Advertisement

১৬০ কোটির সড়ক পাঁচ বছরে অচল

কালবেলা

প্রকাশ: ২৮ আগস্ট, ২০২৫

১৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন করে নির্মাণ করা খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক বেহাল। ছবি : কালবেলা
১৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন করে নির্মাণ করা খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক বেহাল। ছবি : কালবেলা

খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ পথ। পাঁচ বছর আগে ১৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই সড়কটি আজ মারাত্মক বিপজ্জনক অবস্থায় রূপ নিয়েছে। মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে সড়কটি এমন ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে যে, এখন সেটিকে স্থানীয়রা বলছেন মৃত্যুফাঁদ। শুধু গত এক বছরেই এ মহাসড়কে ৫৬টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৩৩ জন মানুষ, আহত হয়েছেন শতাধিক, যাদের অনেকেই নারী ও শিশু এবং অনেকে এখনো কাটাচ্ছেন চিকিৎসা আর যন্ত্রণার দিন।

সোমবার সকাল ৯টার দিকে ডুমুরিয়ার ঝিলেরডাঙ্গা এলাকায় পিকআপ ও ইজিবাইকের মুখোমুখি সংঘর্ষে তিনজন নিহত হন। নিহতরা হলেন ইজিবাইকের যাত্রী মিনা খাতুন (৩৬), বাগদাড়ি গ্রামের মোহাম্মদ রুস্তম আলী খান (৬৫) এবং খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান চালক মোহাম্মদ জাহিদুর মোড়ল (২৫)। আহত হন আরও চারজন, যারা আশঙ্কাজনক অবস্থায় খুলনা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন। এর আগেও ডুমুরিয়ার চাকুন্দিয়ায় ১৭ জুলাই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুজন মারা যান এবং ১৬ জুলাই ইজিবাইক দুর্ঘটনায় মারা যান আরও দুজন। ডুমুরিয়া ফায়ার সার্ভিসের দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, গত এক বছরে এ মহাসড়কে ৫৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১১ জন ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন এবং আরও ২২ জন মারা গেছেন হাসপাতালে নেওয়ার পথে কিংবা চিকিৎসাধীন অবস্থায়। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গ থেকে পাওয়া তথ্যও এ সংখ্যাকে নিশ্চিত করে।

এ মহাসড়কের গুরুত্ব বোঝা যায় এর ব্যবহার থেকেই। প্রতিদিন ভোমরা স্থলবন্দর, বেনাপোল ও যশোরের নানা শিল্প অঞ্চল থেকে পণ্যবাহী ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহন চলে ঢাকামুখী পথে। ২০১৮ সালে জিরো পয়েন্ট থেকে সুহাশিনী বাজার পর্যন্ত ৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ অংশ পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং ২০২০ সালের জুনে শেষ হয়। প্রতি কিলোমিটারে প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই সড়ক পুনর্নির্মাণের পাঁচ বছরের মধ্যেই হয়ে উঠেছে বেহাল। বিশেষ করে জিরো পয়েন্ট থেকে কৈয়া পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার অংশ সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। কোথাও বিটুমিন উঠে গেছে, কোথাও পিচ সরে ঢিবি তৈরি হয়েছে, আবার কোথাও সড়ক দেবে গেছে। অনেক জায়গায় ঢেউয়ের মতো হয়ে আছে সড়ক। কিছু স্থানে ইটের সলিং দিয়ে যান চলাচল চালু রাখা হলেও নিরাপত্তাহীনতা রয়েই গেছে।

স্থানীয়রা শুরু থেকেই সড়কের গুণগতমান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। খুলনা উন্নয়ন কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, ‘শুরু থেকেই এ সড়কের কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন ছিল। এখন প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটছে। সড়ক নির্মাণে দুর্নীতির দায় যারা নিয়েছে, তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, কয়েকশ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত একটি সড়ক মাত্র পাঁচ বছরে ব্যবহারযোগ্যতা হারানো জনস্বার্থের প্রতি চরম অবহেলা এবং দুর্নীতির প্রমাণ। তার দাবি, দ্রুত সংস্কার না হলে এই সড়ক আরও ভয়াবহ মরণফাঁদে পরিণত হবে।

এ প্রসঙ্গে সড়ক ও জনপথ বিভাগের খুলনা অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তানিমুল হক বলেন, ‘সড়কটি পুনর্নির্মাণের পর যান চলাচলের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে ভোমরা বন্দরের পাথর ও ভারী পণ্যবাহী ট্রাক এ পথে চলাচল করে। অতিরিক্ত চাপেই সড়কের ক্ষতি হয়েছে। দ্রুত সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

এ মহাসড়ক কেবল একটি রাস্তা নয়, এটি একটি অঞ্চলের অর্থনীতি, জীবনযাত্রা এবং মানুষের নিরাপত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি সড়ক নির্মাণ মানে শুধু বিটুমিন ও পিচ দিয়ে রাস্তা বানানো নয়, বরং সেটি যেন মানুষের জীবন রক্ষা করে, সেটাই সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হওয়া উচিত। আজ এ রাস্তায় যে রক্ত ঝরছে, সেই দায় শুধু রাস্তার নয়—এটি একটি নীতির, একটি ব্যবস্থার, একটি দায়িত্ববোধের অভাবের প্রতিচ্ছবি। এখন প্রয়োজন সৎ উদ্যোগ, স্বচ্ছতা ও জরুরি সংস্কার, যাতে এই সড়ক মানুষের মৃত্যুর কারণ না হয়ে, জীবনের পথ হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন

Lading . . .