প্রকাশ: ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

শরীর ঘেঁষে চলে গেল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রজাতির মাছ হোয়েল শার্ক, পানিতে পাখা মেলে উড়ছে মান্টা রে, পাশে গম্ভীর অভিজাত ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে ভেসে চলেছে জায়ান্ট গ্রুপার, শান্ত কচ্ছপ, জেব্রার মতো ডোরাকাটা হাঙর, ঢেউয়ের মতো হেলেদুলে নেচে বেড়াচ্ছে গোমুখো রে (কাউনোজ রে), মাথার ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে দল বেঁধে উল্লাস করছে রুপালি টারপন। আমি যেন আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে গিয়েছি। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় অ্যাকুয়ারিয়ামে প্রবেশের পর অথই জলে যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম।
জর্জিয়ার রাজধানী আটলান্টায় বেড়াতে আসা বেশির ভাগ মানুষই এই অ্যাকুয়ারিয়াম না দেখে ফেরেন না। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি এ অ্যাকুয়ারিয়ামটি ২০১২ সাল পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় অ্যাকুয়ারিয়ামের রেকর্ড ধরে রেখেছিল। প্রায় আট হেক্টর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত অ্যাকুয়ারিয়ামে প্রধান গ্যালারি সাতটি। এই গ্যালারিগুলোতে ১১ মিলিয়ন গ্যালন (৪ কোটি ২০ লাখ লিটার) পানিতে ৫০০ প্রজাতির এক লাখের বেশি জলজ প্রাণী আছে।
দীর্ঘ লাইন পার হয়ে সকাল ৯টায় ঢুকেছি। প্রথমেই একটি টানেল। নাম ওসান ভয়েজার। স্বচ্ছ কাচের টানেলটির ভেতর নিজেকে মনে হচ্ছিল আটলান্টিক মহাসাগরের গভীরে নামা এক ডুবুরি। শুধু আমিই নই, অনেক দর্শকের চোখেও বিস্ময়। আমার বাঁ হাতের তর্জনী ধরে হাঁটছিল সদ্য দুই বছর পেরোনো নোরা। আমার নাতনি। সঙ্গে আরও আছে নোরার মা অনন্যা, নানু জ্যোৎস্না, চাচু শিমু, বাবা শুভ।
ওসান ভয়েজারের পর একে একে সাতটি গ্যালারি। গ্যালারিগুলোতে পৃথিবীর জলভাগের প্রাণবৈচিত্র্যের সৌন্দর্য ও সম্পদ দেখে অবাক হয়েছি। দেখেছি কোল্ড ওয়াটার কোয়েস্টে ধবধবে সাদা বেলুগা হোয়েল, আফ্রিকান পেঙ্গুইন আর জাপানি স্পাইডার ক্র্যাব। বিচিত্র রঙে ভরা রঙিন ট্রপিক্যাল ডাইভার গ্যালারিতে দেখলাম চোখধাঁধানো ক্লাউনফিশ, জেলিফিশ আর ছোট রঙিন ফানুসের মতো গার্ডেন ইল। রিভার স্কাউট গ্যালারিতে গিয়ে দেখি জর্জিয়া থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত নানা নদীর রূপ ও প্রাণ। পিয়ের ২২৫ গ্যালারিতে দেখলাম হাস্যোজ্জ্বল সি লায়নদের কসরত। প্রিডেটরস অব দ্য ডিপ গ্যালারিতে দেখলাম টাইগার শার্ক আর গ্রেট হ্যামারহেড।সারলাম।
