প্রিয়নবী (সা.)-এর জন্ম ও বংশধারা সম্পর্কে কতটুকু জানেন?
প্রকাশ: ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমন ছিল এমন এক আলো, যা পৃথিবী থেকে জাহিলিয়াতের অন্ধকার দূর করে মানবজাতিকে সঠিক পথ দেখিয়েছে। কেউই অস্বীকার করেন না যে, বংশ, চরিত্র ও অবয়ব সব দিক দিয়েই মহানবী (সা.) ছিলেন মানব ইতিহাসের সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি।
সহিহ মুসলিম শরিফে বর্ণিত এক হাদিসে নবীজী (সা.) বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ ইবরাহিমের সন্তানদের মধ্য থেকে ইসমাইলকে বেছে নিয়েছেন, ইসমাইলের বংশ থেকে কিনানাকে বেছে নিয়েছেন, কিনানার মধ্য থেকে কুরাইশকে, কুরাইশের মধ্য থেকে বনু হাশিমকে, আর বনু হাশিম থেকে আমাকে বেছে নিয়েছেন।
এই হাদিসটি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, নবুয়তের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য নবীজির (সা.) বংশ ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত এক বিশেষ নির্বাচন।
নবীজির পূর্ণ নাম ও বংশ
ইমাম বুখারী (রহ.) নবী করিম (সা.)-এর পূর্ণ বংশধারা এভাবে উল্লেখ করেছেন :
তিনি আবুল কাসিম মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম ইবনে আবদু মানাফ ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব ইবনে মুররাহ ইবনে কা’ব ইবনে লুয়ি ইবনে গালিব ইবনে ফিহর ইবনে মালিক ইবনে নাযর ইবনে কিনানা ইবনে খুযাইমা ইবনে মুদরিকা ইবনে ইলিয়াস ইবনে মুযার ইবনে নিযার ইবনে মাদ ইবনে আদনান।
আরও পড়ুন
সব ইতিহাসবিদ একমত যে, আদনান ছিলেন নবী ইসমাইল (আ.)-এর বংশধর। তবে আদনান থেকে ইসমাইল (আ.) পর্যন্ত ঠিক কত প্রজন্ম এবং কারা ছিলেন, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, এ পর্যন্ত (আদনান পর্যন্ত) বংশধারা নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য।
ইব্রাহিম (আ.)-এর দোয়া ও ঈসা (আ.)-এর সুসংবাদ
নবীজী (সা.) নিজেই তার পরিচয় দিয়েছেন এভাবে: আমি হচ্ছি আমার পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া এবং আমার ভাই ঈসা (আ.)-এর সুসংবাদ।
মহানবী (সা.)-এর মা আমিনা বিনতে ওহাব বলেছিলেন, তিনি গর্ভাবস্থায় স্বপ্নে দেখেন যে তার দেহ থেকে এমন এক আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে, যা সিরিয়ার প্রাসাদগুলোকে আলোকিত করে দিচ্ছে। এর মাধ্যমে ইঙ্গিত করা হয় নবীজির (সা.) মহান দায়িত্ব ও পবিত্র উৎসের প্রতি, যা খলিলুল্লাহ ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর সঙ্গে যুক্ত।
কোরাইশ গোত্রে আগমন : ঐশী পরিকল্পনার অংশ
নবীজী (সা.)-কে আরবদের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন গোত্র কুরাইশ, এবং তার মধ্যেও সবচেয়ে সম্মানিত পরিবার বনু হাশিম থেকে পাঠানো হয়েছে—এটি ছিল এক বিশেষ ঐশী পরিকল্পনা।
এই উচ্চ বংশ তাকে সমাজে গ্রহণযোগ্যতা দেয়, লোকজনের মধ্যে প্রভাব তৈরি করে। তবে ইসলাম এ শিক্ষা দেয় যে, আসল মর্যাদা আসে তাকওয়া ও নেক আমলের মাধ্যমে, কেবল বংশ বা জাতিগত পরিচয়ের মাধ্যমে নয়।
পিতা আবদুল্লাহ ও মাতা আমিনার বিবাহ
নবীজীর (সা.) পিতা আবদুল্লাহ ছিলেন তার দাদা আব্দুল মুত্তালিব-এর সবচেয়ে প্রিয় সন্তান। তিনি তাকে মক্কার সম্মানিত নারী আমিনা বিনতে ওহাব-এর সঙ্গে বিবাহ দেন। এই বিয়ের পূর্বেই আবদুল্লাহ কোরবানির জন্য নির্ধারিত হন, তবে একশো উট ফিদিয়া দিয়ে তাকে রক্ষা করা হয়।
দুঃখজনকভাবে, বিবাহের কিছুদিন পরই আবদুল্লাহ সিরিয়ার পথে এক বাণিজ্য সফরে গিয়ে মারা যান। তিনি মদিনায়, তাকে নানার বাড়িতে বনু আদি ইবনে নজ্জার-এর এলাকায় দাফন করা হয়। সে সময় আমিনা গর্ভবতী ছিলেন এবং তার গর্ভেই বেড়ে উঠছিলেন মানবতার মুক্তিরদূত মুহাম্মদ (সা.)।
নবীজির জন্ম : এক ঐতিহাসিক আলোকবর্তিকা
নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম হয় রবিউল আউয়াল মাসে ইয়ামুল ইসনাইন (সোমবার) আমুল ফিল সালে (হাতির বছর)। কবি আহমদ শাওকি এ দিনকে স্মরণ করে বলেন : জন্ম নিল হিদায়াত, আর বিশ্বজগত আলোকিত হলো।
তার জন্মের হাজার বছর ধরে জ্বালিয়ে রাখা পারস্যের আগুন নিভে যায়, তাগুতের সিংহাসন কেঁপে উঠে, বাতিলের ভিত নড়ে ওঠে। সত্যিকার অর্থে, এটি ছিল মানবজাতির ইতিহাসে এক নতুন মোড়। পৃথিবী এই দিনই পেয়েছিল ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’।
ইবন কাসীর উল্লেখ করেছেন, নবীজির জন্মের সময় তার মায়ের দেখা আলো শাম (সিরিয়া) অঞ্চলের প্রাসাদে আলো ছড়িয়েছিল—এটি এক ইঙ্গিত যে, ইসলাম পরবর্তীতে শাম অঞ্চলে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করবে এবং কিয়ামতের আগে এখানেই ঈমানের শেষ দুর্গ হবে—যা সহীহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।
সূত্র : আল জাজিরা