এক ঢেউয়ে নিভে গেছে মুন্ডাদের কারাম উৎসবের প্রদীপ
প্রকাশ: ৯ আগস্ট, ২০২৫

খুলনার সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রার কয়েকটি গ্রামে ছড়িয়ে আছে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী মুন্ডাদের দেড় হাজারের বেশি পরিবার। নিজেদের পরিচয়ে গর্বিত এই জনগোষ্ঠীর গ্রামীণ সংস্কৃতির বড় আয়োজন ছিল কারাম উৎসব। একসময় বছরের নির্দিষ্ট সময়ে ঢাকঢোল, করতাল আর মাদল তালে মেতে উঠতেন মুন্ডা তরুণ-তরুণীরা। হতো নাচ–গান, পূজা ও খাওয়াদাওয়া, যা চলত গভীর রাত পর্যন্ত। এখন সে উৎসব নেই, শুধু গল্প হয়ে বেঁচে আছে মানুষের স্মৃতিতে।
এ অবস্থায় আজ ৯ আগস্ট শনিবার পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ দিবসটিকে স্বীকৃতি দেয়। তখন থেকে প্রতিবছর আদিবাসীদের অধিকার, সম্মান ও সংস্কৃতি রক্ষায় এদিন পালন করা হয়।
কয়রার নলপাড়া গ্রামের নমিতা রানী মুন্ডা এখনো আশায় বুক বাঁধেন, হয়তো কোনো এক ভোরে আবার কারাম উৎসব ফিরবে। তাঁর ভাঙা ঘরের বারান্দায় বসে কারাম উৎসবের কথা তুলতেই আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘২০০৯ সালের আইলার আগেই শেষবার হইছিল। এরপর আর হয়নি। কারামগাছই তো নেই, উৎসব হবে কীভাবে?’
কারামগাছ—যেটাকে স্থানীয়ভাবে খিলকদম বলা হয়। এই গাছের ডাল ছাড়া কারাম উৎসব অপূর্ণ। মুন্ডারা বিশ্বাস করেন, এই গাছের ডালে লুকানো আছে সমৃদ্ধি আর মঙ্গল।
সম্প্রতি কয়রা উপজেলার মুন্ডাপাড়ার উঠান থেকে উঠান ঘুরে জানা গেল, গল্পের মতো—কীভাবে এক ঢেউয়ে, এক ঝড়ে হারিয়ে গেছে একটি গোটা উৎসব। তাঁদের কথায়, ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলায় বাঁধভাঙা নোনাপানির ঢেউয়ে ডুবে যায় উৎসবের মাঠ, উঠান আর বেদি। জমির লবণাক্ততা এমনভাবে জমে বসে, যে কারামগাছ আর বাঁচে না। মাঝেরপাড়ার পরশুরাম মুন্ডা বলেন, ‘গাছ নাই, উদ্যোগী মানুষও নাই। এই গ্রামের নকুল মুন্ডা বাইচে থাকলি হয়তো উৎসব কুরত। নকুল মুন্ডার ছাওয়ালডাও (ছেলে) বেকার হুয়ি পাড়ি দেছে পাশের দেশ ভারতে।’
কয়রার বতুলবাজার এলাকায় গিয়ে কথা হয় স্বপন মুন্ডার সঙ্গে। তিনি পেশায় দিনমজুর। ঘরের ছাউনি ঠিক করার ফাঁকে বললেন, ‘আগে কত আনন্দ হইতো! নাচ-গান, খাওয়াদাওয়া। এক রাত এক দিন চইলতো কারাম উৎসব। কিন্তু আইলার পর সব শেষ।’ পাশ থেকে স্ত্রী রেনু বালা মুন্ডা শোনালেন তেতো বাস্তবতা, ‘উৎসব করতে কত টাকা লাগে জানেন? একটু আগে আলু ধার কইরে আনছি, উনি আছে উৎসবের চিন্তায়! গরিবের আবার উৎসব?’
কাটকাটা গ্রামের লক্ষী রানী মুন্ডার শৈশব কেটেছে শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নে। বিয়ের পর কয়রায় এসে আর দেখেননি সেই উৎসব। তিনি বলেন, ‘বাপের বাড়িতে ছোটবেলায় কত দেখিছি। এখন আর হয় না। শুনিছি উত্তরাঞ্চলের দিকিত্তে কেউ কারামগাছের চারা আইনে এলাকায় লাগাইল, কিন্তু বাঁচানো যায়নি।’
কারাম উৎসব নিয়ে কথা বলতেই মুন্ডাদের মুখে মুখে ঘোরে ধর্মা আর কর্মার গল্প। দুই ভাইয়ের মধ্যে ধর্মা কারামগাছ পূজা করতেন, কর্মা করতেন না। একদিন কর্মা সেই গাছ নদীতে ফেলে দেন। তারপর বিপদাপদ। শেষমেশ গাছ ফিরিয়ে এনে পূজা করলে বিপদ কেটে যায়।
কারাম উৎসবে সূর্যোদয় থেকে উপোস থাকতেন মুন্ডারা। সন্ধ্যায় মাদল, ঢোল আর নাচ-গানের তালে কারাম গাছের ডাল তুলে আনা হতো। মাঠে বেদি বানিয়ে পূজা বসত। পুরোহিত গল্প শোনাতেন ধর্মা-কর্মার। নারীরা একে অন্যকে পিঠা খাইয়ে উপোস ভাঙতেন। রান্না হতো খিচুড়ি। উঠান ভরে যেত ঢাকের বাজনা আর নাচের তালে।
এসব গল্প শোনালেন কয়রার নলপাড়া গ্রামের রামতনু মুন্ডা। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, শুধু কারাম নয়, আইলার নোনাপানি তাঁদের অনেক উৎসবই কেড়ে নিয়েছে। যে মাঠের পাশে কারামগাছের ডাল পুঁতে উৎসব হতো, এখন সেখানে শুধু ফাঁকা জায়গা আর স্মৃতি। আগে বেদকাশী থেকে ডাল এনে তাঁদের উঠানে হতো উৎসব। এখন গাছও নেই, উৎসবও নেই, আর ফিরেও আসে না সেই দিনগুলো।
বেদকাশীর তরুণ সাধন কুমার মুন্ডা কখনোই নিজের চোখে এই উৎসব দেখেননি। শুধু বয়স্ক মানুষদের মুখে শুনেছেন। তিনি বলেন, ‘শুনছি অনেক, তবে দেখা হইনি। পাশের বড়বাড়ি এলাকায় বিমল মুন্ডার বাড়িতে শুনেছি কারাম উৎসব হতো।’
খুলনা জেলা আদিবাসী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নিরাপদ মুন্ডা বলেন, ‘কারাম আমাদের লোকজ সংস্কৃতির বড় অংশ। আগে কয়রার মুন্ডারা ঘরে ঘরে করত, এখন গাছ নেই, আয়োজনও নেই। উত্তরাঞ্চলে টুকটাক হয়, সুন্দরবনপাড়ে সব হারিয়েছে। তবে এখনো বৃদ্ধরা নাতি-নাতনিকে ধর্মা-কর্মার গল্প শোনান। সেই গল্পই একদিন খিলকদমগাছ ফিরিয়ে আনতে পারে, মাদলের তালে আবার জেগে উঠতে পারে হারানো উৎসব।’