শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষাই শিবিরের বড় চ্যালেঞ্জ
প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট পেয়েছে শিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট প্যানেল। ২৮টি পদের ২৩টিতেই জয়লাভ করেছে এই প্যানেলের প্রার্থীরা।
তাদের এই ভূমিধস বিজয়ের পর ক্যাম্পাসে নানা আলোচনা চলছে। বড় রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের পরাজয় কিংবা শিবিরের জয়- এসবের চেয়েও আলোচনায় গুরুত্ব পাচ্ছে শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার প্রশ্ন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতাদের মতে, এই নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক কমফোর্ট জোনের বাইরে গিয়ে অধিকার আদায়ের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এটি একটি নতুন ধারা শুরুর ইঙ্গিত।
তাদের মতে, সামনে ছাত্রশিবিরকেও সর্বদলীয় উপেক্ষা বা বিরোধিতার মুখোমুখি হওয়ার মতো পরিস্থিতি হতে পারে। এখন ঘোষিত ইশতেহারের প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করাই হবে সংগঠনটির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে দলীয় পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীবান্ধব কর্মসূচি, ক্যারিয়ার কেন্দ্রিক কার্যক্রম এবং শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার নিয়ে কাজ করতে পারলে শিবির সব বাধা অতিক্রম করে সফল হতে পারবে।
এদিকে ডাকসুতে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের জয়কে অনেকেই দেখছেন দীর্ঘদিনের আধিপত্যবাদী রাজনীতির বিকল্প হিসেবে। তাদের মতে, শিক্ষার্থীরা শিবিরকে সমর্থন করার কারণে নয় বরং প্রচলিত রাজনীতির বাইরে একটি বিকল্প খুঁজতে গিয়ে ভোট দিয়েছে এই জোটকে।
তরুণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোহাম্মদ ইশরাক ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাদিক কায়েমের জয় বা আবিদের পরাজয়কে শুধু ছাত্রশিবিরের জয় কিংবা ছাত্রদলের পরাজয় হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। এখানে শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষার জয় হয়েছে। তারা পলিটিক্যাল কমফোর্ট জোন থেকে বের হয়ে অধিকার সচেতন হয়ে ভোট দিয়েছে। নির্বাচিত সংসদের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ হবে আগামী এক বছর শিক্ষার্থীদের এই ভাবনার যথাযথ মূল্যায়ন করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষার্থী বলেন, ডাকসুর এ ফলাফল দলগুলোর প্রতি ছাত্রদের স্পষ্ট বার্তা- তারা আধিপত্যবাদী রাজনীতি নয়, বরং গুণগত রাজনৈতিক পরিকল্পনা ও শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবর্তন দেখতে চায়। যদি সেটা শিবির সমর্থিত প্যানেল করতে পারে, তাহলে কেবল বিরোধিতা করে তাদের ঠেকানো যাবে না। এছাড়া ছাত্রদলসহ অন্য সংগঠনগুলো জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে চাইলে বিরোধিতার রাজনীতি থেকে বের হয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে যেতে হবে, তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, সামনের দিনগুলোতে ডাকসুর বিজয়ীরা ভয়াবহ অসহযোগিতা ও আধিপত্যবাদী শক্তির হিংস্রতার মুখে পড়তে পারেন। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে এগোতে হবে।
ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আদর্শিক পরিচয় যাই হোক না কেন, সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে আধিপত্যবাদী দলের চোখ রাঙানি ও আগ্রাসী নেতৃত্ব দেখতে চায় না। শিক্ষার্থীবান্ধব কর্মসূচির সুযোগে শিবির সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে যেতে পেরেছে। ফলে অতীতের অত্যাচারের জায়গা থেকে মুক্তির সুযোগ হিসেবে অনেকেই শিবিরকে বিকল্প ভেবে ভোট দিয়েছে। তবে এর মানে এই নয়, শিক্ষার্থীরা শিবিরের আদর্শ ধারণ করেছে।
তিনি বলেন, ছাত্রশিবিরের বিপরীতে যদি ছাত্রলীগ থাকতো তাহলে শিক্ষার্থীরা হয়তো নিঃশ্বাস ছাড়ার সুযোগ হিসেবেই ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটকে ভোট দিতো। তাই শিবিরের খুব বেশি খুশি হওয়ার সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীদের এই সমর্থন সবসময় তাদের দিকে থাকবে- এমনটা ভাবার কারণ নেই।
সাবেক এই সভাপতি বর্তমান ছাত্রশিবিরের নেতাদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেন, শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার জন্য ছাত্রবান্ধব, নমনীয়, গতিশীল ও ক্রিয়েটিভ কার্যক্রম চালানো জরুরি। এছাড়া পুরাতন গণরুম কালচার বা নেতাদের ব্যক্তিগত প্রভাব ও রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করতে পারে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভিপি বা জিএসকে মূলত ছাত্র সংসদ বা ইউনিয়নের প্রতিনিধি হিসেবেই দেখতে চায়, বস হিসেবে নয়।
