সানিয়ার সেই ‘কাঁঠাল’ পেল ভারতের জাতীয় স্বীকৃতি, কী আছে এতে
প্রকাশ: ৬ আগস্ট, ২০২৫

২০২৩ সাল বলিউড ছিল তারকাময়, চমকপ্রদ ও বক্স অফিসে দাপটের বছর। শাহরুখ খানের ‘পাঠান’ আর ‘জওয়ান’, সানি দেওলের ‘গদার ২ ’, রণবীর কাপুরের ‘অ্যানিমেল’, সালমানের ‘টাইগার ৩’, রণবীর-আলিয়ার ‘রকি অউর রানি কি প্রেম কাহানি’, শ্রদ্ধা-রণবীরের ‘তু ঝুটি ম্যায় মাক্কার’, অক্ষয়ের ‘ওহ! মাই গড ২ ’—এগুলোই ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। ওটিটিতেও মুক্তি পেয়েছে বড় বাজেটের আলোচিত বেশ কিছু সিনেমা। কারিনা কাপুর খান, বিজয় ভার্মা ও জয়দীপ অহলাওয়াতের ‘জানে জা’,মনোজ বাজপেয়ির ‘সির্ফ এক বান্দা কাফি হ্যায়’, মনোজ বাজপেয়ি ও শর্মিলা ঠাকুরের ‘গুলমোহর’, সুতারিয়ার ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অপূর্বা’র মতো সিনেমা ছিল এ তালিকায়। বড় তারকার ছড়াছড়ি, অ্যাকশন-থ্রিলার, রোমান্স আর রাজনীতিস্পর্শী জনপ্রিয় গল্পগুলোর ভিড়ে অনেকটা নীরবে, নির্ভারভাবে এগিয়ে গেছে একটি ছবি ‘কাঁঠাল: আ জ্যাকফ্রুট মিস্ট্রি’। যদিও বক্স অফিসের হিসাবটা এ সিনেমার ক্ষেত্রে বিবেচ্য নয়। মৌসুম যখন এসেই গেল, তাই আজ সেই ‘কাঁঠাল’ নিয়ে কিছু কথা হোক। শুরুতে বলে নিচ্ছি এটা সিনেমার রিভিউ নয়।
ওটিটিতে মুক্তি। অনাড়ম্বর আয়োজন। এ ছবিতে না ছিল খান, কাপুর, দীপিকা কিংবা আলিয়াদের মতো বড় তারকা, না ছিল চমকে দেওয়া বাজেট, না ছিল বাণিজ্যিক হিসাব-নিকাশ। ছিল শুধু এক ব্যতিক্রমী ভাবনা, ছিল সমাজব্যবস্থাকে আয়নায় দেখানোর সাহস, ছিল মৌলিক চিত্রনাট্য আর সূক্ষ্ম রসবোধে নির্মিত ব্যঙ্গ। আর এই ব্যতিক্রমী শক্তিতেই সিনেমাটি পেল ৭১তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা হিন্দি ফিচার ফিল্মের স্বীকৃতি।
একজোড়া কাঁঠাল
এই সিনেমার ‘নায়ক’ কাঁঠাল! ঠিক শুনেছেন। একজোড়া কাঁঠাল চুরি ঘটনা নিয়ে সিনেমা। শুনে মনে হতে পারে এটি নিছক হাস্যকর কিছু। ঠিক এই ঘটনাকেই উপজীব্য করে গড়ে উঠেছে ‘কাঁঠাল’-এর কাহিনি। এক বিধায়কের বাড়ির আঙিনা থেকে চুরি যায় ‘আংকেল হং’ প্রজাতির দুটি দুর্লভ কাঁঠাল। এ নিয়ে শুরু হয় রীতিমতো থানায় অভিযোগ, তদন্ত ও চাপে-চাপা এক ‘ন্যাশনাল ক্রাইসিস’। কারণ, এই কাঁঠাল মুখ্যমন্ত্রীর খুব প্রিয়। আর যদি ঠিকমতো তা উপহার না দেওয়া যায়, তাহলে বিধায়কের মন্ত্রী পদ পাওয়া আটকে যেতে পারে!
