Advertisement

মৌসুমের শেষে বাজারে আসে রুমা অধিকারীর বাগানের ভিন্ন জাতের আম, লাভও বেশি

প্রথম আলো

প্রকাশ: ১৭ আগস্ট, ২০২৫

পরিবেশবান্ধব কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন থেকে ভিন্ন জাতের আমের বাগান গড়ে তুলেছেন রুমা অধিকারী। গত রোববার নীলফামারী সদর উপজেলার উত্তর বালাপাড়া গ্রামেছবি: প্রথম আলো
পরিবেশবান্ধব কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন থেকে ভিন্ন জাতের আমের বাগান গড়ে তুলেছেন রুমা অধিকারী। গত রোববার নীলফামারী সদর উপজেলার উত্তর বালাপাড়া গ্রামেছবি: প্রথম আলো

এক একর জমির ওপর করা আমবাগানে গাছ আছে ৩০০টি। তবে কোনোটিই প্রচলিত জাতের নয়। বেশির ভাগ ভিনদেশি। কিং অব চাকাপাত, চ্যাংমাই, ডকমাই, কাটিমন, ব্যানানা, রেড পালমার, শ্রাবণী, হানি ডিউ, ফোর কেজি—এমন বাহারি নামের আম ঝুলছে বাগানের গাছে গাছে।

নীলফামারী জেলা সদরের কুন্দপুকুর ইউনিয়নের উত্তর বালাপাড়া গ্রামে এই বাগান গড়ে তুলেছেন রুমা অধিকারী নামের এক নারী। ইউটিউব দেখে এসব উন্নত জাত সম্পর্কে ধারণা নিয়ে চারা সংগ্রহের মাধ্যমে বাগানটি করেছেন তিনি। আমের পাশাপাশি মাল্টা, ড্রাগন, জাম্বুরা, কমলা ও সুপারির গাছও রয়েছে বাগানে।

এসব জাতের আমগাছে মার্চ মাসে মুকুল আসতে শুরু করে। আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে পরিপক্ব হয়। দেশি আমের মৌসুমের শেষে এসব আম বাজারজাত হয়। এ কারণে বাজার দরও ভালো পাওয়া যায়। ফলে লাভের অঙ্কটাও একটু বেশি।

গত রোববার বাগান ঘুরে দেখার সময় নিজের গল্প জানালেন রুমা অধিকারী। তিনি ২০০৪ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এর পর থেকে তিনি কৃষিতে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। প্রায় ২০ বছর পর এসে সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন তিনি।

২০০৪ সালে নীলফামারী সদর উপজেলার উত্তর বালাপাড়া গ্রামের দুলাল অধিকারীর সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। স্বামী পুলিশের উপপরিদর্শক। রুমার বাবা রমনী মোহন রায়ও ছিলেন পুলিশে। বিয়ের পর স্বামীর চাকরির সুবাদে দীর্ঘ সময় কেটেছে রংপুরে।

এরপর ২০২৩ সালে একাই (রুমা) গ্রামের বাড়িতে ফিরে স্বামীর পৈতৃক এক একর জমিতে রোপণ করেন বিভিন্ন প্রজাতির ৩০০টি আমের চারা। একই জমিতে আমের সঙ্গে রোপণ করেছেন বিখ্যাত দার্জিলিং কমলার চারা। বাগানের চারদিক ঘিরে রয়েছে ড্রাগন, জাম্বুরা, মাল্টা ও সুপারির গাছ। এতে তাঁর খরচ হয়েছে তিন লক্ষাধিক টাকা।

রুমা অধিকারী জানান, ২০২৪ সালে প্রথম আমের ফলন আসে। তাতে আয় হয় দেড় লক্ষাধিক টাকা। এবার ৩০০ গাছে আমের ফলন পেয়েছেন। বাগানে পরিপক্ব আম জাত ভেদে বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি দরে। তাতে পাঁচ লাখ টাকার ওপরে আয়ের আশা করছেন তিনি। ইতিমধ্যে দুই লক্ষাধিক টাকার আম বিক্রি করেছেন। বাগানটির নাম দিয়েছেন ‘বৃন্দাবন অর্গানিক অ্যাগ্রো ফার্ম’। বাগানে আমের সঙ্গে কমলা, ড্রাগন, মাল্টা ও সুপারির ফল নামলে প্রতিবছর ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা আয়ের আশা করছেন তিনি।

