গাড়ির ভেতর বিষাক্ত গ্যাস, সন্দেহ হলে কী করবেন
প্রকাশ: ১৮ আগস্ট, ২০২৫

১৩ আগস্ট প্রথম আলো অনলাইনের একটি সংবাদের শিরোনাম—‘ ’। এ প্রতিবেদনে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে বলা হয়, লাশ উদ্ধারের সময় পরীক্ষা–নিরীক্ষায় দেখা যায়, অনেক সময় ধরে চালু থাকার কারণে গাড়ির গ্যাস শেষ হয়ে গিয়েছিল। এমনকি ব্যাটারির চার্জও শেষ হয়ে গিয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে, গাড়িটি থেকে প্রচুর পরিমাণ গ্যাস বের হয়ে কার্বন মনোক্সাইড তৈরি হয়। আবার দীর্ঘ সময় এসি চালু থাকায় সেখান থেকেও অতিমাত্রায় কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস বের হয়ে থাকতে পারে। এই গ্যাস শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে তাঁদের শরীরে প্রবেশ করে তাঁদের মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে।
ওই খবরেই জানানো হয়, এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট ঢাকার সেগুনবাগিচা এলাকায় গাড়ির ভেতর থেকে দুই মোটরশ্রমিকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২০২২ সালের ১৮ আগস্ট গাজীপুর নগরের খাইলকুর এলাকায় গাড়ির ভেতর থেকে শিক্ষক দম্পতির লাশ উদ্ধার করা হয়। দুটি ঘটনায়ই মৃত্যুর জন্য গাড়ির বিষাক্ত গ্যাসকে দায়ী করে তদন্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ।
বিভিন্ন সময় বিদেশি সংবাদমাধ্যমেও এমন শিরোনাম পাওয়া যায়। দেখা যাচ্ছে, গাড়ির ভেতর তৈরি হওয়া কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসকে এসব মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হচ্ছে।
কার্বন মনোক্সাইড রং ও স্বাদহীন বিষাক্ত গ্যাস। একে বলা হয় নীরব ঘাতক। জীবাশ্ম জ্বালানিতে (যেমন বিভিন্ন পেট্রোলিয়াম) থাকা কার্বন পোড়ানোর ফলে এটি তৈরি হয়। কার্বন মনোক্সাইডের প্রতি আমাদের শরীরে রক্তের ভেতরে থাকা হিমোগ্লোবিনের ব্যাপক আসক্তি আছে।
রক্ত হিমোগ্লোবিনের মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্কসহ শরীরের ভেতরে অক্সিজেন পরিবহন করে, যা বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। কিন্তু এই হিমোগ্লোবিন যদি কার্বন মনোক্সাইডের সংস্পর্শ পায়, তবে তা অক্সিজেন পরিবহন বাদ দিয়ে কার্বন মনোক্সাইড পরিবহন করতে শুরু করে। ফলে শরীর, বিশেষ করে মস্তিষ্কে অক্সিজেনশূন্যতা তৈরি হয়।
অক্সিজেনশূন্যতার কারণে মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, মাথা ঝিমঝিম, বমি ভাব, সর্দি-জ্বর, অতিরিক্ত ক্লান্তি, অবসাদ, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, অবাস্তব জিনিস দেখা বা শোনা, পেটে ব্যথা, দৃষ্টিশক্তিতে পরিবর্তন, ঘুম ঘুম ভাব, খিঁচুনি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। আর পুরোপুরি অক্সিজেনশূন্যতায় মৃত্যু যে অনিবার্য, এটা আমরা সবাই জানি।
গাড়ির ইঞ্জিনে সাধারণত জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করা হয়। এর ফলে সেখানে কার্বন মনোক্সাইডসহ বেশ কিছু গ্যাস তৈরি হয়। সব গ্যাস ক্ষতিকরও নয়। যেমন নাইট্রোজেন।
এসব গ্যাস আবার এগজস্ট সিস্টেমের (নিঃসরণপদ্ধতি) মাধ্যমে গাড়ি বাইরে বের করে দেয়। কোনো কারণে এগজস্ট সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা মরিচা ধরে ফুটো হয়ে গেলে তা গ্যাস বাইরে বের করে দিতে পারে না। তখন এই গ্যাস গাড়ির ভেতরেই জমা হয়।
অনেক সময় কেউ কেউ গাড়ির পেছনের বুট খুলে রেখে গাড়ি চালান। এমন হলে তা এগজস্ট সিস্টেমে বের হওয়া গ্যাসকে গাড়ির ভেতরেই জমা করে। সাধারণত পুরোনো গাড়িতে এসব সমস্যা বেশি দেখা দেয়। তবে নতুন গাড়িও ঝুঁকিমুক্ত নয়।
এগজস্ট সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া গাড়ি যদি কেউ আবদ্ধ জায়গায় রেখে ইঞ্জিন চালু রাখেন, তবে সেই গাড়িতে গ্যাস জমা হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। বেশির ভাগ গ্যাসজনিত দুর্ঘটনার শিকার গাড়িতে এমন ঘটনাই ঘটেছে। হয়তো কেউ গ্যারেজ বা আবদ্ধ জায়গায় গাড়ি নিয়ে ইঞ্জিন চালু রেখে ভেতরে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তখনই ঘটেছে দুর্ঘটনা।
কার্বন মনোক্সাইড যেহেতু বর্ণ ও স্বাদগন্ধহীন গ্যাস, কাজেই এটা মানুষকে আক্রান্ত করলে প্রথমে তা বোঝা যায় না। যতক্ষণে বোঝা যায়, ততক্ষণে দেরি হয়ে যায়। তাই বোঝাই যাচ্ছে, দুর্ঘটনা এড়াতে গাড়িতে ইঞ্জিন চালু রেখে আবদ্ধ জায়গায় ঘুমানো যাবে না। বিশেষ করে গাড়ির দরজা, জানালা বন্ধ করে তো নয়ই। গাড়ির পেছনের বুট খুলেও চালানো ঠিক নয়।
বদ্ধ পিকআপ ভ্যানের ভেতর যাত্রী নেওয়া যাবে না। যখনই গাড়িতে থাকা অবস্থায় মাথা ঘোরাসহ কার্বন মনোক্সাইডজনিত লক্ষণ দেখা দেবে, বের হয়ে যেতে হবে। এরপর গাড়ির এগজস্ট সিস্টেম পরীক্ষা করতে হবে। সর্বোপরি গাড়িতে কার্বন মনোক্সাইড মনিটর লাগিয়ে নিতে হবে, যা এগজস্ট সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গ্যাস জমলে তার মাত্রা আপনাকে জানিয়ে দেবে।
গাড়ি হোক নিরাপদ যাত্রার উপযোগী, মৃত্যু সহযোগী নয়।
সূত্র: হোগান অ্যান্ড সন্স