ঢাকঢোল পিটিয়ে জুলাই ঘোষণাপত্র ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ : নুর
প্রকাশ: ৬ আগস্ট, ২০২৫

জুলাই ঘোষণাপত্রে সরকার সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে পারেনি বলে অভিযোগ করেছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। সরকারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন, ঢাকঢোল পিটিয়ে একটা ঘোষণাপত্র জাতির সামনে হাজির করলেন, সেটাতেও শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে।
বুধবার (৬ আগস্ট) রাজধানীর পুরানা পল্টনে আল রাজি কমপ্লেক্সে গণঅধিকার পরিষদ (জিওপি) আয়োজিত ‘জুলাই ঘোষণাপত্রের প্রতিক্রিয়া’ সংক্রান্ত জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এসব বলেন নুর।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি বলেন, গতকাল (মঙ্গলবার) বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন ছিল। সেই দিনে আরেকটি নতুন ইতিহাসের সৃষ্টি হয়েছে জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার মাধ্যমে। এজন্য অবশ্যই আমাদেরকে সরকার ও সরকারের প্রধানকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। আসলে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নই এমন একটা অবস্থায়, অর্ধেক সন্তুষ্টি নিয়ে সরকারকে আমাদের ধন্যবাদ জানাতে হচ্ছে। কারণ আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি এই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাদের সবার সরকার, এই সরকারের ব্যর্থতা মানে আমাদের সবার ব্যর্থতা। এই সরকারের ব্যর্থতা মানে দেশ আরেকটা নতুন সংকটে পতিত হওয়া। সেই জায়গা থেকে আমরা সরকারকে ধারণ করেছি। কিন্তু প্রকৃত অর্থে আমরা সরকারকে যতটা ধারণ করেছি সরকার আমাদেরকে ততটা ধারণ করেনি। সরকার শুধু ধারণ করেছে এনসিপিকে।
তিনি বলেন, সমস্ত কর্মকাণ্ডে দেখবেন এনসিপির একটা প্রাধান্য। সদ্য গঠিত একটা নতুন দল। এমনকি এই যে ঐতিহাসিক জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়া হলো। ইতিহাস টেনে গালগপ্প অনেক করা যায়। কিন্তু যেকোনো একটা বিষয়ে আপনাকে টু দ্য পয়েন্টে আসতে হয়। সামারিতে আসতে হয়। প্রত্যেকটা জিনিসের একটা জিস্ট থাকে। এই গণঅভ্যুত্থানের জিস্ট ও গণঅভ্যুত্থানের মূল প্রেক্ষাপট ছিল ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন। যেই আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল আমাদের ছোট ভাই-বন্ধুদের, কিশোর বন্ধুদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন।
আরও পড়ুন
নুর বলেন, এই কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আমরা তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে এই প্রথাগত রাজনীতির বাইরে সংগ্রাম চালিয়ে গেছি। সেই সংগ্রাম থেকেই জন্ম নিয়েছে ছাত্র যুব শ্রমিক অধিকার পরিষদ, গণঅধিকার পরিষদ। ২০২৪ সালে যেই আন্দোলন শুরু হয়েছে, আমাদের সাধারণ সম্পাদক যেটি বলেছেন, এ ধরনের একটি মিথ্যাচার এ ধরনের একটি বিকৃত ইতিহাস জুলাই ঘোষণাপত্রে থাকবে, এটা আমরা প্রত্যাশা করিনি। জুলাইয়ের আন্দোলন নাকি শুরু হয়েছে দুর্নীতিবিরোধী এবং কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে। কীসের দুর্নীতির বিরুদ্ধে? কোথায় আন্দোলন শুরু হয়েছে, এই আন্দোলনের মধ্যে কোথাও লেখা ছিল? পরিষ্কারভাবে ব্যানারে লেখা ছিল– ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে। কাজেই এ ধরনের উচ্চ শিক্ষিত লোক, জ্ঞানী-গুণী লোকেরা একটা খসড়া আপনারা দেবেন, সেই খসড়ায় একটা ঢাহা মিথ্যা কথা থাকবে, এটা আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম।
