Advertisement

এখন রাজমিস্ত্রির জোগালি চাটমোহরের প্রবীণ শিক্ষক!

যুগান্তর

প্রকাশ: ১০ আগস্ট, ২০২৫

24obnd

জীবনের ৪৮টি বছর পার করেছেন শিক্ষকতা করে। অনেকেই তার কাছে প্রাইভেট পড়ে হয়েছেন বড় মানুষ। ক্যারিয়ারের উচ্চ শিখরে পৌঁছেছেন। মাস শেষে অনেক শিক্ষার্থী টাকা দিয়েছে আবার কেউবা দিতে পারেনি। কিছুই বলেননি তিনি। রোজ ভোরে ভাঙাচোরা একটি সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন, ফিরতেন গভীর রাতে। কিন্তু আজ তিনি ভাগ্যের কাছে অসহায়। তিনি শিক্ষক গয়ানাথ সরকার।

পাবনার চাটমোহর উপজেলার বিলচলন ইউনিয়নের কুমারগাড়া গ্রামের এই প্রবীণ শিক্ষক হারিয়েছেন শিক্ষকতা। একসময় যার হাতে ও পকেটে কলম থাকত, সেই মানুষটি এখন রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসাবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। স্ত্রী ও তিন সন্তানের ভরণপোষণ এবং পড়ালেখার খরচ জোগাতে হিমশিম খাওয়া এই মানুষটি কোনো কাজ না পেয়ে এখন করুণ বাস্তবতার মুখোমুখি!

শনিবার সকালে পৌর শহরের সাহাপাড়া মহল্লায় একটি বাড়িতে বস্তায় করে বালু টানার সময় কথা হয় এই শিক্ষকের সঙ্গে। জানান, ১৯৮৪ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি পাশ করেন তিনি। কিন্তু পরিবারের দারিদ্র্যের কারণে পড়ালেখার পাঠ চুকে যায়। শুরু করেন প্রাইভেট পড়ানো। পাশাপাশি দিনমজুরির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ছোটবেলা থেকেই ইংরেজি ও অঙ্কে পারদর্শী গয়ানাথ সরকার পরবর্তীতে শিক্ষকতা পেশায় মনোনিবেশ করেন।

দিন-রাত ব্যাচ আকারে প্রাইভেট পড়াতে থাকেন। অল্প সময়ের মধ্যেই অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে গয়ানাথের শিক্ষকতার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বাড়ি বাড়ি পড়ানো শুরু করেন। এরপর পৌর শহরে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে চাকরি পান। অল্প বেতন হলেও শুধু সম্মানের আশায় এই পেশাককে আঁকড়ে ধরে থাকেন।

দারিদ্র্যের কারণে নিজের পড়ালেখা হয়নি বলে তিন সন্তানকে মানুষ করার ব্রত নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে থাকেন এই মানুষটি। বড় ছেলে পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে, দ্বিতীয় ছেলে দশম শ্রেণিতে এবং মেয়ে ৭ম শ্রেণিতে পড়ে। প্রাইভেট পড়িয়ে এবং ওই কেজি স্কুলে চাকরি করে যে টাকা আয় করতেন তাতে করে ভালোই চলত তার। কিন্তু বেতন না বাড়ায় স্কুলের চাকরি ছেড়ে দেন গয়ানাথ সরকার। এরপর প্রাইভেট পড়ানোয় সীমাবদ্ধ থাকেন। কিন্তু এবার গয়ানাথের ভাগ্যে নেমে আসে অন্ধকার।

পৌর শহরের বিভিন্ন স্কুলের যেসব ছাত্রছাত্রীকে প্রাইভেট পড়াতেন তিনি, সেসব স্কুল থেকে অভিভাবকদের বলা হয়, ‘স্কুলের শিক্ষকদের কাছে না পড়ালে নম্বর কম পেলে এ জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।’ এরপর থেকেই একে একে কমতে তাকে গয়ানাথের শিক্ষার্থীর সংখ্যা। একটা সময় পুরোপুরি বেকার হয়ে পড়েন প্রবীণ এই শিক্ষক।

একদিকে সংসার চালানো, অন্যদিকে সন্তানদের পড়ালেখার খরচ জোগাতে হিমশিম খাওয়া গয়ানাথ বেছে নেন রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ। দিনশেষে হাজিরা পান ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। গয়ানাথের মেধা ও কলমের ছোঁয়ায় কেউ হয়েছেন ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার আবার কেউ বা হয়েছেন সমাজের প্রতিষ্ঠিত মানুষ। কিন্তু কেউ খোঁজ রাখেন না তাদের প্রিয় এই স্যারের! যে মানুষটি একসময় ছাত্রছাত্রীদের জীবনের ভিত গড়ে দিতেন, সেই মানুষটি এখন মানুষের বসবাসের ভিত গড়ার কাজ করে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করছেন। লজ্জা পেলেও জীবনের প্রয়োজনে চাটমোহরের এই প্রবীণ শিক্ষক এখন হয়েছেন রাজমিস্ত্রির জোগালি। ইব্রাহিম হোসেন মোল্লা নামের এক অভিভাবক যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার ছেলে ছোটবেলায় অঙ্কে দুর্বল ছিল। অনেক দূর থেকে প্রতিদিন গয়ানাথ স্যারের কাছে নিয়ে আসতাম। সে এখন কলেজে পড়ে। অঙ্কটাও এখন ভালো পারে। কিন্তু অবাক হচ্ছি দ্যুতি ছড়ানো একজন শিক্ষককে রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করতে দেখে!’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই প্রতিবেদককে গয়ানাথ সরকার বলেন, ‘ছাত্র অবস্থাতেই আমি প্রাইভেট পড়ানো শুরু করি। দীর্ঘসময় ধরে শিক্ষকতা করে এসেছি। কিন্তু হঠাৎ করেই শিক্ষকতা পেশা থেকে ছিটকে যাব ভাবতে পারিনি। চেয়েছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে। কিন্তু আজ আমি নিরুপায় হয়ে রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করছি। এতে আমার খুব কষ্ট হলেও এটাই আমার নিয়তি!

Lading . . .