রুমা অধিকারী বলেন, ‘আমি রংপুরে স্বামীর সঙ্গে ছিলাম। কিন্তু গাছপালা আমার খুবই পছন্দের। তাই শহরের বিলাসবহুল জীবন আমাকে আটকাতে পারেনি। তাই স্বামীর পৈতৃক জমিতে বাগান করে প্রত্যান্ত এই গ্রামে বসবাস করছি। পরিবেশবান্ধব এই বাগানের মায়া আমি ছাড়তে পারি না। এক বছর ধরে আমি স্থায়ীভাবে এখানে বসবাস করছি। এখন আমি গাছের সঙ্গে কথা বলি। গাছগুলো আমার সবচেয়ে আপন।’

বাগানে প্রতিদিন দুই থেকে তিনজন শ্রমিক কাজ করেন। রুমা নিজেও শ্রমিকের সঙ্গে কাজ করেন। রুমা অধিকারী বলেন, ‘আমি এই বাগানের পরিধি বাড়াতে চাই। প্রত্যন্ত এই গ্রামে গড়ে তুলতে চাই রিসোর্ট।’ পাশপাশি উন্নত জাতের গরু পালন, অর্গানিক চাষাবাদের জন্য ভার্মি কম্পোস্ট সারের প্ল্যান্ট, এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে চান তিনি। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনি সুদমুক্ত অথবা স্বল্প সুদে ঋণ চান।
তার এ স্বপ্ন পূরণে সহযোগিতা করছেন স্বামী দুলাল অধিকারী। তিনি ছুটিতে বাড়ি এলেই স্ত্রীকে বাগানের কাজে সহায়তা করেন। দূর থেকেও নানা পরামর্শ দেন। দুই ছেলে রুদ্র অধিকারী ও অভি অধিকারীও লেখাপড়ার পাশপাশি মাকে সহযোগিতা করেন।

ভিন্ন জাতের চারা সংগ্রহের বিষয়ে রুমা অধিকারী বলেন, ‘ইউটিউবে বিভিন্ন জাতের আম চাষের ধারণা নিই। বিভিন্ন জাতের আমের চারার খোঁজখবর নিয়ে চারা সংগ্রহ করি। আমি চাই, দেশি জাতের আমের পাশাপাশি মানুষের কাছে উন্নত জাতের আম পৌঁছাক, যেন আমরা বিশ্বমানের ফল চাষে পিছিয়ে না থাকি। এমন ভাবনা থেকে নিজের হাতে গাছ লাগানো, পরিচর্যা করার কাজ শুরু করি। নিজের পরিচর্যার গাছে প্রথম ফল দেখে আমি যে আনন্দ পেয়েছিলাম, সেটি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।’

একজন নারী হয়েও রুমার সাফল্যের কাহিনি ছড়িয়ে পড়েছে এলাকায়। অনেকে ঘুরে দেখেছেন তাঁর বাগান। তাঁদের মধ্যে সুশীল রায় (৬০) বলেন, ‘মানুষের মুখে শুনেছিলাম এখানে বিভিন্ন ধরনের বিদেশি আমগাছ আছে। তাই বাগান দেখতে আসি, সুস্বাদু আম খেয়ে অনেক ভালো লেগেছে। তিনি (রুমা) আমাদের অনুপ্রেরণা, তাঁর এমন সফলতায় অনেকে উদ্যোগ নিচ্ছেন বাগান করার।’

সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আতিক আহমেদ বলেন, ‘আম চাষে রুমা অধিকারীর সফলতা শুধু একটি ব্যক্তিগত গল্প নয়, বরং এটি একটি উদাহরণ, যা দেখিয়ে দেয় পরিকল্পনা, শ্রম ও অদম্য ইচ্ছাশক্তি থাকলে কৃষিতেও গড়ে তোলা সম্ভব টেকসই ভবিষ্যৎ। যদি এমনভাবে তরুণ-তরুণীরা কৃষি খাতে এগিয়ে আসেন, তাহলে দেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী ও সম্ভাবনাময় করা সম্ভব।’

Lading . . .