন এক রুম থেকে বসেই দেখা যেত। উঠে গিয়ে এই যে যোগাযোগ, এটাই তো চাই।’

পুরো বাড়িতে পাঁচটি স্নানঘর রয়েছে। সেই স্নানঘরেও আছে প্রকৃতির স্পর্শ। স্নানঘরের একটি অংশ রাখা হয়েছে খোলা আকাশের নিচে। এতে দিনের আলো যেমন স্নানঘরে এসে ঢুকেছে, তেমনি আসতে পারে রাতের জ্যোৎস্না, বৃষ্টির জল! তবে পোকামাকড় ঘরে আসা ঠেকাতে রাখা হয়েছে নেটের ব্যবস্থা।

বাড়িটির পরিকল্পনা করার সময় ছয় ঋতুর কথা মাথায় রেখে ল্যান্ডস্কেপ করেছিলেন স্থপতি এনামুল করিম। বাড়িটা ঘুরে দেখতে দেখতে মনে হলো, এই বাড়িতে এলে কারও মন খারাপ হবে, কারও আনন্দ হবে, কেউ অবাক হবেন। এই যে একেকজনের অনুভূতির দরজায় একেকভাবে টোকা দেওয়া, কংক্রিটের একটি স্থাপনার কাছ থেকে এর বেশি আর কী চাইতে পারি আমরা! ভাবনার বন্ধ ঘরের তালা খুলতে এর চেয়ে চমৎকার চাবি আর কী হতে পারে!

Lading . . .