Advertisement

ঢাকার কিছু এলাকায় ভবনের আয়তন বাড়ছে

প্রথম আলো

প্রকাশ: ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

24obnd

রাজধানীর নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ সংশোধন প্রায় চূড়ান্ত করে এনেছে সরকার। এটি কার্যকর হলে ২০ ফুট বা এর বেশি প্রশস্ত সড়কের পাশের আবাসিক ভবনের ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর বা ফার) তথা আয়তন বাড়তে পারে। তবে ২০ ফুটের চেয়ে কম প্রশস্ত সড়কসংলগ্ন ফ্ল্যাটের আয়তন বাড়বে না।

একইভাবে ৬৮টি জনঘনত্ব ব্লকের মধ্যে পুরান ঢাকা, মগবাজার, শেওড়াপাড়া, মোহাম্মদপুর, আফতাবনগর-বনশ্রী, রাজাবাজার, শুক্রাবাদ, পান্থপথসহ বিভিন্ন এলাকায় এলাকাভিত্তিক ফার বাড়তে পারে। তাতে অভিজাত এলাকার সঙ্গে এসব এলাকার ভবনের আয়তন নিয়ে সৃষ্টি হওয়া বৈষম্য কমবে।

এদিকে এলাকাভেদে আবাসন ইউনিটের হার মূল ড্যাপ থেকে সামান্য বাড়ানো হতে পারে। এতে কিছু এলাকায় ফ্ল্যাটের সংখ্যা বাড়বে। যেমন মূল ড্যাপে পুরান ঢাকায় আবাসন ইউনিটের হার ছিল ১ দশমিক ২। সেটি বাড়িয়ে দ্বিগুণ, অর্থাৎ ২ দশমিক ৪ করা হচ্ছে। এর মানে পুরান ঢাকায় ৫ কাঠা জমিতে ৬টির পরিবর্তে সর্বোচ্চ ১২টি ফ্ল্যাট করা যাবে।

এভাবেই ড্যাপ সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে চূড়ান্ত করা হয়েছে খসড়া ঢাকা ইমারত বিধিমালা-২০২৫। মন্ত্রণালয়ের হয়ে কাজটি করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। খসড়া দুটি ‘ড্যাপ বাস্তবায়ন-তদারকি ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশোধনী সুপারিশ প্রণয়ন–সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি’ পাস করলে তা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য যাবে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে।

ভবনের আয়তন ও ইউনিট বাড়াতে ড্যাপের যে সংশোধন চূড়ান্ত করা হয়েছে তাতে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের নেতারা পুরোপুরি সন্তুষ্ট না হলেও মন্দের ভালো বলছেন। তাঁরা বলছেন, সংশোধন প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ হলে আবাসন খাতের স্থবিরতা কাটতে শুরু করবে। অন্যদিকে নগর–পরিকল্পনাবিদেরা কিছুটা ক্ষুব্ধ। তাঁরা বলছেন, ফার অনেক বেশি বাড়ানো হয়েছে। আবাসিক এলাকায় এত ফার পৃথিবীর কোথাও নেই।

জানতে চাইলে রিহ্যাবের সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যমান ড্যাপের চেয়ে ফার বাড়ানো হয়েছে। কারণ, গুলশান-বনানীর সঙ্গে অন্য এলাকার মধ্যে বড় বৈষম্য ছিল। এখন সেটি কিছুটা হলেও কাটবে। এতে আবাসন খাতের সংকট পুরোপুরি না কাটলেও অনেকটাই লাঘব হবে। আবাসন ইউনিটের সংখ্যা বাড়ানো হলে জমির মালিকেরা বেশি উপকৃত হতেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ড্যাপের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তা শিগগিরই মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। তারপর সেটি উপদেষ্টা কমিটিতে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য যাবে।
মো. মুস্তাফিজুর রহমান, উপনগর–পরিকল্পনাবিদ, রাজউক।

ঢাকা মহানগরসহ আশপাশের ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে ২০২২–৩৫ সালের জন্য করা মহাপরিকল্পনাটি ২০২২ সালের আগস্ট থেকে কার্যকর হয়েছে। ড্যাপ হচ্ছে ঢাকা মহানগরের একটি সমন্বিত ও সামগ্রিক ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা। সহজ ভাষায় বললে, ২০৩৫ সাল পর্যন্ত ঢাকার নগর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কীভাবে হবে, তা এই দলিলের আলোকেই ঠিক হবে।

ড্যাপ প্রণীত হওয়ার পর থেকেই আবাসন ব্যবসায়ীরা তা সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালে এক দফা সংশোধন করে সরকার। তাতেও সন্তুষ্ট হতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। গত বছর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ডিসেম্বরে বাস্তবায়ন-তদারকি ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশোধনী সুপারিশ প্রণয়ন–সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে দেয় সরকার।

