Advertisement

জমি নয়, নারায়ণগঞ্জে ফ্ল্যাট কেনায় ক্রেতাদের আগ্রহ বেশি

প্রথম আলো

প্রকাশ: ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

24obnd

আগে এই নগরীতে বহুতল ভবন তেমন একটা ছিল না। সময়ের পরিক্রমায় বহুতল ভবনের সংখ্যা বাড়ছে। আবাসনের চাহিদা মেটাতে গত ২০ বছরে রাজধানীর পাশের এ জেলায় সরকারি–বেসরকারি আবাসন খাতে গড়ে উঠেছে চার শতাধিক বহুতল ভবন। আবাসন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অর্ধশতাধিক রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠান।

আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় নতুন নতুন প্রকল্প নিয়ে বহুতল ভবন নির্মাণ করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। রূপায়নসহ স্বনামধন্য অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে অসংখ্য বহুতল ভবন। জমিতে নয়, নাগরিক সুযোগ-সুবিধার কারণে ফ্ল্যাট কেনায় আগ্রহী ক্রেতারা। বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১০০ থেকে শুরু করে ২ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট। প্রতি বর্গফুট পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা। ৯০ শতাংশ বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে শহরকেন্দ্রিক। ১০ শতাংশ বহুতল ভবন শহরতলির বাইরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের শিবু মার্কেট, জালকুড়ি, সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড ও বন্দর এলাকায় সম্প্রসারিত হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সালে শহরের বি বি রোডের উকিলপাড়া এলাকায় রিচম্যান প্রপার্টিজ লিমিটেডের মালিক সিদ্দিকুর রহমান ও প্রকৌশলী মো. রিপন ১০ তলা ‘সহিতুননেছা টাওয়ার’ তৈরি করে ফ্ল্যাট বিক্রি শুরু করেন। সে সময় তাঁরা প্রতি বর্গফুট ২ হাজার ২০০ টাকায় ফ্ল্যাট বিক্রি করেন। ২০০৬ সালে বি বি রোডে হক লিভিংয়ের মালিক শফি আহমেদ ‘হক প্লাজা’ নামে ১০ তলা বহুতল ভবন নির্মাণ করে আবাসন ব্যবসা শুরু করেন। তিনি ২ হাজার ৬০০ টাকা বর্গফুট ফ্ল্যাট বিক্রি করেছেন সে সময়। ২০০৮ সালের দিকে ‘রিলায়েন্স হাউজিং লিমিটেড’ শহরের জামতলায় ৯ তলা বহুতল ভবন দিয়ে ব্যবসা শুরু করে। ওই সময় তারা ৩ হাজার ৫০০ টাকা প্রতি বর্গফুটে ফ্ল্যাট বিক্রি করে। তারা চাষাঢ়ায় বেইলী টাওয়ার, থানা পুকুরপাড়ে আল জয়নাল প্লাজায় ফ্ল্যাট তৈরি করে বিক্রি করে।

বর্তমানে বি বি রোড ও জামতলা এলাকায় প্রতি বর্গফুট ছয়–সাত হাজার টাকায় ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে। এরপর অনেক প্রতিষ্ঠান আবাসন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনও নগরীর বিভিন্ন স্থানে বহুতল ভবন নির্মাণ করে ফ্ল্যাট বিক্রি করেছে। এ ছাড়া রাজধানীর স্বনামধন্য আবাসন প্রতিষ্ঠান রূপায়ন টাউন জামতলা ও ভুঁইগড়ে আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলেছে।

গত ২০ বছরে শহরের আল্লামা ইকবাল রোড, জামতলা, আমলপাড়া, চাষাঢ়া, মিশনপাড়া, ডন চেম্বার, কালির বাজার, সাইনবোর্ড, জালকুড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে চার শতাধিক বহুতল ভবন। আবাসন খাতের অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠানের ৮ থেকে ২২ তলা বহুতল ভবন রয়েছে। আরও নতুন নতুন ভবন গড়ে উঠছে।

নারায়ণগঞ্জ রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, আবাসন খাতে সদস্য প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩০। তাদের সদস্য ছাড়া আরও অনেক আবাসন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। চার শতাধিক বহুতল ভবনের মধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে ১০৫টি ভবনের ফ্ল্যাট। চলমান রয়েছে ১৫০টি প্রকল্প।

রিলায়েন্স হাউজিং লিমিটেড গত ১৭ বছরে নগরীতে ১০ তলা ১০টি ভবন নির্মাণের পর হস্তান্তর করেছে। আরও তিনটি প্রকল্প চলমান। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম পাভেল প্রথম আলো কে জানান, ‘আমাদের প্রকল্পগুলো যথাসময়ে শেষ করে হস্তান্তর করা হয়েছে। দিন দিন জনসংখ্যা বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে আবাসনের চাহিদা। আবাসনের সমস্যা দূর করতে হলে আমাদের ওপরের দিকে যেতে হবে।’

২০১৪ সাল থেকে আবাসন ব্যবসা শুরু করে স্ট্রাকচার বিল্ডার্স লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির মালিক শাহাবুদ্দিন তালুকদার। তিনি নারায়ণগঞ্জ রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক। তাঁর প্রতিষ্ঠান ১০ তলা ৩টি ভবন নির্মাণের পর ক্রেতাদের কাছে হস্তান্তর করেছে।

