নিরন্তর টিকে থাকার লড়াই কুতুবদিয়া দ্বীপবাসীর
প্রকাশ: ১৭ আগস্ট, ২০২৫

কক্সবাজার উপকূলে বঙ্গোপসাগরের কোলে ছোট্ট এক দ্বীপ কুতুবদিয়া। চারপাশে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় দিনের পর দিন ছোট হয়ে আসছে দ্বীপটির আয়তন। ফলে এ উপজেলার মানুষের জীবন ক্রমেই অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে। কখনো জোয়ারের পানি, কখনো ঘূর্ণিঝড়, আবার কখনো সুপেয় পানি ও উন্নত চিকিৎসার অভাব-সব মিলিয়ে নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়েই জীবন পার করছেন দ্বীপবাসী। তবুও এই সংগ্রামের মাঝেই পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেন তারা। দ্বীপের জনজীবন উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো উল্লেখযোগ্য কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে তারা পিছিয়ে পড়েছেন। দ্বীপবাসীর প্রধান দাবি-টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও উন্নত চিকিৎসা সেবা। যোগাযোগ ব্যবস্থাও এখানে অপ্রতুল। আটোরিকশা ছাড়া অন্য কোনো যানবাহনের দেখা মেলে না।
ভাঙনে ছোট হচ্ছে কুতুবদিয়া : গত ৩০ বছরে দ্বীপের চারপাশে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় কুতুবদিয়ার প্রায় ৪০ শতাংশ ভূমি সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। অবশিষ্ট অংশও জোয়ারের চাপে প্রতিদিন ক্ষয়ে যাচ্ছে। ধলঘাটা ইউনিয়নের বাসিন্দা রহিমা বেগম বলেন, আমার ছেলেবেলায় যে বাড়ি ছিল, তা এখন সাগরে বিলীন। এখন সেখানে মাছ ধরার ট্রলার চলে। একটা গ্রামই হারিয়ে গেছে। তিন সন্তান নিয়ে পাশের একটি উঁচু জায়গায় ছোট্ট একটি ঘর বানিয়ে থাকি। তবুও মনে সবসময় আতঙ্ক-কখন যে এই ঘরটিও ভেঙে যায়!
সুপেয় পানির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটা : কুতুবদিয়ায় ভূগর্ভস্থ পানি কোনো সময় লবণাক্ত, কোনো সময় মিঠা। তাও সরাসরি পানের উপযোগী নয়। দ্বীপে নেই কোনো পানি শোধনাগার। তুলনামূলক সচ্ছল পরিবারগুলো বৃষ্টির পানি ট্যাংকে জমিয়ে রাখে। বাকিরা এক থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে গিয়ে কলসি ভরে পানি আনেন। আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের তরুণী হালিমা বেগম ও তসলিমা আক্তার বলেন, প্রতিদিন সকাল ৭টায় কলসি নিয়ে যাই। অনেক সময় দুপুর পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। লাইন শেষে অনেক সময় লবণাক্ত পানি উঠে, তখন খালি হাতে ফিরে আসতে হয়।
নেই উন্নত চিকিৎসা সেবা : দ্বীপে একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও উন্নত চিকিৎসা নেই। ভালো ডাক্তার এখানে থাকতে চান না। হাসপাতালেও জনবল সংকট প্রকট। রাতবিরাতে জটিল রোগ হলে সাগর পাড়ি দিয়ে কক্সবাজার বা চট্টগ্রাম যেতে হয়। বড়ঘোপ ইউনিয়নের সাদ্দাম হোসেন বলেন, আমার মা স্ট্রোক করেছিলেন। চট্টগ্রামে নেওয়ার জন্য ট্রলারে তোলার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মারা যান। ৭৬ বছর বয়সী মুক্তার হোসেন জানান, গত ৫০ বছরে চিকিৎসার অভাবে মাঝসমুদ্রে অসংখ্য প্রাণ ঝরে গেছে। এ ধরনের শতাধিক ঘটনার সাক্ষী তিনি নিজে।
সাগরের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ : বড়ঘোপ ইউনিয়নের পশ্চিম রোমাই পাড়ার মমতাজ বেগম (৫০) সাগরের তাণ্ডবে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। স্বামীর শেষ সম্বল বসতভিটা এক দশক আগে সাগরে বিলীন হয়েছে। আগে এখানে ৫ শতাধিক পরিবারের বসতি ছিল। এখন মাত্র কয়েকটি ঘর অবশিষ্ট। অভাবের সংসারে একমাত্র ছেলে রিকশাচালক। নতুন বসতভিটা কেনার সামর্থ্য নেই। তাই সাগরপাড়েই ছোট্ট ঘর তুলে কোনোভাবে বেঁচে আছেন।
বড়ঘোপ ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আব্দুল মালেক বলেন, গত অমাবস্যার জোয়ারে ২০-২৫টি বাড়ি বিলীন হয়েছে। আগামী পূর্ণিমার আগে ব্যবস্থা না নিলে আরও ৩০-৪০টি বাড়ি হারিয়ে যাবে। বিদ্যুৎ খুঁটিও পড়ে গেছে, কিন্তু প্রশাসন এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
১৯৯১ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে কুতুবদিয়ায় ব্যাপক প্রাণহানি হয়। পরবর্তী সময়ে ভাঙনে ঘরবাড়ি হারানো কয়েক হাজার মানুষ কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে আশ্রয় নেন। সেই এলাকা এখন ‘কুতুবদিয়া পাড়া’ নামে পরিচিত। এত বছর পেরিয়ে গেলেও টেকসই বেড়িবাঁধ হয়নি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ক্যাথোয়াইপ্রু মারমা বলেন, এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বেড়িবাঁধ। টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় দ্বীপের আয়তন কমছে। মানুষ ঘরবাড়ি ও কৃষিজমি হারাচ্ছে। এ জন্য বরাদ্দের চেষ্টা চলছে। তিনি আরও জানান, সুপেয় পানির সংকট দূর করতে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় জনস্বাস্থ্যের মাধ্যমে কয়েকটি প্রকল্প প্রায় শেষ পর্যায়ে। কাজ শেষ হলে মাত্র ৫০ পয়সা বা নামমাত্র মূল্যে কার্ড/মিটার সিস্টেমে পানি পাওয়া যাবে। এছাড়া দীর্ঘদিনের দাবি ফেরি সেবা চালুর বিষয়েও চেষ্টা চলছে।
আরও পড়ুন