এই গুরুতর (!) মামলার তদন্ত পড়ে সানিয়া মালহোত্রা অভিনীত পুলিশ কর্মকর্তা মহিমা বসুর কাঁধে। এ চরিত্রে অভিনয় করেছেন সানিয়া মালহোত্রা।
তদন্ত যতই এগোয়, শুধু কাঁঠালের খোঁজ নয়, তার চেয়েও বড় এক সত্য উন্মোচিত হতে থাকে। এক নিখোঁজ তরুণী, রাজনৈতিক চাপ, প্রশাসনের ভেতরের অকার্যকর কাঠামো, মিডিয়ার নাটকীয়তা—সব মিলিয়ে তৈরি হয় এক মারাত্মক রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্র।
সানিয়া থেকে মহিমা
সানিয়া মালহোত্রার কথা আলাদা করে বলতেই হয়। ১০ হাজার রুপি নিয়ে মুম্বাই শহরে এসেছিলেন তিনি। সেই অভিনেত্রী এখন আলোচিত নিজের যোগ্যতায়। ‘দঙ্গল’ দিয়ে শুরু। এরপর ওটিটি ও বড় পর্দার একের পর এক প্রশংসিত সিনেমায় দেখা গেছে সানিয়া মালহোত্রাকে। বাণিজ্যিক, শৈল্পিক ঘরানার সিনেমার নিয়মিত অভিনেত্রী তিনি। ‘পাগলেট’, ‘লুডো’, ‘বাধাই হো’, ‘পাগলায়িত’, ‘মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর’—সানিয়া মালহোত্রা বলিউডে বরাবরই চুপচাপ কিন্তু ধারালো উপস্থিতির নাম। ‘কাঁঠাল’-এ তাঁকে দেখা যায় এক আত্মবিশ্বাসী, কিন্তু সংবেদনশীল পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্রে। বাস্তব জীবনের এক নারী পুলিশের সঙ্গে সময় কাটিয়ে স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষা শেখার মাধ্যমে সানিয়া এই চরিত্রকে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন। সিনেমা মুক্তির আগে এক সংবাদ সম্মেলনে সানিয়া বলেছিলেন, ‘এই চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে আমি বুঝেছি, একজন নারী পুলিশ কীভাবে কাজ করেন, কীভাবে ভারসাম্য রাখেন কর্মক্ষেত্র আর সংসারের মধ্যে। ইউনিফর্মের আড়ালের মানুষটা যেন আমি হঠাৎ চিনে ফেলি।’ কমেডি সিনেমা ছিল সানিয়ার জন্য ভিন্ন অভিজ্ঞতা। এ প্রসঙ্গে তিনি যোগ করেন, ‘এত দিন নানান ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছি। কিন্তু পুরোপুরি হাসির ছবিতে কখনো অভিনয় করিনি। তাই কমেডি ছবিতে অভিনয় করার বাসনা মনের মধ্যে পুষে রেখেছিলাম। সেই আশাও পূর্ণ হতে চলেছে। আমার সামনের ছবি কাঁঠাল ভরপুর হাসির ছবি।’
বালাজি মোশন পিকচার্সের ব্যানারে নির্মিত ১ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট ব্যাপ্তির সিনেমা দেখে মনে হয়েছে, এই সিনেমার আরেকটি শক্তিশালী দিক এর পার্শ্বচরিত্রগুলো। একদিকে রাজপাল যাদব এক সাংবাদিকের চরিত্রে অনবদ্য। তাঁর চরিত্রের প্রতিটি উপস্থিতি যেমন হাসায়, তেমনি মিডিয়ার রোমাঞ্চ প্রবণতা তথা ব্রেকিং বা ভিউয়ের ক্ষুধা নিয়ে দর্শককে ভাবায়। অন্যদিকে রাজনীতিকের চরিত্রে বিজয় রাজ এমন এক ‘শৌখিন’ নেতা, যিনি মনে করেন কাঁঠাল উপহার দিলে তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ হবে। তাঁর অভিনয় এতটাই বাস্তব ও মজার যে একটি দৃশ্যও একঘেয়ে লাগেনি। এক বসায় পুরো সিনেমা দেখা যায়।