তিনি বলেন, এজন্য বলেছি মনগড়া ইতিহাস লেখা যায় না। আওয়ামী লীগ ৭১-এর যে ন্যারেটিভ বিনির্মাণ করার চেষ্টা করেছে আমরা দেখেছি এই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি গোষ্ঠী তাদের মনগড়া একটা ইতিহাস বিনির্মাণ করার চেষ্টা করেছে। আমরা বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির সুস্পষ্ট বক্তব্য চাই। আমরা যতদূর জানতে পেরেছি এই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার আগে দফায় দফায় ফরমালি এবং ইনফরমালি বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিকে নিয়ে বৈঠক হয়েছে। তাহলে তারা এই মিথ্যাচারের স্বীকৃতি দিয়েছে কি না। এই মিথ্যাকে ধারণ করে কি না আমরা সেটি জানতে চাই তাদের কাছে। যেহেতু আজ প্রত্যেকটি দল আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট তাদের মন্তব্য আমরা জানতে চাই। যেখানে আমরা বারবার এই আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনা করি, মুক্তিযুদ্ধের এককেন্দ্রিক বয়ান নিয়ে সমালোচনা করি। তাহলে কেন আমরা এই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছরে শহীদদের সংখ্যা নির্ণয় করতে পারলাম না। কেন এ ধরনের একটা বড় পার্থক্য– যেখানে জাতিসংঘ বলছে ১৪০০, সরকারের হিসেবে ৮৩৬, বেসরকারি হিসেবে কেউ বলছে হাজার খানেক, কেন এ ধরনের তারতম্য হবে। অভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায়ও আমরা একটা সঠিক ইতিহাস জাতির সামনে তুলে ধরতে পারলাম না। এটাই সরকারের ব্যর্থতা। আমাদের ব্যর্থতা নয়। সরকার সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে পারেনি। তারা সঠিক তথ্য জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারেনি। ঢাকঢোল পিটিয়ে একটা ঘোষণাপত্র জাতির সামনে হাজির করলেন, সেটাতেও শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি বলেন, পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের সংস্কার করা সংবিধানে যদি এটি অন্তর্ভুক্ত থাকে, যদি পরবর্তী সরকার ডিসিশন নেয় তাহলে আপনাদের জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নামে এই তামাশার কি দরকার ছিল? তামাশার তো কোনো দরকার নাই। আমরা প্রায় দুই মাস সমস্ত কর্মকাণ্ড বাদ দিয়ে, পরিবারকে বঞ্চিত করে এখানে অফিসের মতো বেলা ১১টায় আলোচনা শুরু হয়েছে, বিকেল ৫টার দিকে সেই আলোচনা শেষ হয়েছে। আমরা বারবার বলেছিলাম যে সংস্কারগুলোর নির্বাচনের আগে আইনি ভিত্তি এবং বৈধতা দেওয়া যায় সেগুলোকে বৈধতা এবং আইনি ভিত্তি দিতে হবে এবং এই জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামীর বাংলাদেশ পরিচালিত হবে। যেই জুলাই সনদের কথা ঘোষণাপত্রে উদ্ধৃত থাকবে। কিন্তু ঘোষণাপত্রে জুলাই সনদের কথা উল্লেখ নেই। যখন বলা হয়েছে যে এই ডিক্লারেশন আপনার সংবিধানে সন্নিবেশিত থাকবে, সেখানে যদি এভাবে বলা থাকত– যে জনআকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নে একটি জুলাই সনদ রচিত হবে। এই কথাটুকু যদি উল্লেখ থাকত তাহলে এই সনদের একটা স্ট্রং আইনি বৈধতা বা ভিত্তি থাকত। সেটি হয়নি। তাই আমরা পরিষ্কারভাবেই বলতে চাই, আমরা যদি আজকে বিভাজিত অবস্থান নিই তাহলে পতিত স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদ এবং তার দোসররা অট্টহাসিতে মেতে উঠবে। এখনো যদি সুযোগ থাকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই জুলাই ঘোষণাপত্রের সংশোধনী আনা দরকার।
নুর বলেন, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, ৪৭ এর আন্দোলন এই সমস্ত ইতিহাসের উদ্ধৃতি ঘোষণাপত্রে থাকার দরকার ছিল না। গণঅভ্যুত্থান হয়েছে গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদের কারণে। ১৬ বছরে তিনটি নির্বাচনে জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। নির্বাচন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ১৬ বছরে এক দলীয় শাসন কায়েম করার জন্য ধারাবাহিকভাবে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে– সামরিক বাহিনীকে পঙ্গু করার জন্য পিলখানা হত্যাকাণ্ড, আলেম-ওলামাদেরকে হত্যা করার জন্য শাপলা চত্বরের ঘটনা এবং এর মধ্যে মোদিবিরোধী আন্দোলন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং সবচেয়ে মোমেন্টাম সৃষ্টি করেছে– কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। একটা অস্পষ্ট ইতিহাস কার স্বার্থে উপস্থাপন করা হয়েছে, কারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল, আমরা সেটা জানতে চাই। তারা প্রতারণা করেছে জাতির সঙ্গে, আমাদের সঙ্গে। আমরা ১৫-২০ দিনের আন্দোলনের মিডিয়া কাভারেজে নেতা হইনি। হঠাৎ করে নেতা হয়ে উঠিনি। আমাদের এই সাত-আট বছরের ধারাবাহিক লড়াই, সংগ্রাম, রাজপথের রক্ত এবং ঘাম রাজপথের সঙ্গে মিশে গেছে। প্রত্যেকটা মানুষ যারা আজ আমরা এখানে বসে আছি, তারা এই প্রেক্ষাপট তৈরিতে জীবনবাজি রেখে ধারাবাহিকভাবে লড়াই-সংগ্রাম করেছি।
এমএসআই/এসএসএইচ