Advertisement

চার দশক পর চলনবিলে নৌকাবাইচ, দুই পাড়ে ভিড়-উল্লাস

প্রথম আলো

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার বিলসা গ্রামে চলনবিলের আত্রাই নদ অংশে গতকাল বিকেলে আয়োজিত হয় নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। গতকাল তোলাছবি: প্রথম আলো
নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার বিলসা গ্রামে চলনবিলের আত্রাই নদ অংশে গতকাল বিকেলে আয়োজিত হয় নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। গতকাল তোলাছবি: প্রথম আলো

হঠাৎ শান্ত চলনবিল যেন কেঁপে উঠল বইঠার মুহুর্মুহু ছন্দে। বিলের সঙ্গে যুক্ত আত্রাই নদের বুক চিরে ছুটে চলছে বাহারি নামের একেকটি নৌকা। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে গর্জে উঠছেন বিপুল দর্শক। বেরসিক বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিয়েছে তাঁদের অধিকাংশকেই। তবু দমে যাননি, একমুহূর্তের জন্যও চোখ সরাননি আত্রাইয়ের বুক থেকে। প্রায় ৪০ বছর পর এমন আয়োজনের সাক্ষী হলেন তাঁরা। গতকাল শুক্রবার বিকেলে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার বিলসা গ্রামে শুরু হয় নৌকাবাইচের সেই বহুল প্রতীক্ষিত মহোৎসব।

গুরুদাসপুর উপজেলা সদর থেকে চলনবিল তীরবর্তী গ্রাম বিলসার দূরত্ব প্রায় ছয় কিলোমিটার। এর আগে গতকাল বেলা ১১টার দিকে গ্রামটিতে যাওয়ার সরু সড়কে ঢুকতেই চোখে পড়ে মানুষের সারি। তাঁদের অধিকাংশের গন্তব্য নৌকাবাইচের আয়োজনস্থল। প্রায় ৪০ বছর পর গতকাল বিকেলে আত্রাই নদে নির্মিত ‘মা জননী’ সেতুর নিচে প্রতিযোগিতার আয়োজন করে জেলা প্রশাসন।

আয়োজকদের দাবি, এই গ্রামীণ উৎসব দেখতে নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলার লাখখানেক দর্শকের সমাগম হয়েছিল। তুমুল বৃষ্টিও এই নির্মল বিনোদন থেকে তাঁদের বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। প্রতিযোগিতা শুরুর পাঁচ ঘণ্টা আগে থেকে মানুষ দুই পাড়ে জড়ো হতে শুরু করেন। সন্ধ্যা অবধি অনুষ্ঠিত হয় এই ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ। এত দর্শকের উপস্থিতিই প্রমাণ করে চলনবিলের মানুষের কাছে এখনো এটিই সেরা প্রতিযোগিতা।

আয়োজক ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন জেলার ২১টি দল প্রতিযোগিতায় নাম লেখালেও মূল প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় ১২টি নৌকা।

সিরাজগঞ্জের তাড়াশ থেকে নৌকাবাইচ দেখতে এসেছিলেন কলেজশিক্ষক মাহফুজুর রহমান। তাঁর ভাষ্য, একটি প্রতিযোগিতা দেখার জন্য নানা বয়সী মানুষ এভাবে ভিড় করতে পারে—তা নিজের চোখে না দেখলে বোঝার উপায় ছিল না।

প্রথমবারের মতো নৌকাবাইচ দেখতে এসেছিলেন বুয়েটের শিক্ষার্থী সাদমান হোসেন। তিনি বলেন, মাঝি মাল্লাদের দক্ষতা আর দর্শকদের উচ্ছ্বাস তাঁকে অভিভূত করেছে।
পাশের খুবজিপুর গ্রামে বড় হয়েছেন ব্যাংকার কামাল হোসেন (৫৫)। তিনি নৌকাবাইচ দেখে বলেন, গত ৪০ বছরে এত বড় আয়োজন আশপাশে কোথাও দেখেননি।

নৌকাবাইচ নিয়ে এমন উচ্ছ্বাস খুব ছোটবেলা থেকে দেখে আসছেন বিলসা গ্রামের বাসিন্দা স্বাস্থ্যসচিব সাইদুর রহমান। তাঁর আগ্রহেই জেলা সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরের বিলসা গ্রামে নৌকাবাইচ আয়োজিত হয়। তাঁর সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে এসেছিলেন রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার আজিম উদ্দিন, রাজশাহীর রেঞ্জ ডিআইজি শাহজাহান আলী, নাটোরের জেলা প্রশাসক আসমা শাহীন, পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম প্রমুখ।

নৌকাবাইচে চূড়ান্ত ধাপের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর ‘নিউ একতা এক্সপ্রেস’ সেরার খেতাব অর্জন করে। দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ‘বাংলার বাঘ’ নামের একটি নৌকা। আর তৃতীয় স্থানে ছিল ‘আল মদিনা’ নামের নৌকা। সেরা নৌকাকে পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় একটি মোটরসাইকেল, দ্বিতীয় পুরস্কার রেফ্রিজারেটর ও তৃতীয় পুরস্কার ছিল এলইডি টেলিভিশন।

নিউ একতা এক্সপ্রেসের দলনেতা লিটন আলী। তাঁর কাছে মোটরসাইকেলের চেয়েও বেশি আনন্দের বিষয় ছিল, চ্যাম্পিয়ন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের একসঙ্গে দেওয়া করতালি। করতালির উচ্ছ্বাসে তাঁর সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে বলে জানান।

নৌকাবাইচের সমন্বয়ক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আবুল হায়াতের জন্মও চলনবিল এলাকাতেই। তাঁর ভাষ্য, বিল পাড়ের মানুষদের বিনোদন দিতে নৌকাবাইচকেই বেছে নিয়েছেন।

Lading . . .