শহরের আল্লামা ইকবাল রোড, জামতলা, চাষাঢ়া, চাঁনমারী, কালির বাজার এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে আবাসন প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড বিল্ডার্স লিমিটেড। গত ৩ বছরে প্রতিষ্ঠানটি নগরীতে তিনটি ১০ তলা ও ২টি ৮ তলা ভবন নির্মাণ করেছে। তাদের অধিকাংশ ফ্ল্যাটের ক্রেতা চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ী।

প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা অংশীদার গোলাম মওলা প্রথম আলো কে জানান, মানুষ এখন জমি কিনে বাড়ি করার চেয়ে ফ্ল্যাট কেনায় বেশি আগ্রহী। এলাকাভেদে ফ্ল্যাটের দাম কমবেশি হয়ে থাকে বলে তিনি জানান।

৮ বছর আগে শহরের চাষাঢ়া এলাকায় ৯৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট কিনেছেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট লোকমান হোসাইন। তাঁর ফ্ল্যাটে রয়েছে তিনটি বেডরুম, ড্রয়িং ও ডাইনিং, একটি কিচেন ও দুটি ওয়াশরুম।

লোকমান হোসাইন প্রথম আলো কে বলেন, ‘শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় জমি কিনে বাড়ি করা আমাদের অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই সন্তানের স্কুল, নিজের কর্মস্থলসহ অন্যান্য নাগরিক সুযোগ–সুবিধার কারণে শহরে চার হাজার টাকা বর্গফুটে একটি ফ্ল্যাট কিনে বসবাস করছি।’ তিনি বলেন, কর্মজীবী অনেক মানুষ ও ব্যবসায়ীও ফ্ল্যাট কিনে শহরে বসবাস করছেন।

প্রায় ৪০০ বছর আগে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে এই নগরী গড়ে ওঠে। ছোট ছোট বাড়িঘর গড়ে তুলে মানুষ বসবাস শুরু করে। সেই পুরোনো অপরিকল্পিত নগর দিন দিন মানুষের বসবাসের উপযোগিতা হারাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে আবাসনের সংকট দেখা দিচ্ছে। পুরোনো ভবনগুলো রিয়েল এস্টেট খাতে চলে এলে লোকজনের আবাসনের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি পরিকল্পিত নগরায়ণ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

এখানকার অধিকাংশ জমির মালিক পৈতৃক জমিতে ফ্ল্যাট নির্মাণ করেন। যাঁরা ফ্ল্যাট কেনেন, তাঁরা প্রয়োজনে কেনেন। অর্ধেক জায়গা ছেড়ে ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হলে ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে যায়। এ কারণে অনেকেই আবাসন খাতে জমি দিতে আগ্রহী হচ্ছেন না।

আবাসন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নগরীতে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ উন্নয়ন হয়েছে। পরিকল্পিত নগরায়ণের লক্ষ্যে ও আবাসনসংকট মেটাতে রাজধানীর পাশের এ জেলার দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহাবুদ্দিন তালুকদার বলেন, এ খাতের প্রসার ঘটাতে হলে সরকারকে ভবনের উচ্চতা ও ভবনের চারপাশে জায়গা ছাড়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সংগঠনের সভাপতি নাছির উদ্দিন হায়দার চৌধুরী প্রথম আলো কে বলেন, এখানে অধিকাংশ জমিমালিকের জায়গার পরিমাণ কম। তাঁদের পক্ষে অর্ধেক জায়গা ছেড়ে ভবন নির্মাণ করা সম্ভব নয়। আর নতুন আইনে জায়গা ছেড়ে ভবন নির্মাণ করা হলেও ফ্ল্যাটের মূল্য দাঁড়াবে কোটি টাকার ওপরে। তিনি বলেন, সরকারকে এ জেলাকে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে তুলনা না করে সাবডিভিশন হিসেবে চিন্তা করে ভবনের উচ্চতা ও জায়গা ছাড় দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। তা না হলে আবাসন খাতের এ ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়বে।

নারায়ণগঞ্জের সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্য নামের বইয়ের লেখক রফিউর রাব্বি। প্রথম আলো কে বলেন, নারায়ণগঞ্জ প্রায় তিন হাজার বছর পুরোনো জনপদ। প্রথম দিকে নগর গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এখানে কোনো পরিকল্পনা ছিল না। অর্থনীতির প্রয়োজনে এখানে শত শত বছর আগে শিল্প ও বাণিজ্যপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলার মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে নারায়ণগঞ্জে আসেন। ফলে নগরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে উদ্বেগজনকভাবে।

অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে প্রতিনিয়ত সংকট বাড়ছে। দ্রুত সুষ্ঠু নগর–পরিকল্পনার বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। যেসব হাউজিং প্রতিষ্ঠান এখানে কাজ করছে, তাদের নগর–পরিকল্পনার আওতায় আনতে হবে। আবাসন, সড়ক, যানবাহন সবকিছুকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় আনতে হবে।

আবাসনের চাহিদা মেটাতে আমাদের টেকসই ও পরিকল্পিত নগরায়ণকে গুরুত্ব দিয়ে উঁচু ভবনের দিকে যেতে হবে বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ মো. মঈনুল ইসলাম। প্রথম আলো কে তিনি জানান, আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো নগরীতে অনেক বহুতল ভবন নির্মাণ করছে। টেকসই ও পরিকল্পিত নগরায়ণের মাধ্যমে আবাসন খাতের এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। তিনি বলেন, নগরের আবাসনের চাহিদা পূরণে স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য সহজ কিস্তিতে ফ্ল্যাট ও ভাড়ায় ব্যবস্থা রাখতে হবে।

Lading . . .