প্রকাশ: ১৭ আগস্ট, ২০২৫

সিলেটে খনিজসম্পদ লুটপাট ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি)। যদিও এ সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের শতভাগ দায়িত্ব সরকারের এই প্রতিষ্ঠানটির। অভিযোগ রয়েছে, লুটেরাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে শুধু ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রেই অতিউৎসাহী ভূমিকা পালন করেছে বিএমডি। ইজারায় শর্তের অভাব না থাকলেও সেসব শর্ত পালন করছে কিনা তা কখনো পর্যবেক্ষণ করতেও দেখা যায়নি। যে কারণে ধ্বংস হয়েছে সিলেট অঞ্চলের পরিবেশ। এসব অভিযোগ পরিবেশবাদীদের। তাদের দাবি, গত ২৫ বছরে লুটপাটে যে পরিমাণ সরকারি সম্পদের ক্ষতি হয়েছে তার দায়ে এই সময়ে যেসব কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন তাদের জবাদিহিতার আওতায় আনতে হবে। তবে বিএমডির মহাপরিচালক মো. আনোয়ারুল হাবিব বলছেন নানা সীমাবদ্ধতার কথা।
নথিপত্র পর্যালোচনা করে জানা যায়, সংরক্ষিত কোম্পানীগঞ্জ শাহ আরেফিন টিলায় পাথর তুলতে ৬১ একর ভূমি ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো মেসার্স মোস্তাক আহমেদ এন্টারপ্রাইজকে ইজারা দেওয়া হয়। এরপর ২০০০ সালে চৌধুরী সুলতান আহমদ ও ছাতকের জয়নাল, ২০০২ সালে সিলেট জেলা বিএনপির প্রয়াত নেতা এমএ হকের স্ত্রী রওশন জাহান চৌধুরীর মালিকানাধীন মেসার্স রিয়াসাদ এন্টারপ্রাইজ এবং একই সময়ে বজলুল হককেও পৃথক ইজারা দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। যদিও ১৯৯৫ সালের পরিবেশ আইন ৬ (খ) অনুযায়ী টিলা বা পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ। সেই আইনের তোয়াক্কা না করেই এই ইজারা দেওয়া হয়। পরিবেশবাদীরা নানাভাবে প্রতিবাদ করলেও ২০০৪ সালের এপ্রিলে টিলায় পাথর তোলার জন্য বশির এন্ড কোম্পানিকে এক বছরের ইজারা দেয় বিএমডি। পরের বছর এই ইজারা নবায়ন করা হয়। ইজারায় পাথর উত্তোলনে পরিবেশ সংরক্ষণসহ ১৩টি শর্তও দেওয়া হয়। যার কোনটিই মানেনি ইজারাদার। ফলে ১৩৭.৫০ একর টিলাই এখন পুকুরে পরিণত হয়েছে।
এরপর লোক দেখানো ইজারা বাতিল করে ইজারাদারকে আদালতে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে সংস্থাটি। টিলার তথ্য গোপন করে আদালত থেকে পাথর উত্তোলনের অনুমতিও পায় ইজারাদার। আদালতে জোরালো ভূমিকা না রেখে পাথর উত্তোলনের সুযোগ করে দিয়েছিল বিএমডি। এরপর থেকে ২০২০ সালে স্থানীয় প্রশাসনের কঠোরতায় পাথর উত্তোলন বন্ধ হলেও গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে যে ধ্বংসলীলা শুরু হয়েছে তা এখনো চলমান। স্থানীয়দের হিসাবে প্রায় ২শ কোটি টাকার পাথর এখান থেকেই লুট হয়েছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা তো দূরের কথা একদিন ঘুরেও দেখেনি বিএমডি।
২০০০ সালের আগে সিলেট অঞ্চলে পাথর উত্তোলনের জন্য জাফলং ও ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারী ইজারা দেয়া হতো। শর্ত অনুযায়ী সনাতন পদ্ধতিতেই পাথর উত্তোলন হতো। হাজারো শ্রমিক হাত দিয়ে পাথর উত্তোলন করতেন। ইজারায় পাথর উত্তোলনে পরিবেশ সংরক্ষণসহ ১৩টি শর্ত দেওয়া হয়। খনি ও খনিজসম্পদ বিধিতে রয়েছে-পাথর তুলতে কোনো প্রকার যন্ত্রের ব্যবহার করা যাবে না। কোয়ারিতে ৩০ ফুট গভীর গর্ত করা যাবে। ইজারা শেষে ইজারাদার ওই সব গর্ত ভরাট করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু ২০০১ সালের পর এসব শর্ত ভঙ্গ শুরু হয়। প্রতিটি পাথর কোয়ারিতে সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে যন্ত্রদানব নামানো হয়। ৩০ ফুটের স্থানে তিনশ ফুট গর্ত করে পাথর উত্তোলন শুরু হয়। স্থানীয়ভাবে পরিচিত বোমা মেশিন ব্যবহার করে ৬০ ফুট নিচে পাইপ ঢুকিয়ে সেখান থেকে পাথর আনা হয়। গর্তে পড়ে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭৮ জন শ্রমিকের মৃত্যুও হয়েছে। অভিযোগ আছে, ইজারাদারদের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে বিএমডি। ফলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় পাথর কোয়ারিগুলো। সব ধ্বংসের পর ২০১৯ সালে ইজারা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