ভবনের আয়তন বাড়ছে

জানা গেছে, ড্যাপ সংশোধনে ৬ থেকে ৮ ফুট সড়কের ভবনের ফার ১ দশমিক ৫ থেকে কমিয়ে ১ দশমিক ২৫ করার প্রস্তাব দেওয়া হতে পারে। এ ছাড়া ৮ থেকে ১২ ফুট সড়কের ক্ষেত্রে ফার করা হতে পারে ১ দশমিক ৭৫। ১৬ ফুট বা তার কম প্রশস্ত সড়কের ফার অপরিবর্তিত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ২০ ফুট সড়কের পাশের ভবনের ফার ২ দশমিক ৭৫ থেকে বাড়িয়ে ৩ দশমিক ২৫ করা হতে পারে।

এ ছাড়া প্রায় ৩০ ফুট সড়কের পাশের ভবনের ফার ৩ দশমিক ২৫ থেকে বাড়িয়ে ৩ দশমিক ৫০ করার পরিকল্পনা আছে। ৪০ ফুট প্রশস্ত সড়কের ফার অপরিবর্তিত থাকতে পারে, ৩ দশমিক ৭৫। অন্যদিকে ৬০ ও ৮০ ফুট সড়কের পাশের ভবনের ফার আরও বাড়তে পারে।

সড়কভিত্তিক ফারের পাশাপাশি ৬৮টি জনঘনত্ব ব্লকের এলাকাভিত্তিক ফার ও আবাসন ইউনিটের হার সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে রাজউক। এতে এলাকাভিত্তিক সর্বোচ্চ ফার নির্ধারণ করা হতে পারে গুলশান-বনানীতে ৫ দশমিক ৫, যা এখন আছে ৫ দশমিক ৭। এই অভিজাত এলাকায় আবাসন ইউনিটের হার ১ দশমিক ৭ থেকে বাড়িয়ে করা হচ্ছে ১ দশমিক ৯। তাতে পাঁচ কাঠা জমিতে ফ্ল্যাটের সংখ্যা বর্তমানের চেয়ে একটি বাড়বে।

অন্যদিকে খসড়া সংশোধনী প্রস্তাবে আবাসন ইউনিটের সর্বোচ্চ ফার ২ দশমিক ৫ হার রাখা হতে পারে মহাখালীতে, যা বর্তমানে আছে ১ দশমিক ৯। আবাসন ইউনিটের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৪ হার রাখা হয়েছে পুরান ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ সেন্টারে। এখন পুরান ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ সেন্টারে আবাসন ইউনিটের হার হচ্ছে ১ দশমিক ২। এ দুই এলাকার এলাকাভিত্তিক ফারও বেড়েছে।

অন্যদিকে ড্যাপের সংশোধনী প্রস্তাবে আবাসন ইউনিটের সর্বনিম্ন হার ১ দশমিক ৩ রাখা হতে পারে সাঁতারকুল-নাসিরাবাদ ও কাউন্দিয়া-আমিনবাজারে। আবাসন ইউনিটের হার ২-এর নিচে সুপারিশ করা হয়েছে—খিলক্ষেত আবাসিক এলাকা, মিরপুর ডিওএইচএস, পল্লবী ২ ও মাতুয়াইলে (১.৭), নিকেতনে (১.৮), মিরপুর, শেওড়াপাড়া, আনন্দনগর বেড়িবাঁধ, খিলক্ষেত, দক্ষিণখান ও ঝিলমিল আবাসিক, ইউনাইটেড সানভ্যালি, উত্তরা তৃতীয় পর্ব ও পূর্বাচল আবাসিক এলাকায় (১.৯)।

সংশোধনী প্রস্তাবে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এলাকাভিত্তিক ফার আগের মতো ৪ দশমিক ১ রাখা হলেও আবাসন ইউনিটের হার ১ দশমিক ৯ থেকে বাড়িয়ে ২ করা হতে পারে। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, মগবাজার, পান্থপথ, রাজারবাগ ও শুক্রাবাদের এলাকাভিত্তিক ফার ও আবাসন ইউনিট উভয়ই বাড়ানো হতে পারে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন আবাসন ব্যবসায়ী বলেন, সংশোধনী প্রস্তাবে মূল ড্যাপের চেয়ে আবাসিক ভবনের ফার ও আবাসন ইউনিটের হার বাড়ানোর পরিকল্পনা হচ্ছে। তবে প্রকৃত অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হবে না। ২০২৩ সালে ড্যাপ সংশোধনে করে ভবনের আয়তন অব্যবহৃত থাকলে তা দিয়ে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ ইউনিট বাড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়। নতুন ড্যাপ সংশোধন হলে আগের সংশোধন বাতিল হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে অবশ্য সংশোধনের পর ফ্ল্যাটের সংখ্যা খুব একটা বাড়বে না।

