Advertisement

রংপুরে মাতৃস্বাস্থ্যে চাই বাড়তি উদ্যোগ

প্রথম আলো

প্রকাশ: ২৮ আগস্ট, ২০২৫

24obnd

রংপুর বিভাগের মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবার চিত্র জাতীয় পর্যায়ের চেয়ে করুণ। সেখানকার চরাঞ্চলের যে মায়েরা আছেন, তাঁদের অনেকে নিজেরাই শিশু। তাঁদের দিকে তাকানোও যায় না। স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানোর ক্ষেত্রেও দুর্গম কিছু এলাকা রয়েছে। রংপুরকে বাদ দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোনো সাফল্য আসবে না। অন্যদিকে স্বাস্থ্যসেবা বিষয়টি শুধু একা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নয়। এর সঙ্গে সরকারের অনেকগুলো মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় জরুরি। সবাইকে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি দক্ষ জনবল, অবকাঠামো এবং বরাদ্দের ক্ষেত্রেও রংপুরকে আলাদাভাবে বিবেচনায় নিতে হবে।

গতকাল বুধবার রাজধানীর মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ‘রংপুর অঞ্চলে মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবা: বিদ্যমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথাগুলো বলা হয়। কোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি ‘কোইকা’র সহযোগিতায় ‘সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ’-এর ‘জননী প্রকল্প’ এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। এ আয়োজনে প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো।

গোলটেবিল বৈঠকের শুরুতে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন জননী প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক উজ্জ্বল কুমার রায়। তিনি জানান, রংপুর বিভাগে নবজাতক মৃত্যুর পরিমাণ হাজারে ৩০ জন এবং জাতীয় পর্যায়ে তা ২০ জন। শিশুমৃত্যুর হার রংপুরে ৩৩ জন, যা জাতীয় পর্যায়ে ২৫ জন। ২০১৬ ম্যাটারনাল মটারলিটি সার্ভে অনুযায়ী জাতীয় পর্যায়ে প্রসবকালীন মৃত্যুহার প্রতি লাখে ১৯৬ জন, যা রংপুরে ২২৩ জন। তবে বর্তমানে স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (এসভিআরএস) অনুযায়ী জাতীয় পর্যায়ে প্রসবকালীন মৃত্যুহার প্রতি লাখে ১৩৬ জনে দাঁড়িয়েছে। আর জাতিসংঘের মাতৃমৃত্যু নিরূপণ ইন্টার এজেন্সি গ্রুপের হিসাব অনুযায়ী মাতৃমৃত্যুর হার ১১৫ জন।

জাতীয় পর্যায়ে ১৮ বছরের নিচে কিশোরীদের বিয়ের হার রংপুর বিভাগে ২৭ শতাংশ, জননী প্রকল্পের জরিপে এ সংখ্যা ৬৩ শতাংশ। ১৯ বছরের আগে গর্ভধারণের পরিমাণ রংপুরে ৬৩ শতাংশ, যা জাতীয় পর্যায়ে ২৪ শতাংশ। মিডওয়াইফ দ্বারা প্রসবের পরিমাণ জাতীয় পর্যায়ে ৭০ শতাংশ এবং রংপুর বিভাগে ৪৯ শতাংশ।

রংপুর অঞ্চলের উল্লিখিত চিত্র নিয়ে গোলটেবিলের আলোচকেরা নিজেদের মতামত তুলে ধরেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর মাতৃ, নবজাতক ও শিশুস্বাস্থ্যবিষয়ক লাইন ডিরেক্টর এস এম আবদুল্লাহ আল মুরাদ সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সুস্থ মা ও নবজাতক পেতে হলে প্রসব–পূর্ববর্তী সেবার কোনো বিকল্প নেই। রংপুরে আরও কাজ করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, সেখানে সচেতনতা বাড়ানোর ক্যাম্পেইন করতে হবে। রংপুর অঞ্চলে বাল্যবিবাহ বেশি, তাই স্কুলগুলোতেও ক্যাম্পেইন করা প্রয়োজন।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগীয় পরিচালক দেওয়ান মোর্শেদ কামাল রংপুরের একটি চরাঞ্চলে গিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানান। তিনি যেসব মায়ের চেহারা সেখানে দেখেছেন, তা দেখার মতো নয় বলে উল্লেখ করে বলেন, ১৫ বছর বয়সী এক শিশুর কোলে এক শিশু, পেটেও এক শিশু। তাঁরা নিজেদের জায়গা থেকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু আর্থসামাজিক কারণ, প্রশাসনিক ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন কারণে প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

