প্রকাশ: ৭ আগস্ট, ২০২৫

টাকা জীবনের অপরিহার্য উপাদান। মানুষ প্রতিদিনই টাকা ব্যবহার করে। কিন্তু কেউ কি কখনো ভেবেছি, আমাদের পূর্বসূরি মুসলিমরা কী ধরনের মুদ্রা ব্যবহার করতেন?
তারা কি টাকা ব্যবহার করতেন, না কি লেনদেনের জন্য তাদের অন্য কোনো পদ্ধতি ছিল? চলুন সময়কে একটু পিছনে ফিরিয়ে দেখি, প্রাথমিক মুসলিমদের লেনদেন পদ্ধতি কেমন ছিল।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময়কাল ছিল দুটি প্রধান সুপার পাওয়ার বা পরাশক্তির যুগ। একদিকে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য, অন্যদিকে পারস্য সাম্রাজ্য।
উভয় সাম্রাজ্য রাজাদের শাসনে চলত এবং নির্ধারিত শাসনব্যবস্থা ছিল, যা সেখানকার জনগণ মেনে চলত।
কিন্তু আরব উপদ্বীপে জীবনধারা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণে গোত্রপ্রধানদের নির্বাচন করা হতো এবং গোত্রব্যবস্থাই ছিল সমাজজীবনের মূল ভিত্তি।
আরব ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসিদ্ধ। আরবের মানুষ দূর-দূরান্তে যেত বাণিজ্যের জন্য। তারা পায়ে হেঁটে কিংবা উট-ঘোড়ার কাফেলায় করে ভ্রমণ করত এবং পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে লেনদেন করত।
সেই সময়ের দুটি মূল্যবান সুগন্ধি ছিল ‘ফ্র্যাংকইনসেন্স’ ও ‘মাইর’—যা শুধু আরবেই পাওয়া যেত। এছাড়া তারা মসলা, সোনা, হাতির দাঁত, মুক্তা ইত্যাদিও বাণিজ্যে ব্যবহার করত।
তাদের সমাজ পণ্য বিনিময়কেন্দ্রিক হওয়ায় মুদ্রার প্রয়োজন ছিল না। তাহলে প্রশ্ন আসে, কবে মুসলিমরা মুদ্রা ব্যবহার শুরু করল?
মুসলমানদের মধ্যে মুদ্রা ব্যবহারের সূচনা
রাসুল (সা.)-এর ওফাতের কয়েক বছর পর ইসলামী সাম্রাজ্য পূর্ব-পশ্চিমে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে এবং অসংখ্য মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে।
নতুন নতুন অঞ্চলে মুসলিম নেতৃবৃন্দ প্রবেশ করলে তাদেরকে সেখানে শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে হয় কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে। এভাবে আসে মুদ্রার ব্যবহার।
আরও পড়ুন
বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে প্রচলিত ছিল ‘সলিডাস’ নামে সোনার মুদ্রা। পারস্যে প্রচলিত ছিল রৌপ্যমুদ্রা ‘দ্রাখম’। মুসলিম গভর্নররা প্রাথমিকভাবে আগের মতোই ওইসব মুদ্রা চালু রাখেন—যার মধ্যে ছিল খ্রিস্টীয় ক্রুশ, রাজমুকুটধারী সম্রাট এবং অগ্নিমন্দিরের প্রতীক।
ইসলামী মুদ্রায় ইসলামী চিহ্ন
খলিফা উসমান (রা.)-এর সময় পারস্য রৌপ্যমুদ্রার প্রান্তে আরবি লিপিতে ‘বিসমিল্লাহ’ খোদাই করা শুরু হয়। এছাড়া, বাজারে ইসলামী সভ্যতার প্রভাব বাড়তে থাকে, ফলে মুদ্রার ওপর ইসলামী লেখা এবং হিজরি সাল লেখা শুরু হয়। তবে এটিকে এখনো পূর্ণ ইসলামী মুদ্রা বলা যায় না। কারণ তখনো রাজা-মহারাজাদের প্রতিকৃতি ও পাশতো-ফার্সি লেখা বহাল ছিল।
ইসলামী মুদ্রার প্রকৃত সূচনা
আসল ইসলামী মুদ্রা চালু হয় হিজরি ৭৭ সালে, বা খ্রিস্টাব্দ ৬৯৬-৬৯৭ সালে। তখন উমাইয়া খিলাফতের পঞ্চম খলিফা ছিলেন আব্দুল মালিক ইবন মারওয়ান। তিনি মুদ্রায় আমূল সংস্কার আনেন। সব অমুসলিম প্রতীক ও ছবি বাদ দিয়ে আরবি লিপিতে শুধু ইসলামী বাণী খোদাই করেন।
তিনি সোনা ও রুপার মুদ্রার ওজন নির্ধারণ করেন এবং নতুন নাম দেন। সোনার মুদ্রার নাম হয় দিনার (ল্যাটিন শব্দ ‘ডিনারিয়াস’ থেকে, যার অর্থ সোনার মুদ্রা)। রুপার মুদ্রার নাম হয় দিরহাম (গ্রিক শব্দ ‘ড্রাখমে’ থেকে, যার অর্থ মুদ্রা)।
এই মুদ্রাগুলোতে ইসলামী ভাবধারা প্রতিফলিত হতো। এক পাশে কুফি লিপিতে শাহাদাহর প্রথম অংশ খোদাই থাকত। অন্য পাশে লেখা হতো সূরা আত-তাওবার ৩৩ নম্বর আয়াত। যেখানে লেখা ছিল, ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল; তিনি তাকে হেদায়াত ও সত্যদ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি একে সব ধর্মের ওপর বিজয়ী করেন’।
এই প্রাচীন ইসলামী মুদ্রা একই রকম নকশা ও ওজন নিয়ে হাজার বছর পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।
ইসলামী মুদ্রা ছিল মুসলিম দুনিয়ায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন, যা একজন উমাইয়া শাসকের হাত ধরে বাস্তবায়িত হয়। এটি মুসলিম ব্যবসায়ীদের মধ্যে আত্মমর্যাদা তৈরি করে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি চমৎকার ইতিহাস রেখে যায়।
এই মুদ্রাগুলো আজও বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। যেখানে মানুষ তা দেখে, শিখে ও প্রশংসা করতে পারে মুসলিম জাতির গৌরবোজ্জ্বল অতীত নিয়ে।
সূত্র : অ্যাবাউট ইসলাম