ধানমন্ডির এই বাড়িতে আছে মাটির দেয়ালে গড়া ‘কাচারিঘর’, গল্প–আড্ডার ‘আলসে ঘর’
প্রকাশ: ৬ আগস্ট, ২০২৫

মূল গেট পেরোতেই নাকে এল রং-বার্নিশের গন্ধ। ভেতরে কোথাও রং চড়ানো হচ্ছে, কোথাও চলছে ধোয়ামোছার কাজ। এত সব তোড়জোড়ের কারণও আছে, এক দিন পরই যে ‘স্বপ্নপূরণের উৎসব’, মালিকদের হাতে ফ্ল্যাটের চাবি তুলে দেওয়ার আয়োজন। প্রায় ১০০ ফুট লম্বা লবির বাঁয়ে ভূগর্ভস্থ পার্কিংয়ের পথ, কিছুটা হাঁটলে ডান পাশে টবে টবে নানা জাতের গাছ। আর বাঁয়ে বসার কক্ষ, নাম ‘কাচারিঘর’।
৩০ জুলাই রাজধানীর ধানমন্ডির ৬/এ সড়কের ৬৯/ই নম্বরের এ অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সটিতে আসার আগেই অবশ্য এসব সম্পর্কে কিছুটা জেনে এসেছি। ১৮ ফ্ল্যাটের ১০ তলা এ ভবনের নাম ‘বিডিডিএল পিস পার্ক’। আবাসন কোম্পানি বিডিডিএল প্রোপার্টিজ লিমিটেডের গড়া ভবনটির স্থাপত্য নকশাসহ ব্যবহার্য উপকরণের সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ বাতেন খান।
কাচারিঘর সম্পর্কে যেমন বলেছেন, ‘আগের দিনে সামর্থ্যবানদের বাড়িতে কাচারিঘর থাকত। অতিথি বসত, গল্প করত, আড্ডা হতো। দূরের কেউ এলে সেখানে থাকতেও পারত। আমরা এই বসার জায়গাটাকে পরিবেশবান্ধব উপকরণ দিয়ে তৈরি করেছি। কাচারিঘরের দেয়াল মাটির, দরজা কাঠের আর বেঞ্চগুলো পুনর্ব্যবহৃত কাঠ দিয়ে তৈরি হয়েছে। ভেতরে রাখা হয়েছে ছোট ছোট গাছ।’
কাচারিঘর থেকে বের হয়ে সামনের দিকে গেলেই দুটি লিফট। আরেকটু সামনের ঘরটা সেখান থেকেই চোখে পড়ে। নাম ‘বই সারা বেলা’। সিঁড়ির পাশের এ জায়গাকে পাঠাগারে পরিণত করা হয়েছে। এখানে থাকবে সব বয়সীদের পড়ার উপযোগী বই। শিশুরাও যেন আনন্দ নিয়ে পড়তে পারে, সে জন্য রংতুলিতে এটিকে রাঙানোও হয়েছে। আর কিছুদিন পরই বইয়ে বইয়ে ভরে উঠবে ফাঁকা তাক।
বিডিডিএলের উপব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মাহিনুল আলমকে অনুসরণ করে লিফটে গিয়ে উঠি। নতুন লিফটের গা থেকে তখনো পলিথিন-কাগজ তোলা হয়নি। দশম তলায় গিয়ে নামি আমরা। সামনের দেয়ালে নজরকাড়া চিত্রকর্ম। পাশেই দরজা। তাতে লেখা ‘ত্রিমাত্রিক ঘর’। ভেতরে ঢুকে দেখি, খোলামেলা ঘরটায় গোছগাছ চলছে। এখানে ব্যায়ামাগার, নামাজের জায়গাসহ বাসিন্দাদের ছোটখাটো অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। এই তিন সুবিধার কারণেই ঘরের নাম ত্রিমাত্রিক।
এখন থেকে সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠি। ছাদের চারপাশ ঘিরে টব, তাতে ফুল ও নানা ভেষজ গাছের চারা। রঙের বালতি পাট দিয়ে মুড়িয়ে বানানো হয়েছে এসব টব। ব্ল্যাক জিঞ্জার, আমেরিকান লেমন গ্রাসসহ নানা জাতের গাছ। আছে ১০ রকমের ভেষজ চা।
