Advertisement

কুখ্যাত সেই ‘বিকিনি কিলার’কে নিয়ে একের পর এক সিনেমা-সিরিজ...

প্রথম আলো

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

চার্লস শোভরাজকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে অনেক সিনেমা ও সিরিজ। কোলাজ
চার্লস শোভরাজকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে অনেক সিনেমা ও সিরিজ। কোলাজ

এশিয়ার অপরাধজগতের খোঁজখবর রাখলে চার্লস শোভরাজের নামটা আপনার অপরিচিত হওয়ার কথা নয়। তাঁর কুখ্যাতি এমনই যে এখনো একের পর এক সিনেমা–সিরিজ নির্মিত হচ্ছে তাঁকে নিয়ে। সবশেষ নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে ‘ইন্সপেক্টর জিন্দে’। সিরিজটি মুক্তি উপলক্ষে আলো ফেলা যাক চার্লস শোভরাজের জীবনে। থাকবে তাঁকে নিয়ে নির্মিত সিনেমা সিরিজের কথাও।

পরিচালক ছবিটিকে ‘সিরিও-কমিক’, অর্থাৎ সিরিয়াস আর কমেডির মিশ্রণ-আকারে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। কিন্তু প্রয়াসটা পুরোপুরি সফল হয়নি। যার মূল দায় চিত্রনাট্যের; মাঝেমধ্যে দু–একটি দৃশ্য জমলেও, সার্বিকভাবে গতি ও রসবোধ দুটিই খেই হারিয়েছে। তারপরও একবার দেখার জন্য সিনেমাটি মন্দ নয়।

‘বিকিনি কিলার’
চার্লস শোভরাজকে বলা হতো ‘দ্য সার্পেন্ট’, কারণ, সাপের মতোই তিনি বারবার পুলিশের হাত ফসকে বের হয়ে যেতেন। এ ছাড়া ‘বিকিনি কিলার’ নামেও পরিচিত ছিলেন তিনি। কারণ, ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে ভ্রমণে আসা তরুণীদের মাদক খাইয়ে, লুট করে হত্যা করতেন তিনি। সত্তর–আশির দশকে থাইল্যান্ড, ভারত, নেপালসহ বিভিন্ন দেশে তাঁর নামে অন্তত ২০টির বেশি হত্যার অভিযোগ উঠেছিল, তবে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রমাণিত হয় মাত্র তিনটি। আসল সংখ্যা আজও রহস্য। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সংখ্যাটা আরও কয়েক গুণ বেশি।

জিন্দের আবির্ভাব
এই ভয়াবহ অপরাধীর পেছনে ধাওয়া করেছিলেন ভারতের মুম্বাই পুলিশের কিংবদন্তি কর্মকর্তা মধুকর জিন্দে। দুবার তিনি ধরেছিলেন শোভরাজকে। তাঁর সেই রুদ্ধশ্বাস অভিযান অবলম্বনেই নেটফ্লিক্স তৈরি করেছে নতুন ছবি ‘ইন্সপেক্টর জিন্দে’। ছবিতে শোভরাজকে নতুন নামে কার্ল ভোজরাজ হিসেবে দেখা যায়, যার চরিত্রে অভিনয় করেছেন জিম সার্ব। সেই পুলিশ অফিসার জিন্দের চরিত্রে অভিনয় করেছেন মনোজ বাজপেয়ি।

প্রথমবার শোভরাজকে ধরলেন জিন্দে
মুম্বাইয়ের গামদেবি থানার একেবারে সাধারণ কর্মদিবস। হঠাৎ এক সোর্স অজয় পারেখ খবর দিলেন-নিউ ইন্ডিয়া অ্যাসিওরেন্স ভবনে বড়সড় ডাকাতির পরিকল্পনা করছে এক আন্তর্জাতিক অপরাধী দল। নেতা চার্লস শোভরাজ। খবরটা পেলেন তরুণ পুলিশ কর্মকর্তা মধুকর জিন্দে।

তথ্য অনুযায়ী, শোভরাজ অবস্থান করছিলেন তাজমহল প্যালেস হোটেলে। ধোপদুরস্ত স্যুট পরা, ভদ্রলোক সেজে ছিলেন তিনি। অভিযানে গিয়ে পুলিশ হাতে পায় তাঁর সহযোগীদের, উদ্ধার করে অস্ত্রশস্ত্র। তখনই প্রথমবার ভারতের পুলিশের হাতে ধরা পড়েন চার্লস শোভরাজ।

কিন্তু এরপরের অধ্যায় যেন সিনেমার গল্প। একই বছরের শেষের দিকে পেটের ব্যথার অজুহাতে হাসপাতালে ভর্তি হন শোভরাজ। সেই সময়ই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চলছিল। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় অন্ধকারে হাসপাতালের ড্রেনের পাইপ বেয়ে উধাও হয়ে গেলেন এশিয়ার কুখ্যাত অপরাধী।

