প্রকাশ: ১৭ আগস্ট, ২০২৫

প্রথমবার বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেই ৪১তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন শেখ তৌহিদুল কবীর। শেখ রেজাউল করিম ও নাজমিনা বেগম দম্পতির ছোট সন্তান তিনি। জন্ম ও বেড়ে ওঠা রাজশাহী সদরে। ২০১১ সালে ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত বাবাকে হারানোর পর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। ওই বছরই রাজশাহী কলেজে ডিগ্রি পাস কোর্সে ভর্তি হন তিনি। তাই অনেকের কটু কথা শুনতে হয়েছে তাকে। কিন্তু দমে যাননি তিনি। বরং ‘কিছু করে দেখানোর’ সংকল্পে দৃঢ় হোন।
ডিগ্রিতে (পাস কোর্সে) পড়ে বিসিএস ক্যাডার হওয়া অনেকের কাছে অলীক কল্পনা। সেই কঠিন বাস্তবতাকে জয় করে সফলতার নজির গড়েছেন শেখ তৌহিদুল কবীর। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় চাকরির প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। আমার বড় ভাই আমার মেন্টরের ভূমিকা পালন করেন। মূলত বড় ভাইয়ের পরামর্শ ও দিক নির্দেশনায় আমার বিসিএসের পথচলা শুরু।’ সেশনজটের কারণে ২০১৪ সালের ডিগ্রি ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয় ২০১৬ সালে। রাজশাহী কলেজ থেকে বিএসএস মেধাক্রমে তৃতীয় হন তৌহিদ। ২০১৮ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণিতে মাস্টার্স ফাইনাল সম্পন্ন করে চাকরির পরীক্ষা দেওয়া শুরু করেন। ডিগ্রি থেকে প্রস্তুতির কারণে তখন তার নিজের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস কাজ করে। মাস্টার্স শেষ করার পর তার হাতে সময় অবশিষ্ট ছিল প্রায় তিন বছর।
তৌহিদুল কবীরের মতে, ‘বিসিএস কেবল মেধার পরীক্ষা নয়- এটি ধৈর্য, অধ্যবসায় ও মনঃসংযোগের পরীক্ষা। যিনি নিয়মিত পরিশ্রম করবেন, পরিকল্পনা নিয়ে এগোবেন, তিনিই সফল হবেন। বিশ্বাস রাখতে হবে যে আমিও পারব। ব্যর্থতা আসবেই, কিন্তু তাতে ভেঙে পড়লে চলবে না।’
তৌহিদুল ২০২০ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পেয়ে যোগ দেন। ওই সময়ই ৪১তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তির প্রেক্ষিতে আবেদন করেন। এরই মধ্যে ২০২২ সালে হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে অডিটর পদেও নিয়োগ পান। বিসিএস প্রস্তুতির বিষয়ে তৌহিদুল জানান, ‘ডিগ্রিতে পড়ার সময় আমার প্রস্তুতি ছিল প্রিলিমিনারিভিত্তিক। প্রস্তুতির ক্ষেত্রে আমি আমার দুর্বল দিকগুলোর প্রতি বিশেষ যতœবান হই। ছোটবেলা থেকেই গণিতের প্রতি ভীতি কাজ করত। এ জন্য আমি গণিতের প্রতি বাড়তি নজর দিই। এছাড়া অন্য বিষয়গুলোকেও প্রাধান্য দিই। কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষাগুলোতে অংশ নিতাম, যা আমার প্রস্তুতিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে।’
তৌহিদুল ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত ৪১তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, যা তার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। এরপর লিখিত প্রস্তুতি শুরু করেন। লিখিত প্রস্তুতির ক্ষেত্রে তৌহিদুল বাজারের প্রচলিত গাইড বইয়ের পাশাপাশি নিয়মিত অনুবাদ চর্চা করতেন। গণিতেও আলাদা নজর দিতেন। বিভিন্ন ধরনের ডাটা আলাদা করে খাতায় লিখে রাখতেন। তৌহিদুল বলেন, ‘আমার হাতের লেখার ধীরগতির কারণে আমি কোনো একটি বিষয় পড়ার পর তা খাতায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লেখার চর্চা করতাম। আমি মনে করি, বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় সময় ব্যবস্থাপনা একটি বড় বিষয়। বিশেষ করে বাংলা, বাংলাদেশ বিষয়াবলি, আন্তর্জাতিক, বিজ্ঞান- এগুলোতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পুরো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে তা আপনার নম্বর প্রাপ্তিতে বাড়তি মাত্রা যোগ করতে পারে। ইংরেজির জন্য ফ্রিহ্যান্ড লেখার চর্চা করতাম।’ লিখিত পরীক্ষায় তৌহিদুল মুখস্থনির্ভর না হয়ে বরং সব বিষয়েই ধারণা নিয়ে সে বিষয়ে লেখার চেষ্টা করেছেন। তৌহিদুলের মতে লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি হতে হবে পরিকল্পনামাফিক।
তিনি আরও বলেন, ‘২০২২ সালের নভেম্বরে লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। রেজাল্ট শিটে আমার রোল দেখে আমার আত্মবিশ্বাস আরো বেড়ে যায়। এরপর শুরু হয় আমার ভাইভা প্রস্তুতি। বিভিন্ন সাম্প্রতিক বিষয়ে ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করি। প্রতি মাসের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স থেকে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর তথ্য একটি খাতায় নোট করি। আমার ভাইভা পুরোটাই বাংলায় হয়।’
ভাইভা বোর্ডের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অনেকের মধ্যে একটা ভ্রান্ত ধারণা কাজ করে যে ভাইভা বোর্ডে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব কম দেওয়া হয়। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। তবে বোর্ডের আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। এটি ছিল একটি ভুল ধারণা। যেসব প্রশ্নের উত্তর জানা ছিল না সে ক্ষেত্রে বিনয়ের সঙ্গে দুঃখিত বলি। ভাইভা বোর্ডে বিনয়ী আচরণ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ভাইভা বোর্ড দেখে কীভাবে আপনি পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন। ভাইভা শেষ করে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা শুরু হয়। অবশেষে আগস্টের ৩ তারিখ আমার অপেক্ষার পালা শেষ হয়। প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত দেখে প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।’
বিসিএস প্রত্যাশীদের উদ্দেশ্যে তৌহিদুল বলেন, ‘বিসিএস কেবল মেধার পরীক্ষা নয়- এটি ধৈর্য, অধ্যবসায় ও মনঃসংযোগের পরীক্ষা। যিনি নিয়মিত পরিশ্রম করে পরিকল্পনা নিয়ে এগোবেন, তিনিই সফল হবেন। বিশ্বাস রাখতে হবে যে আমিও পারব। ব্যর্থতা আসবেই, কিন্তু তাতে ভেঙে পড়লে চলবে না।’
আরও পড়ুন