ছাদে একেবারে পূর্ব দিকের কাঠামোটা দেখে মনে হলো, লন্ডনের ঐতিহ্যবাহী লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড থেকে অনুপ্রাণিত। এ জায়গার নাম ‘আলসে ঘর’। এই আলসে ঘরে একটি চিত্রকর্ম আছে। তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে থ্রি–ডি ফটো বুথ। সেখানে ছবি তুলে মনে হলো, চিত্রকর্মের মধ্যে ঝুলছে ফ্রেমে বাঁধা কোনো ছবি। আলসে ঘরটা উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। এখানে রাতে বসে চাঁদের আলোয় ডুব দেওয়ার সুযোগ যেমন মিলবে, তেমনি বৃষ্টি বা কড়া রোদে মিলবে আশ্রয়।
বিডিডিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘বিল্ডিং মানে শুধু ইট-সিমেন্টের কাঠামো নয়। বাসিন্দাদের জন্য আমরা এখানে আনন্দ করার জায়গা তৈরি করেছি, গল্পের জায়গা রেখেছি, রেখেছি সাহিত্যচর্চার ব্যবস্থা। শুধু থাকার জন্য থাকা নয়, প্রাণভরে বাঁচার মতো করে যেন থাকতে পারে, তারই ব্যবস্থা করছি।’
প্রতিষ্ঠানটির উপদেষ্টা মামুনুর রহমান বলেন, ‘পিস পার্ক প্রকল্পে টেকসই স্থাপত্য ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা একসঙ্গে এসে মিলেছে। আমরা চাইলে শহরের মধ্যেই যে সবুজ আবাসন গড়ে তুলতে পারি, তা এখানকার প্রতিটি গাছ, প্রতিটি রিসাইক্লিং ড্রাম আর ছাদে লাগানো হারবাল চায়ের গাছগুলো শেখায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় আসলে এর বিকল্প নেই।’
বিডিডিএল পিস পার্ক তাই শুধু আবাসনের ‘স্বপ্নপূরণ’ নয়, এ যেন বসবাসের নতুন এক দর্শন, ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়া এক বাসযোগ্য পৃথিবীর প্রতিশ্রুতি।
৩১ জুলাই হয়ে গেল ‘বিডিডিএল পিস পার্ক’-এর দ্বারোদ্ঘাটন ‘স্বপ্নপূরণের উৎসব’। উৎসবে উপস্থিত ছিলেন ফ্ল্যাটমালিকসহ বিশিষ্টজনেরা। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ইউএনডিপির কর্মকর্তা কামালউদ্দিন, ফ্ল্যাটমালিক সমীর কুমার কুন্ডু, তিলোত্তমা বাংলা গ্রুপের জোয়ারদার নওশের আলী, অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ, পিকেএসএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল কাদের এবং জমির মালিক অধ্যাপক মো. আফজাল হোসেন।
বিডিডিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ বাতেন খান ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলেন, ‘এই প্রকল্প শুধু একটি বাড়ি নয়, এটি একটি স্বপ্নপূরণের প্রতীক। এখানে সবাই একসঙ্গে একটি বৃহৎ যৌথ পরিবারের মতো বসবাস করবেন—এ লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করেছি।’ তিনি আরও জানান, জাতীয় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট দলের অধিনায়ক লিটন দাসসহ অনেক বিশিষ্টজন এ ভবনের গর্বিত মালিক।
অনুষ্ঠানে একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে ভবন নির্মাণের প্রতিটি ধাপ তুলে ধরা হয়। ফ্ল্যাটমালিকদের নিয়ে গঠিত হয় ‘বিডিডিএল পিস পার্ক ফ্ল্যাটমালিক অ্যাসোসিয়েশন’। অতিথিরা পরে ছাদ ঘুরে দেখেন।
আরও পড়ুন