প্রকাশ: ১০ আগস্ট, ২০২৫

মনোয়ারা বেগম (৬৫)। স্বামী মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। ছেলে সন্তান নেই। মেয়ের বাড়িতেই থাকেন। জ্বর, সর্দি, কাশি কিংবা অন্য কোনো রোগে অসুস্থ হলেও ছুটে যান বাড়ির পাশে কমিউনিটি ক্লিনিকে। সেখানে ডাক্তার (কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডার) দেখিয়ে ওষুধ নেন। তাতেই তিনি সুস্থ হন। জ্বর-সর্দিতে অসুস্থ হওয়ায় বৃহস্পতিবার কমিউনিটি ক্লিনিকে যান পরামর্শ নিতে। হেলথ প্রোভাইডার জানান, ওষুধ সরবরাহ নেই। খালি হাতে বাড়ি ফিরছিলেন মনোয়ারা বেগম। ক্লিনিকের সামনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা। মনোয়ারা বেগম বলছিলেন, শুধু আজকে না-কয়েক মাস ধরে সব ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না। ওষুধ পেলে আমাদের মতো গরিব মানুষের খুবই উপকার হয়। আমার তো ইনকাম করার মতো কেউ নেই। ক্লিনিকের ওষুধই ভরসা। বলছিলাম যশোরের মণিরামপুর উপজেলার রোহিতা ইউনিয়নের বাসুদেবপুর কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা নিতে আসা বৃদ্ধ মনোয়ারা বেগমের কথা। একই এলাকার নূর জাহান বেগম (৬০) বলেন, বাড়ির পাশের ক্লিনিক আমাদের ভরসা। বেশ কিছুদিন ধরে আমরা ওষুধ পাচ্ছি না। শিশুকে নিয়ে ক্লিনিকে এসেছিলেন খাদিজা বেগম (৪০)। তিনি বললেন, ‘কয়দিন ধরে বাচ্চাটার জ্বর। আমরা বাড়ির সবাই অসুস্থ। ডাক্তার দেখাতে এসেছিলাম। ডাক্তার বলছে, ওষুধ নেই। তাই খালি হাতে ফিরে যাচ্ছি। ফ্রি সরকারি ওষুধ পেলে আমাদের অনেক উপকার হয়।’
শুধু মণিরামপুরের বাসুদেবপুর কমিউনিটি ক্লিনিক নয়, যশোর জেলার ২৮৩টি কমিউনিটি ক্লিনিকে ওষুধ সংকট প্রকট হয়েছে। স্বাস্থ্য পরামর্শ নিয়ে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে অধিকাংশ রোগীকে। প্রায় ৮ মাস ধরে চাহিদা অনুযায়ী ২৭ প্রকারের সরকারি ওষুধ সরবরাহ না থাকায় তৃণমূলের দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিনামূল্যের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শুক্রবার বাদে সপ্তাহের ছয় দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কথা। কিন্তু অনেক ক্লিনিকে বাস্তবে উলটো চিত্র দেখা যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, বেশির ভাগ ক্লিনিক ১০টার পরে খোলা হয়, দুপুর দেড়টার পর পরই বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সেবা নিতে আসা রোগীদের পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে।
রোহিতা কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা নিতে আসা উজ্জ্বল হোসেন বলেন, ‘‘ক্লিনিকে ওষুধ নিতে আসলেই বলে নেই। এজন্য অনেকদিন বাদে আজ এসেছিলাম। আজও সেই একই কথা বলল ‘ওষুধ নেই’। আসলেই ওষুধ নেই, নাকি ইচ্ছামতো কেউ কেউ নিয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারি না।’’
বাসুদেবপুর গ্রামের বাসিন্দা ও কমিউনিটি ক্লিনিকের জমিদাতা মশিয়ার রহমান বলেন, ‘ক্লিনিক চালু হওয়ার পর থেকে এলাকার দরিদ্র মানুষের খুবই উপকার হচ্ছে। বাড়ির পাশে মানুষ চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে ওষুধ সংকট দেখা যাচ্ছে। দ্রুত ওষুধ সরবরাহ করা হোক।’
বাসুদেবপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথকেয়ার প্রোভাইডার মিতা রাণী দত্ত বলেন, ‘কমিউনিটি ক্লিনিকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরামর্শ ও ২৭ রকমের সরকারি ওষুধ বিতরণ করা হয়। দুই সপ্তাহ হচ্ছে ২০-২২টি রকমের ওষুধ সরবরাহ নেই। ওষুধের সংকট থাকলেও আমাদের সেবা বন্ধ নেই। আমরা নিয়মিত সেবা দিচ্ছি। পাশাপাশি যে ওষুধগুলো আছে, সেগুলো মানুষকে দিচ্ছি।’ ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডার দেবব্রত সরকার বলেন, ‘ওষুধ সংকট থাকায় শুধু স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে। মানুষকে নিয়মিত সেবা দিচ্ছি।’
এ বিষয়ে রোহিতা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান বলেন, ‘রোহিতা কমিউনিটি ক্লিনিকে ৫ গ্রামের মানুষ সেবা পায়। সেখানে সব সময় রোগীর চাপ থাকে। বছরে একবার ওষুধ সরবরাহ হয়েছে। এতে সংকট বেড়েছে। মানুষ ওষুধ পাচ্ছে না। দরিদ্র জনগোষ্ঠী সরকারি সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছে।’
এ বিষয়ে যশোর সিভিল সার্জন ডা. মাসুদ রানা বলেন, ‘আট মাস ধরে কমিউনিটি ক্লিনিকে ওষুধ সংকট রয়েছে। আমরা প্রতি মাসেই চাহিদা পাঠাচ্ছি। স্বল্প পরিসরে সরবরাহ হচ্ছে। এতে চাহিদা মিটছে না। প্রান্তিক পর্যায়ে দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। জনগণ খালি হাতে ফিরছে এটাও সত্যি। তবে আগামী মাস থেকে স্বাভাবিক হতে পারে বলে আশা করছি।’