হাসির আড়ালে ব্যঙ্গ
এ কথা বললে বাড়াবাড়ি হবে না, যশবর্ধন মিশ্রা পরিচালিত ‘কাঁঠাল’ কেবল এক নিছক কমেডি সিনেমা নয়, বরং ছবি দিয়ে সমাজকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছেন নির্মাতা। দৃশ্যত সরল ঘটনার আড়ালে লুকিয়ে থাকা জটিল রাজনৈতিক বাস্তবতা ও প্রশাসনিক কাঠামোর ব্যর্থতার জোরালো প্রতিফলন। যখন সামান্য এক কাঁঠাল চুরির মামলা জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়, তখন বুঝতে বাকি থাকে না, এই গল্প বর্তমান সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। সিনেমাটির প্রতিটি দৃশ্য, সংলাপ এমনভাবে নির্মিত, যাতে দর্শকের হাসি থামানোই কঠিন। প্রশাসনিক অকার্যকরতা, দলীয় পলিটিকসে পুলিশি ব্যবস্থার ব্যবহার, জাতপাতের শিকড়, নারী পুলিশ কর্মকর্তার সামাজিক অবস্থান—সবকিছুই মিশে গেছে কাঁঠালের ‘চামড়ার’ নিচে।
শর্মিলা ঠাকুর ও মনোজ বাজপেয়ি অভিনীত ছবিটি ৭০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা হিন্দি চলচ্চিত্রের পুরস্কার জিতেছিল। ওটিটিতে ২০২৩ সালে মুক্তি পেলেও ছবিটি তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের সে দেশের সেন্সর সার্টিফিকেশন বোর্ডের অনুমোদন পায়।
এই পুরস্কার প্রাপ্য ছিল কি
আগেই বলেছি ২০২৩ সালে শাহরুখ খানের ‘পাঠান’ আর ‘জওয়ান’, সানি দেওলের ‘গদার ২ ’, রণবীর কাপুরের ‘অ্যানিমেল’। ডিজনি প্লাস হটস্টারে মুক্তি পাওয়া ‘গুলমোহর’ নিয়ে তো বিস্তর আলোচনা হয়েছে। (অবশ্য এ ক্ষেত্রে বলে নেওয়া ভালো, শর্মিলা ঠাকুর ও মনোজ বাজপেয়ি অভিনীত ছবিটি ৭০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা হিন্দি চলচ্চিত্রের পুরস্কার জিতেছিল। জানা গেছে, ওটিটিতে ২০২৩ সালে মুক্তি পেলেও ছবিটি তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের সে দেশের সেন্সর সার্টিফিকেশন বোর্ডের অনুমোদন পায়। সে সূত্রে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গেল বছর জমা দিয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত ছবিটি পুরস্কার পায়। ছবিটিতে ১৩ বছরের বিরতির পর চলচ্চিত্রজগতে প্রত্যাবর্তন করেন শর্মিলা ঠাকুর। একজন জটিল, ‘কুইয়ার’ মাতৃপতির চরিত্রে অভিনয় করে সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করেন তিনি।) ‘রকি অউর রানি কি প্রেম কাহানি’তে ছিল বলিউডি ছবির সব ধরনের উপাদান। কী ছিল না সে ছবিতে! রণবীর সিং আর আলিয়া ভাটের রসায়ন, অরিজিৎ সিংয়ের গানের পাশাপাশি শাবানা আজমি, জয়া বচ্চন, ধর্মেন্দ্রর মতো তারকারা, মসলাদার চিত্রনাট্য, দারুণ লোকেশন, হাসি, আবেগ—সবকিছুই ছিল করণের এই ছবিতে। সমালোচকদের মতে, করণ অনেক যত্ন নিয়ে নির্মাণ করেছেন ছবিটি। তা ছাড়া তাঁর মার্কেটিং, যোগাযোগের ‘সুনাম’ আছে। সব ছাপিয়ে তাহলে শেষ পর্যন্ত ‘কাঁঠাল’ কেন পাকল?