দেওয়ান মোর্শেদ কামাল আরও বলেন, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের সঙ্গে কমিউনিটি ক্লিনিকের কোনো সংযোগ নেই। এদের মধ্যে সমন্বয় জরুরি।

রংপুর অঞ্চলে নবজাতক ও মাতৃস্বাস্থ্যসেবা ভালো না হওয়ার ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহকে অন্যতম বড় বাধা বলে মনে করেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (এনসিআরএইচ) সোহেল হাবীব। তিনি বলেন, প্রশাসনের সহায়তায় এ বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যেও সমন্বয় থাকতে হবে।

প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব বাড়ানো এবং গর্ভকালীন সেবা–সুবিধা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগীয় পরিচালক ডা. গওসুল আজিম চৌধুরী বলেন, পরিবহন সুবিধা এবং মায়েদের জন্য অ্যাম্বুলেন্স সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। কিশোরীদের বাল্যবিবাহ রোধের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনার লাইন ডিরেক্টর জয়নাল আবেদীন বলেন, সরকারের অনেকগুলো প্রোগ্রাম রয়েছে, কিন্তু এরপরও ভালো সেবা পাওয়া যাচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন সামনে আসে। সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অনেক মানুষ আসেন সেবা নিতে। তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও দক্ষ জনবল প্রয়োজন। সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র গড়ে তোলা প্রয়োজন, যেখানে সরকার জনবল সহায়তা দেবে এবং বেসরকারি খাত অবকাঠামোগত বিনিয়োগ করবে।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব সাইফুল ইসলাম মজুমদার নিজের মাঠের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, জেলা–উপজেলা পর্যায়ে সব মন্ত্রণালয়কে একীভূত করে কাজ করতে হবে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) ইমেরিটাস বিজ্ঞানী শামস এল আরেফিন বলেন, গর্ভকালীন সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ধনী–গরিবের বৈষম্য অনেক। এটার অন্যতম বড় কারণ পদ্ধতিগত বাধা। অনেকেই বলেন, দুর্গম অঞ্চলের কারণে সেবা পৌঁছানো কঠিন। এই কথার মধ্যেই সমাধান রয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সংস্থার সঙ্গে এটা নিয়ে কাজ করতে হবে।

মাঠপর্যায়ে দক্ষ জনবল বাড়ানো এবং আন্তমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের ওপর জোর দিয়ে জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ ইখতিয়ার উদ্দিন খন্দকার বলেন, স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একাই জড়িত নয়। একটি স্বাস্থ্যসেবাকাঠামো গড়ে তুলতে সরকারের অনেকগুলো সংস্থার ভূমিকা রয়েছে। রংপুরে কী সমস্যা, সরকারের কর্মসূচিগুলো কাজ করছে কি না, কমিটিগুলো সক্রিয় কি না—এসব দেখতে হবে। রংপুরকে বাদ দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সাফল্য আসবে না। রংপুরের জন্য বরাদ্দ, জনবলও আলাদাভাবে বিবেচনা করতে হবে।

প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরীর সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে আরও রক্তব্য দেন সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের হেলথ অ্যান্ড নিউট্রিশন ডিরেক্টর ড. গোলাম মোদাব্বির, আরডিআরএস বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়ন বিভাগের প্রধান মজিবুল হক মনির, ইউএনএফপিএ বাংলাদেশের মাতৃস্বাস্থ্য প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট অনিমেষ বিশ্বাস, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেপুটি ডিরেক্টর (রংপুর) মো. ওয়াজেদ আলী, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রোগ্রাম ম্যানেজার (নবজাতক ও শিশুস্বাস্থ্য) ও সহকারী পরিচালক (সার্ভিসেস) মো. নাসির আহমেদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রোগ্রাম ম্যানেজার (মাতৃস্বাস্থ্য) মোয়াজ্জেম হোসেন সরকার, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (সার্ভিসেস) ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার (মাতৃস্বাস্থ্য) আ ন ম মোস্তফা কামাল মজুমদার, রংপুরের সিভিল সার্জন শাহীন সুলতানা, লালমনিরহাটের সিভিল সার্জন আব্দুল হাকিম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাতৃস্বাস্থ্যের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (মনিটরিং) সেলিনা আক্তার, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির প্রোগ্রাম অফিসার নাসিমা খাতুন, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের লালমনিরহাটের উপপরিচালক (পরিবার পরিকল্পনা) মো. শাহ জালাল, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের রংপুরের উপপরিচালক (পরিবার পরিকল্পনা) মো. সাইফুল ইসলাম।

Lading . . .