বৈষম্য কতটুকু কমল

ভূমি উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের সভাপতিত্বে ড্যাপ সংশোধনবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটি চলতি বছরের ১৯ মার্চ বৈঠক করে। সেই বৈঠকে রাজউকের প্রধান পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম ড্যাপ সংশোধনের প্রস্তাব তুলে ধরেন, যা অংশীজনদের সমন্বয়ে কারিগরি কমিটির পাঁচটি সভা করে চূড়ান্ত করা হয়। শেষ পর্যন্ত উপদেষ্টা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়—আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাদের উপস্থিতিতে অংশীজনদের নিয়ে বৈঠক করে ফার নির্ধারণ করে ড্যাপ সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত করতে হবে।

পরবর্তী সময়ে রাজউকের কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি); বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট (আইএবি); ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি); রিহ্যাব; বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতিসহ (বেলা) অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে। এতে কিছু বিষয়ে ঐকমত্য হলেও ফারের বিষয়ে হয়নি। তবে অংশীজনদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে ফার বিষয়ে একটি প্রস্তাব তৈরি করে রাজউক। এতে বিদ্যমান ড্যাপের তুলনায় ফার বাড়ানো হয়। যেমন ১৬ ফুট সড়কের পাশের জমিতে ভবন নির্মাণের জন্য ফার ২ দশমিক ৫ থেকে বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়।

রাজউক সেই প্রস্তাবনা গত ৩ আগস্ট আইন, পরিবেশ ও গৃহায়ণ—এই তিন উপদেষ্টার উপস্থিতিতে অংশীজনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় তুলে ধরে। সেই বৈঠকে বিষয়টি চূড়ান্ত না হলে সাত দিন পর আবার সভা হয়। এতে আইন উপদেষ্টা ছাড়া অন্যরা ছিলেন। বিআইপিসহ একাধিক পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা দ্বিমত পোষণ করেন। পরে পেশাজীবী চার সংগঠন (বাপা, বিআইপি, আইএবি ও আইইবি) আলাদা বৈঠক করে ফারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছায়। এই বৈঠকে রিহ্যাবসহ অন্য সংগঠনের প্রতিনিধিদের রাখা হয়নি। তারপরই সংশোধনীর খসড়া চূড়ান্ত করে রাজউক।

জানতে চাইলে রাজউকের উপনগর–পরিকল্পনাবিদ মো. মুস্তাফিজুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ড্যাপের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তা শিগগিরই মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। তারপর সেটি উপদেষ্টা কমিটিতে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য যাবে।

বর্তমানে গুলশান-বনানী এলাকায় ২০ ফুট সড়কের পাশের ৫ কাঠা জমিতে ৯ হাজার ৯০০ বর্গফুট আয়তনের ভবন করা যায়। ফ্ল্যাট হয় ৮-৯টি। সড়কের প্রশস্ত ও জমির আকার একই থাকলেও এখন পুরান ঢাকায় পাওয়া যায় ৯ হাজার ৩৬০ বর্গফুট। তবে ফ্ল্যাট নির্মাণ করা যায় ছয়টি।

সংশোধনী চূড়ান্ত হলে গুলশান-বনানীতে ২০ ফুট সড়কের পাশের ৫ কাঠা জমিতে ১১ হাজার ৭০০ বর্গফুট আয়তনের ভবন করা যাবে। ফ্ল্যাট হবে ৯-১০টি। অন্যদিকে পুরান ঢাকায়ও ১১ হাজার ৭০০ বর্গফুটের ভবন করা যাবে। ফ্ল্যাটের সংখ্যা হবে সর্বোচ্চ ১২টি। এর কারণ, পুরান ঢাকার আবাসন ইউনিট দ্বিগুণ করা হচ্ছে।

জানতে চাইলে রিহ্যাবের সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, তিন বছরের বেশি সময় ধরে আবাসন ব্যবসায় একধরনের স্থবিরতা চলছে। ব্যবসায়ীরা নতুন প্রকল্প নিতে পারছেন না। তাতে চাহিদার বিপরীতে ফ্ল্যাটের জোগান কমে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত সময়ের মধ্যে ড্যাপ চূড়ান্ত করা প্রয়োজন। না হলে আবাসন ব্যবসায় গতি আসবে না। সংযোগশিল্পগুলো ঘুরে দাঁড়াবে না।

এ বিষয়ে নগর-পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) নতুন সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক বেশি ফার বাড়ানো হয়েছে। আবাসিক এলাকায় এত ফার পৃথিবীর কোথাও নেই। রিহ্যাব ও আইএবির পরামর্শে ফার বাড়ানোর সুপারিশ করেছে মন্ত্রণালয়। আমরা বিআইপির পক্ষ থেকে ফার বাড়ানোর বিরুদ্ধে গত ৩ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছি। আমরা বলেছি, এটি ভয়ংকর হবে।’

Lading . . .