Advertisement

চাকরিতে কর্মক্ষেত্রে আস্থা তৈরি করবেন যেভাবে

প্রথম আলো

প্রকাশ: ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

খুব সরলভাবে বলা যায়, বিশ্বাস বা আস্থা থাকে বলে গ্রাহকেরা ব্যাংকে অর্থ জমা রাখেন। আস্থা থাকে বলেই ব্যাংকে হাজারো টাকা রেখে আমরা বাড়িতে নিশ্চিন্তে ঘুমাই। আস্থা না থাকলে ব্যাংকে অর্থ রাখেন না গ্রাহকেরা। ব্যবসা কিংবা যেকোনো প্রতিষ্ঠান অনেক দিন টিকে থাকে তার বিশেষ এক গুণের জন্য। এই গুণের নাম আস্থা বা বিশ্বাস। গ্রাহকেরা পণ্যের ওপর আস্থা বা বিশ্বাস না রাখলে সেই পণ্য বা প্রতিষ্ঠান বাজার থেকে হারিয়ে যেতে পারে। গ্রাহকের বিশ্বাস ভাঙলে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার নজির অনেক আছে। একইভাবে আমরা যখন কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, আমাদের প্রতিষ্ঠান ও কাজের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি করতে হয়। যেকোনো সফল প্রতিষ্ঠান বা দলের দিকে তাকালে একটি অদৃশ্য, কিন্তু শক্তিশালী এই উপাদান খুঁজে পাই। কর্মী বা ব্যবস্থাপক হিসেবে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস বড় একটা গুণ। আস্থা অর্জন ও বিশ্বাস কিন্তু নিছক কোনো সফট স্কিল নয়। পেশাগত জীবনে সামনে এগিয়ে যাওয়া, কর্মী হিসেবে দক্ষতা অর্জনের জন্য একটি কৌশলগত সম্পদ। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউয়ের গবেষণা অনুযায়ী, যে অফিসে আস্থার পরিবেশ বেশি থাকে, সেখানে কর্মরত কর্মীরা বেশি উৎপাদনশীল কাজ করেন। তাঁরা প্রতিষ্ঠানের প্রতি দ্বিগুণ বেশি অনুগত থাকেন।

আস্থার চরিত্র তৈরি করুন

নেতৃত্ব বিশেষজ্ঞ স্টিফেন এম আর কভি ‘দ্য স্পিড অব ট্রাস্ট’ গ্রন্থে দক্ষতা হিসেবে আস্থার দুটি পিলারের কথা জানান। চরিত্র ও সক্ষমতাকে গুরুত্ব দিয়ে আস্থা তৈরি করতে হয়। ব্যক্তিত্বকে চরিত্রের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কর্মী হিসেবে আপনার সততা শুধু প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়, নিজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কি সত্য কথা বলেন? আপনার কাজে কি স্বচ্ছতা আছে? আপনার কাজের পেছনের উদ্দেশ্য কী? আপনি কি নিঃস্বার্থভাবে দল ও প্রতিষ্ঠানের ভালো চান? যখন আপনার সহকর্মীরা বিশ্বাস করেন, আপনার উদ্দেশ্য সৎ, তখন তাঁরা আপনার সিদ্ধান্তকে সহজভাবে গ্রহণ করেন। আস্থার সঙ্গে সক্ষমতা বিষয়টি জড়িত। আপনার কি দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা আছে? আপনি কি প্রতিনিয়ত নিজেকে উন্নত করছেন? আপনার কি ধারাবাহিকভাবে ভালো কাজ করার ট্র্যাক রেকর্ড আছে? অতীতে আপনি যা করেছেন, তা–ই আপনার ভবিষ্যৎ নির্ভরযোগ্যতার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। কোন একজন নির্বাহী হয়তো ব্যক্তিগতভাবে খুবই সৎ, কিন্তু তাঁর টিম পরিচালনায় দক্ষতার অভাব থাকতে পারে। তখন প্রতিষ্ঠান বা দল তাঁকে পছন্দ করলেও তাঁর ওপর আস্থা রাখতে পারে না। অন্যদিকে একজন কর্মী অত্যন্ত দক্ষ, কিন্তু প্রায়ই নিজের সুবিধার জন্য তথ্য গোপন করেন। তখন তাঁর দক্ষতার কারণে কাজ দেওয়া হলেও তাঁকে কেউ বিশ্বাস করবেন না।

আস্থা অর্জন করতে হয়

আস্থা অর্জনের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী মুদ্রা হলো নির্ভরযোগ্যতা। গবেষক জ্যাক জেঙ্গার ও জোসেফ ফোকম্যান বলেন, একজন নেতার সম্পর্কে অন্যের ধারণার ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্যতা বা ধারাবাহিকতা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। নির্ভরযোগ্যতা মানে হলো, আপনারা যা বলছেন, তা করছেন কি না, একে ইংরেজিতে সে–ডু রেশিও বলে। কথা ও কাজের এই অনুপাত ১: ১ হওয়া প্রয়োজন।