এরপর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত স্থানীয় প্রশাসনের কঠোর নীতির কারণে বন্ধ হয় পাথর উত্তোলন। কিন্তু এরপর পরিবর্তিত পরিস্থিতে আবারও শুরু হয় লুটপাট। শাহ আরেফিন টিলা, ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর ও জাফলং থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় হাজার কোটি টাকার পাথর লুটপাট হয়েছে। কিন্তু তাতেও কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি প্রতিষ্ঠানটিকে। সবশেষ সাদা পাথর লুটপাটের ঘটনায় দেশব্যাপী সমালোচনা শুরু হলে ২ হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ১৫ আগস্ট কোম্পানীগঞ্জ থানায় মামলা করে খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর মহাপরিচালক। কিন্তু জাফলং, শাহ আরেফিন টিলায় যে ধ্বংসযজ্ঞ ও লুটপাট হয়েছে তার বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলা সিলেটের সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আক্তার যুগান্তরকে বলেন, সিলেট অঞ্চলের পরিবেশ বিনষ্ট করার দায় বিএমডি এড়াতে পারে না। তিনি বলেন, পাথর কিংবা বালু উত্তোলনের জন্য তারা সব সময় ইজারা দিতেই তৎপর ছিলেন। সেখানে পরিবেশের কেমন ক্ষতি হবে এমনকি ইজারা দেওয়ার পর শর্ত মানছে কিনা তাও কোনোদিন পর্যবেক্ষণ করেনি।
বাপা সিলেট জেলার সহসভাপতি অ্যাডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম বলেন, বিএমডির এই পাথর বালু দেখভাল করার কথা। কিন্তু কখনো তারা তাদের কোনো দায়িত্ব পালন করেননি। স্থানীয় প্রশাসনের ওপর সব দায় দিয়ে তারা শুধু লিজ মানি নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তারা চাইলে এসব লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে অনেক আগেই ব্যবস্থা নেওয়া যেত।
এ বিষয়ে খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. আনোয়ারুল হাবিব বলেন, আমি ৩ মাস হলো এখানে মহাপরিচালক হিসাবে দায়িত্ব নিয়েছি। আগে কি হয়েছে তা জানা নেই। তবে দেখভাল করার কথা থাকলেও জনবল স্বল্পতায় তা করা যায়নি। দেখভাল করার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের ওপরই নির্ভরশীল থাকতে হয়েছে। জাফলং ও শাহ আরেফিন টিলায় তো প্রায় দুই কোটি ঘনফুট পাথর লুট হয়েছে সে বিষয়ে মামলা করেননি কেন জানতে চাইলে তিনি জানান, এই মুহূর্তে তার কাছে এমন কোনো তথ্য নেই।
মামলার পর গ্রেফতার ৫ : কোম্পানীগঞ্জ (সিলেট) প্রতিনিধি জানান, ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর থেকে পাথর লুটপাটের ঘটনায় শুক্রবার রাতে কোম্পানীগঞ্জে মামলা হয়েছে। এরপর ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান জানান, গ্রেফতাররা হলেন-উপজেলার কালাইরাগ গ্রামের মৃত সিকন্দর আলীর ছেলে কামাল মিয়া ওরফে পিচ্চি কামাল, একই গ্রামের কামাল মিয়ার ছেলে আবু সাঈদ ও নাজিরেরগাঁওয়ের মৃত মনফর আলীর ছেলে আবুল কালাম। তাদের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া ভাঙা সাদা পাথর ট্রাক দিয়ে পরিবহণকালে সিলেট-ভোলাগঞ্জ মহাসড়কের বিমানবন্দর চেকপোস্টে উপজেলার লাছুখাল গ্রামের শহিদ মিয়ার ছেলে ইমান আলী ও জাহাঙ্গীর আলমকে ধরা হয়েছে।