ভারতে ওটিটির কোন সিনেমার সেন্সর সার্টিফিকেশন বোর্ডের অনুমোদন থাকলে সেটি জাতীয় চলচ্চিত্রের জন্য জমা দিতে পারেন প্রযোজক। ‘কাঁঠাল’ ওটিটির ফল হলেও সে যোগ্যতায় জাতীয় চলচ্চিত্রের জন্য জমা পড়েছিল। পুরস্কারও পেয়েছে।
এটাও ঠিক, ‘কাঁঠাল’ সিনেমার মুক্তির সময় বলিউডে প্রচার খুব একটা হয়নি। ওটিটি দুনিয়ায় তেমন ঝড় তোলেনি। বরং একা সানিয়াকে নিয়েই কিছুটা আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বিষয়ের মৌলিকতা, নির্মাণশৈলী, ব্যঙ্গবোধ ও অভিনয়গুণ—এই ছবিকে ২০২৩ সালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হিন্দি চলচ্চিত্রে পরিণত করেছে। যেখানে একঘেয়ে বাণিজ্যিক ফর্মুলায় নির্মিত বলিউড সিনেমা নিয়ে অনেক সমালোচনা হচ্ছে সেখানে ‘কাঁঠাল’ মনে করিয়ে দেয়, বড় সিনেমা মানে বড় তারকা নয়, বরং বড় ভাবনা।
কাজে এ সিনেমার জাতীয় পুরস্কার জয়ের এই স্বীকৃতি তাই শুধু একটি সিনেমার নয়, বরং বলিউডের মৌলিকতা, সৃষ্টিশীলতা ও গল্প বলার ক্ষমতার ওপর আস্থা ফিরে পাওয়ার গল্প। একজোড়া কাঁঠালের খোঁজ থেকে শুরু হয়ে এমন একটি সিনেমা জাতীয় স্বীকৃতি পেল, সত্যিই ব্যতিক্রম ঘটনা। সানিয়া মালহোত্রা, যশবর্ধন মিশ্রা ও পুরো ‘কাঁঠাল’ টিমকে অভিনন্দন জানাতেই হয়। তাঁরা প্রমাণ করেছেন, ব্যতিক্রম গল্প এখনো বলা হয়, কেবল ঠিকঠাক শোনার মানুষ লাগে। আর ঠিকঠাকমতো বলতে পারলে শোনার মানুষও মিলবে, স্বীকৃতিও মিলবে।
‘কাঁঠাল’–এর মৌসুম পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি, যদি এখনো না দেখে থাকেন, দেখে ফেলুন সিনেমাটি। নেটফ্লিক্সে স্ট্রিমিং হচ্ছে ব্যতিক্রমী ছবিটি। শুধু বিনোদনের জন্য নয়, সমাজের বাস্তব চেহারার একটি রসাত্মক পাঠ হিসেবেও এটি দেখতে পারেন। ‘কাঁঠাল’-এর গল্পটা হয়তো চুপিসারে শুরু হয়েছিল, কিন্তু ১ আগস্ট শুক্রবার থেকে তা ছড়িয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢুকে তারই প্রমাণ মিলল। নতুন করে আলোচনা হচ্ছে।
শেষে আরেকটা তথ্য দিয়ে যাই। ভারতে ওটিটির কোন সিনেমার সেন্সর সার্টিফিকেশন বোর্ডের অনুমোদন থাকলে সেটি জাতীয় চলচ্চিত্রের জন্য জমা দিতে পারেন প্রযোজক। ‘কাঁঠাল’ ওটিটির ফল হলেও সে যোগ্যতায় জাতীয় চলচ্চিত্রের জন্য জমা পড়েছিল। পুরস্কারও পেয়েছে। শাহরুখ খান, রানী মুখার্জির প্রথমবার পুরস্কার পাওয়া নিয়ে তো অনেক কথাই হচ্ছে। নতুন করে ‘কাঁঠাল’ নিয়ে দুই চার কথা হতেই পারে।