নিজেকে সময় দিন

চাকরির প্রথম দিন থেকেই আপনি নিজেকে নির্ভরযোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন না। যেকোনো ক্ষেত্রেই কম প্রতিশ্রুতি দিন, কিন্তু বেশি কাজ করুন, এমন মনোভাব রাখুন। যদি আপনার মনে হয়, কোনো কাজ করতে পাঁচ দিন লাগবে, তাহলে ছয় দিনের সময় নিন। পাঁচ দিনের মাথায় ডেলিভারি দিন। এটি আপনার ওপর নির্ভরতা বাড়ায়। করপোরেট ক্ষেত্রে আপনার কাজের অগ্রগতির জন্য যেন কাউকে জিজ্ঞাসা করতে না হয়। আপনি নিজেই সময়মতো আপডেট দিন। কাজ কত দূর, এই প্রশ্ন শোনার আগেই উত্তর দিয়ে দিন। কোনো কাজ যদি সম্ভব না হয়, তবে শুরুতেই বিনয়ের সঙ্গে, কিন্তু স্পষ্টভাবে না বলুন বা একটি বিকল্প প্রস্তাব দিন। মিথ্যা আশ্বাস বা নীরব থাকা আস্থার জন্য বিষতুল্য।

নিজেকে তৈরি করুন

মনোবিজ্ঞানী ডেনিস অর্গান নিজের ওপর আস্থা আনার জন্য দায়িত্বকে জোর দেন। আপনার আনুষ্ঠানিক দায়িত্বের বাইরে প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নতিতে সাহায্য করে, এমন কাজের দিকে খেয়াল রাখুন। এমন মনোভাব শুধু প্রতিষ্ঠানের উন্নতি নয়, আপনার নেতৃত্ব প্রকাশের সুযোগ দেবে।

যোগাযোগ উন্নত করুন

আস্থা ও বিশ্বাস তৈরির জন্য নিজের যোগাযোগের ধরনে পরিবর্তন আনতে পারেন। যোগাযোগ কেবল তথ্য আদান–প্রদান নয়, এটি সম্পর্ক তৈরির মাধ্যম। আস্থা তৈরিতে যোগাযোগের তিনটি মাত্রা অপরিহার্য। গবেষক ব্রেনে ব্রাউন মনে করেন, স্পষ্টভাবে কথা বলাই হলো দয়া। অস্পষ্টতা সন্দেহ ও অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। দক্ষ যোগাযোগ অন্যের অনুভূতিকে বোঝা ও তাঁর প্রতি সম্মান জানানোর ক্ষমতাকে বাড়ায়। গবেষক ড্যানিয়েল গোলম্যান বিষয়টিকে আবেগকেন্দ্রিক বুদ্ধিমত্তা হিসেবে প্রকাশ করেছেন। যখন সহকর্মীরা অনুভব করেন, আপনি তাঁদের পরিস্থিতি বোঝেন, তখন আস্থার সম্পর্ক গভীর হয়। এ জন্য নিজের ব্যক্তিত্বকে উন্নত করতে পারেন। সক্রিয় শ্রবণ নামের একটি কৌশল অনুশীলন করুন। প্রশ্ন শুনে সব সময় উত্তর দেওয়ার জন্য তৈরি থাকবেন না, বোঝার জন্য শুনুন। অন্যের কথা শেষ হলে, তা বুঝে উত্তর দিন। আপনি মনোযোগ দিয়েছেন, এটা প্রমাণ করুন। অফিসে তর্কবিতর্ক কিংবা কাজ নিয়ে প্রতিযোগিতা থাকবেই। এ ক্ষেত্রে গঠনমূলক মতামত অনুশীলন করুন। প্রশ্ন বা সমালোচনার জন্য মতামত দেওয়ার বদলে উন্নত হয় বা ভালো হয়, এমন আচরণে মনোযোগ দিন। আবার আস্থা মানে এই নয় যে সবাই সব সময় একমত হবেন। আস্থাশীল যেকোনো কাজের দলে ভালো বিতর্কের কারণে ভালো কাজ বা নতুন আইডিয়া তৈরি হয়। ব্যক্তিকে নয়, আইডিয়াকে চ্যালেঞ্জ করুন। আপনার আইডিয়াটা খারাপ, এমন না বলে আপনার আইডিয়ার বিকল্প আছে কিন্তু!

যাঁরা সহকর্মী হিসেবে বিশ্বাসী, তাঁরা নিজের দুর্বলতা জানেন। আত্মরক্ষা বা অন্যের ওপর দোষ চাপানোর প্রবণতা দ্রুত আস্থা নষ্ট করে। সততার সঙ্গে নিজের ভুল স্বীকার করে দায়ভার নেওয়া শিখতে হবে।

লেখক: খালেদ মাহমুদ , অধ্যাপক, বিবিএ প্রোগ্রামের কো–অর্ডিনেটর, ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Lading . . .