সাবেক সভাপতি আরও বলেন, শিবিরের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীবান্ধব কাজ করা, নমনীয় হয়ে তাদের কাছে যাওয়া এবং নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করা। শিক্ষার্থীদের জন্য কার্যক্রম চালিয়ে গেলে তাদের সমর্থন অব্যাহত থাকবে।
ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও বর্তমানে ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতে ইসলামীর আমির সেলিম উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৫ আগস্টের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে আধিপত্যবাদ, ট্যাগিং, ফ্রেমিং ও গেস্টরুম কালচারের কবর রচনা করেছেন শিক্ষার্থীরা। এসব পুরোনো কালচার আর ফিরে আসুক শিক্ষার্থীরা তা চায় না। সেই প্রেক্ষাপট থেকে ডাকসুর নির্বাচিত শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের সতর্ক থাকতে হবে।
তিনি বলেন, শিবিরকে ভোট দেওয়ার মূল কারণ ছিল ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের দাপট থেকে মুক্তি পাওয়া। সেই পুরোনো কালচার যেন আর ফিরে না আসে, সেটাই শিবিরের বড় চ্যালেঞ্জ।
সেলিম উদ্দিন বলেন, শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার গাইডলাইন কার্যকর করা, বাস্তবসম্মত কর্মসূচি বৃদ্ধি করা এবং শিক্ষার্থীদের আস্থার প্রতিদান দেওয়া শিবিরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে শিবির শুধু জনপ্রিয়তা বজায় রাখবে না, সাধারণ শিক্ষার্থীরাও সেই আদর্শকে সৎভাবে গ্রহণ করবে। ওরা যদি শিক্ষার্থীদের আস্থার প্রতিদান দিতে পারে তাহলে অন্য বিরোধীদের শত বিরোধিতা কিংবা ষড়যন্ত্রেও শিবির আরও জনপ্রিয়তা পাবে।
ফৌজদারি আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডাকসুতে নির্বাচিত ছাত্রপ্রতিনিধি হওয়ার পর নেতার মতো আচরণ করা যাবে না। তাদের ছোট ভাই, বড় ভাই, বন্ধু, ছাত্র বা ছাত্রী হিসেবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আচরণ করতে হবে। এছাড়া নিজেরা ক্যারিয়ারমুখী হবে এবং অন্য শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করবে। নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ভালো ফলাফল বজায় রাখবে।
তিনি বলেন, হলে সিট বরাদ্দ ও দখল রাজনীতি কবর দিতে হবে; বরাদ্দকৃত সিটেই বসবাস করতে হবে। যেদিন সিট থাকবে না সেদিনই হল ছেড়ে চলে যাবেন। নিয়মিত লাইব্রেরিতে পড়াশোনা ও রিসার্চ করবে, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে নতুন আইডিয়া নিয়ে অংশগ্রহণ করবে। সর্বশেষ জ্ঞান ও তথ্য সম্পর্কে আপডেট থাকবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে সেই অনুযায়ী উন্নত করার চেষ্টা করবে। বিতর্কে অংশগ্রহণ করবে। সহজ-সরল ও সাধারণ জীবনযাপন করবে। পোশাক, খাবার ও যানবাহনে সাধারণ শিক্ষার্থীর সমমান বজায় রাখবে।
অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, নির্বাচিত ছাত্রপ্রতিনিধিদের খেলাধুলা ও সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হবে। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে, তবে জয়-পরাজয়ের চেয়ে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করাই প্রাধান্য পাবে। বিশেষ করে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের দিকে খেয়াল রাখতে হবে, কারণ অনেকেই নতুন শহরে এসে ভুল সিদ্ধান্তে ক্যারিয়ার নষ্ট করতে পারে।
তিনি বলেন, ডাকসুতে শিবির নয় শিক্ষার্থীরা জিতেছে। সেই শিক্ষার্থীদের মৌলিক চাওয়ার প্রতিদান না দিলে আগামীতে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট তার ম্যান্ডেট হারাতে পারে।
ডাকসু নির্বাচনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ও যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মির্জা গালিব তার ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে বিজয়ী শিবির সমর্থিত প্যানেলের কাছে দুটি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি লেখেন, মেঘমল্লাররা যেন মনের খুশিতে যতটা চায় ততটা শিবিরকে নিয়ে সমালোচনা করতে পারে- এমন একটা অবাধ মত প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, দল-মত-পোশাক নির্বিশেষে ছাত্রীরা যেন কোনো হ্যারাসমেন্ট বা বুলিং-এর শিকার না হয় এমন একটা ভয়-ডরহীন নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
জেইউ/এমএসএ/এআইএস