পিছিয়ে থাকা ‘তুরি’ মেয়েরা এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন
প্রকাশ: ৯ আগস্ট, ২০২৫
চারপাশে ঢেউখেলানো বাদামি এঁটেল মাটির বরেন্দ্রভূমি। তার মধ্যে ২৭ পরিবারের ছোট গ্রাম মাধাইপুর। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার পার্বতীপুর ইউনিয়নের গ্রামটিতে বসবাস করে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার তুরি জনগোষ্ঠীর মানুষজন। ভারতের নাগপুর ও রাঁচি থেকে তাঁদের পূর্বপুরুষেরা এসেছিলেন এই বরেন্দ্রভূমিতে। ঝোপঝাড় ও টিলা কেটে গড়ে তুলেছিলেন বসতি, তৈরি করেছিলেন আবাদি জমি। তবে জমির মালিক হতে পারেননি তাঁরা। অধিকাংশ পরিবারই এখনো ভূমিহীন, খেতমজুর।
তুরি জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে সংখ্যা ও সুযোগ—দুই দিক থেকেই পিছিয়ে। এই গ্রামে এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত গেছেন একজনই—কাজল পাড়ে। ভূমিহীন কৃষক পরিবারের সন্তান কাজল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। স্বপ্ন দেখেন বিচারক বা আইনজীবী হওয়ার। তবে শুধু নিজের স্বপ্নেই আটকে থাকেননি তিনি, চেয়েছেন পুরো গ্রামটার কিছু বদলাতে। ছোটবেলা থেকেই জমিতে কাজ করার পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের জন্য তাঁর মন কাঁদে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ পর্যন্ত লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁদের উৎসাহ দেন কাজল।
২০১৯ সালের আগস্টে প্রথম আলোতে ‘পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী তুরি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল মাধাইপুর গ্রামের শিশু-কিশোরদের জীবনসংগ্রাম নিয়ে। তখন দেখা গিয়েছিল, মাঠে কৃষিকাজ করতে করতে নখ ক্ষয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, আবার খেতেও নামছে। অনেকেই স্কুলছুট হওয়ার ঝুঁকিতে ছিল, কেউ কেউ হয়তো আগেই ঝরে পড়েছে।
সেই তুলনায় এবারের চিত্র কিছুটা আশাব্যঞ্জক। গত বুধবার মাধাইপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, মাঠের কাজ করেও মেয়েরা পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে মায়া তিরকি, অভি জেড়ি ও আশা তিরকি। লেখাপড়ার প্রতি তাদের আগ্রহ ও জেদ দেখে পরিবার তাদের বাল্যবিবাহ দিতে পারেনি। ছিটকে পড়েনি তারা লেখাপড়া থেকেও। মাঠের কৃষিকাজও ছেড়ে দেয়নি তারা।
অদম্য এই মেয়েরা বলছে, বিয়ে নয়; আগে উচ্চশিক্ষা শেষ করবে। তাদের ছোট বোন বা গ্রামের অন্য ছেলেমেয়েরাও স্কুলে আছে। কেউ নবম, কেউ দশম, কেউ ষষ্ঠ কিংবা উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়ে।
মায়া তিরকি বলে, ‘পরীক্ষার চাপে মাঠে কাজ কিছুটা কমিয়েছি। কাজের মজুরি থেকেই বই কিনেছি।’ আশা জানান, তিনি প্রাইভেট পড়ার খরচ জোগান মজুরির টাকা থেকেই।
তবে সব গল্প আশার নয়। রিংকি, বর্ষা ও লাবণীর বিয়ে হয়ে গেছে যথাক্রমে দশম ও নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়। রিংকি বলেন, ‘আগের জীবনের কথাটা মনে হলে মন খারাপ হয়।’
তুরি সম্প্রদায়ের বয়স্কদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, স্বাধীনতার আগে-পরে এ গ্রামে ৬০টির মতো পরিবার ছিল, এখন আছে মাত্র ২৭টি। অধিকাংশ পরিবার ভূমিহীন, দালালচক্রের মাধ্যমে জমি হাতছাড়া করে অনেকে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন।
গ্রামের বয়স্কদের একজন কাজল পাড়ের বাবা নরেশ পাড়ে স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘স্বাধীনতার পরপরই টিলা কেটে জমি বানাইছি। ১০ ডালি মাটি কাটলে এক টাকা পেতাম। স্বামী-স্ত্রী মিলে ৪০০ ডালি কেটে ৪০ টাকা আয় হতো।’
গ্রামের মোড়ল নিরঞ্জন তিরকির ভাষ্য, এখন মাত্র দুই পরিবার সামান্য জমির মালিক। প্রথম এসএসসি পাস করেছেন বিমল জেড়ি, ১৯৮২ সালে। দ্বিতীয়জন রুপেন জেড়ি, ২০০৬ সালে। এরপর কাজল। তাঁর ভাষায়, ‘একজন থেকে দুজন এসএসসি পাস করতে লেগেছে ২৪ বছর। এটাই আমাদের শিক্ষার অবস্থা।’
তবে পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার কমেছে। কাজল পাড়ে বললেন, সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা যেমন বই, খাতা, পোশাক ও খাবার—এসব কারণে শিক্ষায় আগ্রহ বেড়েছে। সাংস্কৃতিক উৎসব, স্থানীয় নেতৃত্বের সচেতনতা ও মেয়েদের শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়ায় পরিবারগুলো সন্তানদের স্কুলে রাখতে উৎসাহিত হচ্ছে।
তবু বড় এক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে—ঋণের দুষ্টচক্র। কৃষি বা দিনমজুরির অনিশ্চিত আয় দিয়ে সংসার চলে না। প্রয়োজনের সময় টাকা জোগাড় করতে গিয়ে অনেকেই চড়া সুদে মহাজনের কাছে ঋণ নিতে বাধ্য হন। ফলে আয়ের অনেকটাই চলে যায় সুদ মেটাতে। কেউ কেউ আগাম ফসল বিক্রি করে দেন কম দামে।
লাহান্তি ফাউন্ডেশন নামের একটি বেসরকারি সংস্থার বিভিন্ন কার্যক্রম এই এলাকায় রয়েছে। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক বঙ্গপাল সরদার প্রথম আলোকে বলেন, এই চক্র থেকে বের হতে হলে প্রয়োজন বহুমুখী উদ্যোগ। গ্রামীণ এলাকায় সরকারি ব্যাংক ও মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম বাড়ানো দরকার। কৃষি, হস্তশিল্প, পশুপালনের মতো খাতে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি নারীদের জন্য আয়ের পৃথক সুযোগ তৈরি করাও জরুরি।