অ্যাকুয়ারিয়ামের সাতটি গ্যালারি যেন পৃথিবীর সাত মহাদেশের সব জলজ প্রাণীর মহাসম্মিলন কেন্দ্র। যেখানে যত জলজ, উভচর ও মাছখেকো জীবন্ত প্রাণী দেখেছি, সবখানে সেগুলোর বিবরণ আছে। আর প্রতিটি গ্যালারিতেই ছিলেন ধারাভাষ্যকার। তাঁরা প্রতিটি প্রাণীর জীবনচক্র, জীবনধারণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছিলেন। আর প্রতিটি কোনায়, প্রতিটি জায়গায় নানা পোস্টারে, প্ল্যাকার্ডে, ধারাভাষ্যে মূল সুর একটাই, এই প্রাণীগুলো আমাদের পৃথিবীর বাসিন্দা। এদের আমরা ভালোবাসব। এদের বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এরা না বাঁচলে আমরাও বাঁচব না।
দেখতে দেখতে কখন যে দেড়টা বেজে গেছে, বুঝতেই পারিনি। হাঁটতে হয়েছে প্রচুর। এখনো ডলফিন কোস্টসহ অনেক কিছু দেখার বাকি। কিন্তু পেটে ক্ষুধা জানান দিচ্ছে। অ্যাকুয়ারিয়ামের ভেতরেই একটি মনোরম রেস্তোরাঁয় পিৎজা দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ
দুপুরের খাবারের পর গেলাম ডলফিন কোস্টে। এটি থিয়েটারের বিশাল অডিটরিয়ামের মতো। এখানে একসঙ্গে শো দেখতে পারবে ১ হাজার ৮৮০ জন মানুষ। আধঘণ্টার শোতে ডলফিনের নানা কসরত দর্শকদের আনন্দ দিয়েছে প্রচুর। ওগুলো মানুষের নির্দেশমতো জলের ওপর নাচছিল, শূন্যে ডিগবাজি দিচ্ছিল। ডলফিনদের সঙ্গে বেশ কয়েকজন ট্রেইনার। তাঁদের পারফরম্যান্সও অবাক করার মতো। একপর্যায়ে নিপুণ সাঁতারুর মতো পানিতে ঝাঁপ দিলেন একজন পারফরমার। কিছুক্ষণ পর মেয়েটিকে একটা ডলফিন তার ঠোঁটের আগায় নিয়ে দ্রুতগতিতে পাড়ে তুলে দিল। জলের ঝলকে ডলফিনের ক্ষিপ্রতায় মনে হলো একজন মৎস্যকন্যা উঠে এল বুঝি। প্রাণীটির কুশলতায় সবাই একযোগে শিস আর করতালি দিয়ে মুখর করে তুলল পুরো মিলনায়তন।
আমাদের জন্য আরও অনেক নতুন নতুন চমক অপেক্ষা করছিল। জুলাইয়ের প্রলম্বিত বিকেলে আমরা দেখেছি পানির তলে ডুবুরিদের আনাগোনা, অ্যাক্রোবেটিক শোর মধ্যে সংগীত, আলোর ঝলকানির মধ্যে শিল্পীদের নিখুঁত কসরত, লাফালাফি, ঘূর্ণি, ভারসাম্য বা স্টান্টের খেলা। নয়টার দিকে সন্ধ্যা নামল, দিনের আলো নিভে এল, তখনো আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত জলের জগৎ। সে আলো আমাদের স্মৃতি থেকে কখনো মুছবে না। আসার সময় এক বয়স্ক কর্মী আমাদের বললেন, ‘গুডবাই। পৃথিবীর সব প্রাণীকে আমরা যেন ভালোবাসতে শিখি। এমন কোনো কাজ আমরা করব না, যাতে প্রাণীগুলো আমাদের ঘৃণা করে।’ তাঁর কথা শুনে মনে পড়ে গেল নোবেল বিজয়ী রাডিয়ার্ড কিপলিংয়ের একটি কবিতার কথা। ‘রিজেকশন’ (প্রত্যাখ্যান) নামের সেই কবিতায় সমুদ্র ঘৃণাভরে একটা লাশকে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিল—এটাকে ফিরিয়ে নাও, আমার এখানকার প্রাণীদের খাওয়ার অনেক কিছু আছে, এটা না খেলেও চলবে।