তিহার জেলে বিলাসী জীবন, তারপর...
১৯৭৬ সালে আবারও ধরা পড়লেন শোভরাজ। এবার অভিযোগ ফরাসি পর্যটক জঁ লুক সলোমনকে হত্যার। দিল্লির তিহার জেলে ১২ বছরের সাজা হলো তাঁর। তবে কারাগারে বন্দিজীবন মোটেও কষ্টকর ছিল না। বরং গারদে গড়ে তোলেন এক বিলাসী দুনিয়া-কারারক্ষীদের ঘুষ দিয়ে নিশ্চিত করতেন আরাম-আয়েশ, অতিথি আপ্যায়ন, এমনকি রঙিন সামাজিক জীবনও।

কিন্তু শোভরাজ মানেই তো পালানো। ১৯৮৬ সালে জেলের ভেতর আয়োজন করলেন এক ‘পার্টি’। কারারক্ষীদের মিষ্টির মধ্যে মিশিয়ে দিলেন ঘুমের ওষুধ। একে একে সবাই অজ্ঞান হয়ে গেলে, বিশ্বখ্যাত এই অপরাধী আবারও হাওয়া। পালিয়ে গেলেন সহযোগীর গাড়িতে চেপে।

গোয়ার রেস্তোরাঁয় ‘হ্যালো চার্লস’
এবার দায়িত্ব পড়ল পুরোনো শত্রু মধুকর জিন্দের ওপর। খবর মিলল, শোভরাজ লুকিয়ে আছেন গোয়ায়। গোয়ায় বিদেশি পর্যটকদের আড্ডাস্থল ও’কোকেইরো রেস্তোরাঁয় নজর রাখছিলেন জিন্দে। কয়েক দিন ছদ্মবেশে বসে ছিলেন সাধারণ পর্যটকের মতো।

১৯৮৬ সালের ৬ এপ্রিল রাতে রেস্তোরাঁয় ঢুকলেন টুপি পরা এক ব্যক্তি। জিন্দের চোখে সঙ্গে সঙ্গেই চেনা পড়ল-এ আর কেউ নন, চার্লস শোভরাজ। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে জিন্দে শান্ত স্বরে বললেন, ‘হ্যালো চার্লস, কেমন আছ?’ হতভম্ব শোভরাজ অস্ত্র বের করতে চাইলেও, জিন্দের দল মুহূর্তেই কাবু করে ফেলে তাঁকে।
গোয়ায় এই গ্রেপ্তারি অভিযানই আজ ভারতের পুলিশ ইতিহাসে অন্যতম রোমাঞ্চকর অধ্যায়। আর এই অভিযানের মাধ্যমে মধুকর জিন্দে হয়ে ওঠেন ভারতের জাতীয় বীর।

শোভরাজের শেষ অধ্যায়
ভারতে সাজা শেষে ১৯৯৭ সালে মুক্তি পান শোভরাজ, কিন্তু দাপট কমেনি। ২০০৩ সালে নেপালে গিয়ে আবারও ধরা পড়েন তিনি। ১৯৭৫ সালে মার্কিন নাগরিক কনি জো ব্রঞ্জিচ ও কানাডীয় লরেন্ট ক্যারিয়ের হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় তাঁর। নেপালের কারাগারে কাটাতে হয় প্রায় দুই দশক।

তবে বয়স ও অসুস্থতার কারণে ২০২২ সালে মুক্তি পান শোভরাজ। বর্তমানে তিনি ৮১ বছরের বৃদ্ধ, বাস করছেন ফ্রান্সে। হত্যার অভিযোগ এখনো ঝুলছে থাইল্যান্ডে, কিন্তু কোনো দিন তাঁকে আর সে দেশে পাঠানো হয়নি।

এখন কোথায় জিন্দে
৮৮ বছরের মধুকর জিন্দে এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। তবুও মুম্বাই পুলিশ ইতিহাসে তাঁর নাম এক উজ্জ্বল অধ্যায়। চার্লস শোভরাজকে দুবার ধরার জন্য তিনি কেবল পুলিশের কাছে নয়, সাধারণ মানুষের কাছেও কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। রাজীব গান্ধী থেকে শুরু করে দিলীপ কুমারের মতো তারকারাও তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।

সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে সেই গোয়ার রাতের ঘটনা স্মরণ করলেন জিন্দে। জানান, আধুনিক প্রযুক্তি ছাড়াই কীভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধীর খোঁজ মেলাতে হয়েছিল তাঁকে। ধৈর্য, সাহস আর নিখুঁত পরিকল্পনাই যে শেষ পর্যন্ত সাফল্যের চাবিকাঠি-তারই জীবন্ত প্রমাণ হয়ে আছেন এই অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা।

কেমন হয়েছে সিনেমাটি
নেটফ্লিক্সে সদ্য মুক্তি পাওয়া ‘ইন্সপেক্টর জিন্দে’ তৈরি হয়েছে কমেডির মোড়কে। চার্লস শোভরাজকে নিয়ে আগে সিনেমা ও সিরিজ হয়েছে। তবে কমেডির মোড়কে কখনো কিছু হয়নি। তাই চিন্ময় মান্ডেলকরের সিনেমাটি নিয়ে কৌতূহল ছিল। কেমন হলে শেষ পর্যন্ত সিনেমাটি?

