Advertisement

চলন্ত দোকানই খলিলুরের জীবনের ভরসা

প্রথম আলো

প্রকাশ: ১০ আগস্ট, ২০২৫

এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ছুটে চলে খলিলুর রহমানের চলন্ত দোকান। সম্প্রতি তোলাছবি: প্রথম আলো
এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ছুটে চলে খলিলুর রহমানের চলন্ত দোকান। সম্প্রতি তোলাছবি: প্রথম আলো

সাইকেলের গায়ে বাঁশ আর কাঠের তৈরি কাঠামো। সেই কাঠামোর গায়ে ঝুলছে রঙিন বাটি, বদনা, খেলনা, ফিতা, চুলের ক্লিপ, চকচকে কসমেটিকসের প্যাকেট—আরও কত কী! যেন এক চলন্ত হাট! এমন এক সাইকেল নিয়ে খুলনার উপকূলজুড়ে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন খলিলুর রহমান। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ছুটে চলা এই ভ্রাম্যমাণ দোকানই তাঁর জীবনের একমাত্র ভরসা।

খলিলুর রহমানের বয়স এখন ৫৪। বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চরসাদীপুর গ্রামে, স্ত্রী-সন্তানেরা থাকেন সেখানেই। আর তিনি থাকেন খুলনার পাইকগাছা উপজেলার গড়ুইখালী বাজার এলাকায় একটি ছোট ভাড়া ঘরে। ভোরের আলো ফোটার আগেই তাঁর দিন শুরু হয়। সাইকেলের গায়ে নতুন মাল সাজিয়ে রওনা হন কয়রা বা পাইকগাছার কোনো না কোনো গ্রামে।

সম্প্রতি কয়রা উপজেলার সুন্দরবন ঘেঁষা হড্ডা গ্রামের ফাঁকা সড়কে দেখা হয় তাঁর সঙ্গে। গরমে হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড়ালেন একটু জিরিয়ে নিতে। সাইকেলে ঝুলতে থাকা পণ্যগুলোর দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘এই সাইকেলটাই আমার দোকান। ৪০-৫০ রকমের জিনিস আছে। দামও বেশি নয়, ১০ টাকা থেকে শুরু।’

তিনি জানান, একসময় দাকোপ উপজেলার বাজুয়া এলাকায় থাকতেন। তখন পাবনা থেকে ছিট কাপড় এনে সাইকেলে করে বিক্রি করতেন। ব্যবসা ভালোই চলছিল, কিন্তু জায়গায় জায়গায় কাপড়ের দোকান গজিয়ে ওঠায় বাধ্য হয়ে পেশা বদলান। ১৮ বছর ধরে কসমেটিকসসহ নিত্যব্যবহার্য পণ্যের এই ভ্রাম্যমাণ দোকান চালাচ্ছেন। দিনে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। তাতেই কোনো রকমে চলে যাচ্ছে। এই চলন্ত দোকানের আয়ে তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন খলিলুর। এখন পরিবারে আছেন স্ত্রী আর একমাত্র ছেলে। ছেলে মাধ্যমিক পাস করে ইলেকট্রিকের কাজ শিখেছে, এখন মিস্ত্রির কাজ করে। ‘এখন ছেলেডাও ইনকাম করে’,—বলতে গিয়ে খলিলুরের মুখে ফুটে ওঠে এক তৃপ্তির হাসি।

সাইকেলের দোকানটা শুধু খলিলুরের রুটিরুজির মাধ্যম নয়, এই দোকান অনেক গ্রামীণ নারীর জন্য যেন এক ভ্রাম্যমাণ বাজার। খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমার ডাক শুনে আশপাশের বাড়ির মহিলারা রাস্তায় চইলে আসে। কেউ চিরুনি কেনে, কেউ পাউডার, কেউ ফিতে। গ্রামের অনেক মহিলা ইচ্ছে হলিও বাজারে যেইতে পারে না। আমার এই সাইকেলডাই তাগের ভরসা।’

কথাগুলো মিলে যায় আশপাশের মানুষজনের বক্তব্যের সঙ্গেও। হড্ডা গ্রামের রেনুকা মণ্ডল বলেন, ‘খলিল দাদা অনেক বছর ধইরে মাল নিয়ে আসে আমাগের গ্রামে। তার সাইকেল দোকানে বাড়ির খুটিনাটি মেলা রকমের মাল পাই।’ পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ তপন কুমার যোগ করেন, ‘খলিল ভাই বড্ড ভালো মানুষ। হাসিমুখে মাল বিক্রি করে, দামদর নিয়ে কখনো ঝামেলা করে না।’

খাওয়াদাওয়া নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে হেসে বলেন, ‘যা পাই, তা–ই খাই। কোনো দিন দোকান থেইকে এক প্লেট খিচুড়ি, আবার কোনো দিন শুধু একটা পাউরুটি খাই। রানতি পারি সব, কিন্তু সারা দিন সাইকেল ঠেইলে ফিরে আর রানতি মন চায় না। তা ছাড়া বউ-সন্তান বাড়িতে থাকে, ওগের রাইখে ভালো কিছু খাইতে গেলেও মনটা খারাপ হয়।’

বর্ষা মৌসুম নিয়ে তাঁর আফসোস সবচেয়ে বেশি। বলেন, ‘গরমের চেয়ে বর্ষায় বেশি কষ্ট। কাঁদা আর পিচ্ছিল রাস্তায় সাইকেল ঠেলা মেলা ঝামেলার কাজ। কতবার যে পইড়ে গেছি। কয় দিন আগে বেতবুনিয়া খেয়াঘাটে পইড়ে কোমরে ব্যথা পালাম। নিজে পড়ি তবে বাইসাইকেল আর মালামাল কখনো ফেলিনি।’

নিজের জীবন নিয়ে তাঁর কোনো আক্ষেপ নেই, বরং সোজাসাপটা বলেন, ‘ছোটবেলায় লেখাপড়া শিখিনি। আগে তো মোবাইলও ছিল না। চিঠি লিখতিও পারতাম না। পোস্ট অফিসে যাইয়ে লাইনে দাঁড়ায়ে টাকা পাঠাতাম, সেই টাকা বাড়ি পৌঁছাইতে এক সপ্তাহ লাগত। এখন যুগ বদলাইছে, কিন্তু আমার রোজগার এখনো এই চলন্ত দোকান থেকেই।’

Lading . . .