চলতি বছরের শুরুতে আমরা ওটিটি সিরিজ ‘ব্ল্যাক ওয়ারেন্ট’-এ দেখেছিলাম চার্লস চরিত্রকে। এর আগে ১৯৮৯ সালে তৈরি হয়েছিল টিভি মিনি সিরিজ ‘শ্যাডো অব দ্য কোবরা’। ২০১৫ সালে ‘ম্যায় অউর চার্লস’ নামে একটি হিন্দি সিনেমাও হয়, সেখানে চার্লসের চরিত্রে অভিনয় করেন রণদীপ হুদা। ২০২১ সালে চার্লসকে নিয়ে বিবিসি বানায় মিনি সিরিজ ‘দ্য সার্পেন্ট’। এই সিরিজে চার্লসের চরিত্রে অভিনয় করেন তাহার রহিম।

কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার চার্লস শোভরাজ, যাঁকে তখন সবাই চিনতেন ‘বিকিনি কিলার’ নামে—তাঁকে ধরার লড়াই নিয়েই গড়ে উঠেছে গল্প। ছবির পরিচালক-চিত্রনাট্যকার চিন্ময় মান্ডলেকর এটিকে একধরনের সাপে-নেউলের খেলার মতো সাজিয়েছেন।
প্রধান চরিত্রে মনোজ বাজপেয়ির ইন্সপেক্টর জিন্দে ঠিক যেন তাঁরই আরেক জনপ্রিয় চরিত্র, ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’-এর শ্রীকান্ত তিওয়ারির প্রভাবে প্রভাবিত। কাহিনি এগোয় চার্লসকে ধরার অভিযানের হাস্যরসাত্মক উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার, যেসব ঘটনাকে চলচ্চিত্রে বাড়িয়ে বলা মনে হয়, সেগুলোর অনেকটাই আসলে বাস্তব। যেমন চার্লসকে গোয়া থেকে মুম্বাই নিয়ে আসার সময় ট্রেনের কামরায় তাঁর ওপর দুই পুলিশকে বসিয়ে দেওয়া, এ ঘটনা সত্যিই ঘটেছিল।
ছবির টোন হালকা, গোটা দলটিই মজার ছলে দায়িত্ব সামলাচ্ছে। প্রতিটি পুলিশ সদস্যের আলাদা আলাদা খেয়ালিপনা দর্শককে হাসায়। তবে একই সঙ্গে চার্লসের অপরাধের গুরুত্ব আড়ালে যায়নি। তবু সমস্যা আছে ছবির গতি-প্রকৃতিতে। নিরন্তর ধাওয়া একসময় একঘেয়ে মনে হয়, গল্পের পরিণতি আন্দাজ করাও সহজ হয়ে পড়ে। ফলে উত্তেজনা কিছুটা কমে আসে।

মনোজ বাজপেয়ি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ দৃঢ়তায় চরিত্রটিকে ভরিয়েছেন। কঠোরতা আর রসবোধকে মিলিয়ে তিনি জিন্দেকে জীবন্ত করেছেন। জিম সার্ব কার্লের চরিত্রে দারুণ কিন্তু মুশকিল হলো সিরিজটিতে তাঁর গুরুত্ব কম। চিত্রনাট্যে তাঁর জন্য আরও জায়গা রাখা উচিত ছিল।

পরিচালক ছবিটিকে ‘সিরিও-কমিক’, অর্থাৎ সিরিয়াস আর কমেডির মিশ্রণ-আকারে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। কিন্তু প্রয়াসটা পুরোপুরি সফল হয়নি। যার মূল দায় চিত্রনাট্যের; মাঝেমধ্যে দু–একটি দৃশ্য জমলেও, সার্বিকভাবে গতি ও রসবোধ দুটিই খেই হারিয়েছে। তারপরও একবার দেখার জন্য সিনেমাটি মন্দ নয়।

চার্লস শোভরাজকে নিয়ে আরও সিনেমা
চলতি বছরের শুরুতে আমরা ওটিটি সিরিজ ‘ব্ল্যাক ওয়ারেন্ট’-এ দেখেছিলাম চার্লস চরিত্রকে। এর আগে ১৯৮৯ সালে তৈরি হয়েছিল টিভি মিনি সিরিজ ‘শ্যাডো অব দ্য কোবরা’। ২০১৫ সালে ‘ম্যায় অউর চার্লস’ নামে একটি হিন্দি সিনেমাও হয়, সেখানে চার্লসের চরিত্রে অভিনয় করেন রণদীপ হুদা। ২০২১ সালে চার্লসকে নিয়ে বিবিসি বানায় মিনি সিরিজ ‘দ্য সার্পেন্ট’। এই সিরিজে চার্লসের চরিত্রে অভিনয় করেন তাহার রহিম।

তথ্যসূত্র: টাইম, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

Lading . . .