প্রকাশ: ১০ আগস্ট, ২০২৫

প্রয়োজনীয় পণ্য মজুত রেখে জনসাধারণের মাঝে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করেন অনেক ব্যবসায়ী। ক্রেতারা প্রয়োজনীয় পণ্য সহজলভ্য দামে না পেয়ে বেশি দামে কিনতে বাধ্য হন।
মজুত, সঙ্কট ও ক্রেতাদের ভোগান্তির বিষয়টি বর্তমানে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। বাংলাতে গুদামজাত বা মজুত করে রাখার বিষয়টিকে ইংরেজিতে সিন্ডিকেট ও আরবিতে ইহতেকার বলা হয়।
বিখ্যাত হাদিস বিশারদ হাফেজ ইবনু হাজার আসকালানী (রহ.) মজুতদারির সংজ্ঞা সম্পর্কে বলেছেন :
هُوَ اشْتِرَاءُ الطَّعَامِ فِي الْحَضَرِ لِحَبْسِهِ عَنْ الْبَيْعِ، فَيَضُرُّ بِالنَّاسِ عِنْدَ غَلَائِهِ
জনগণের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও, মূল্যবৃদ্ধির অপেক্ষায় খাদ্য বিক্রি থেকে বিরত থাকাই মজুতদারি। (ফাতহুল বারী, ৪/৪৪০)
আধুনিক আরবি গবেষক আহমাদ হিলমি সাইফ আন-নাসর বলেন :
السِّينْدِيكَاتُ هُوَ حَبْسُ مَا يَحْتَاجُهُ النَّاسُ، سَوَاءٌ كَانَ طَعَامًا أَوْ غَيْرَهُ، لِإِضْرَارِهِمْ
সিন্ডিকেট মানে মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিস আটকে রাখা, সেটা খাদ্য হোক বা অন্য কিছু, যাতে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বর্তমান প্রেক্ষাপট
‘সিন্ডিকেট’ শব্দটি বর্তমানে সবার পরিচিত। বড় বাজার থেকে ছোট দোকান সবার মুখে মুখে এই শব্দ। পত্রিকা, টেলিভিশনে বাজার-দখলকারী সিন্ডিকেট চক্রের খবর প্রায়শই উঠে আসে।
কেউ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে লাভবান হন। আবার কেউ সিন্ডিকেটের জাঁতাকলে পিষ্ট হন।
ইসলামের বিধান লঙ্ঘন করে ব্যবসায়ীরা পণ্য গুদামজাত করে রাখার ফলে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে প্রয়োজনীয় দ্রব্য মজুত করতে শুরু করেন। বাজারে পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয়। এ সময় ব্যবসায়ীরা ইচ্ছাকৃতভাবে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করেন। আকাশচুম্বী মূল্যের ফলে ভোগান্তির শিকার হন সাধারণ মানুষ।
মজুতদারি সম্পর্কে হাদিসে যা বলা হয়েছে
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন :
لَا يَحْتَكِرُ إِلَّا خَاطِئٌ
শুধুমাত্র পাপী ব্যক্তিই মজুতদারি করে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৬০৫)
আরেক হাদিসে এসেছে :
مَنْ احْتَكَرَ عَلَى الْمُسْلِمِينَ طَعَامًا ضَرَبَهُ اللَّهُ بِالْجُذَامِ وَالْإِفْلَاسِ
যে মুসলমানদের জন্য খাদ্য মজুত করে (দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে), আল্লাহ তাকে কুষ্ঠরোগ ও দারিদ্র্যে আক্রান্ত করবেন।
হজরত আলী রা. বলেন :
مَنِ احْتَكَرَ طَعَامًا أَرْبَعِينَ يَوْمًا فَقَدْ بَرِئَ مِنَ اللَّهِ، وَبَرِئَ اللَّهُ مِنْهُ
যে চল্লিশ দিন খাদ্য মজুত করবে, সে আল্লাহর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে এবং আল্লাহ তার থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন।
আরও পড়ুন
যে অবস্থায় গণ্য গুদামজাত করা হারাম
১. স্বল্পমূল্যে খাদ্য কিনে অধিক মুনাফার আশায় এমনভাবে গুদামজাত করা যাতে বাজারে প্রভাব পড়ে।
২. কোনো দ্রব্য এমন পরিমাণে মজুত করা যাতে ক্রেতাসাধারণ চরম সংকটে পড়ে।
৩. খাদ্য সংকটের সময় যেকোনো পরিমাণ খাদ্য মজুত করা।
৪. কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির উদ্দেশ্যে গুদামজাত করা। এসব অবস্থায় গুদামজাত করা হারাম ও গুনাহের কাজ।
সিন্ডিকেটের ক্ষতিকর প্রভাব
মজুতদারের প্রকারভেদ
প্রথম প্রকার:
মূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্য ছাড়া নিজের পরিবারের প্রয়োজন পূরণের জন্য পর্যাপ্ত সময় নিয়ে সস্তায় পণ্য কিনে রাখা।
ইমাম তিরমিজি (রহ.) বলেন, আলেমগণ অন্যকে কষ্ট না দিয়ে পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য মজুতের অনুমতি দিয়েছেন। খাদ্যদ্রব্য ছাড়া অন্যান্য পণ্য সংরক্ষণেও অনুমতি আছে।
দ্বিতীয় প্রকার :
যে মূল্যবৃদ্ধির অপেক্ষায় পণ্য মজুত করে এবং প্রয়োজনে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে। হাদিসে এটিকেই প্রকৃত মজুতদারি বলা হয়েছে এবং একে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।
ইসলামের চূড়ান্ত বিধান
অধিকাংশ ফকিহের মতে, মজুতদারি হারাম। বিশেষ করে যখন উদ্দেশ্য হয় বাজার অস্থিতিশীল করা ও সাধারণ মানুষকে কষ্টে ফেলা। কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন :
وَالَّذِينَ يُؤْذُونَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ بِغَيْرِ مَا اكْتَسَبُوا فَقَدِ احْتَمَلُوا بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُّبِينًا
যারা বিনা কারণে মুমিন পুরুষ ও নারীদের কষ্ট দেয়, তারা বড় অপবাদ ও সুস্পষ্ট গুনাহের বোঝা নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়। (সুরা আল-আহযাব, আয়াত :৫৮)
স্পষ্টভাবে জেনে রাখা দরকার, যেসব জিনিসে নিম্নের বৈশিষ্ট্যগুলো থাকে, সেগুলো মজুত করা শরিয়তে নিষিদ্ধ :
১. বস্তুটি প্রচলিতভাবে মানুষ বা পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
২. বস্তুটি এমন স্থানের উৎপাদিত, যা ওই শহরে সরবরাহ হয়।
৩. মজুত করার ফলে শহরের বাসিন্দাদারা কোনোভাবে ক্ষতি হয়।
সুতরাং সাধারণ মানুষের যদি কোনো পণ্যের প্রয়োজন থাকে এবং মজুত করার কারণে তা সহজে পাওয়া না যায় ফলে মানুষ ভোগান্তিতে পড়ে অথবা এর দাম এত বেড়ে যায় যে তা সাধারণ মানুষের জন্য তা কেনা কষ্টসাধ্য হয় এবং এ কারণে তাদের ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়, তবে সেই পণ্য মজুত করা বৈধ নয়।
যে মজুতদারি নিষিদ্ধ নয়
তবে যদি কেউ মজুতদারি বা মানুষের ক্ষতি করার উদ্দেশ্য ছাড়া শস্য কিনে জমা রাখে এবং বাজারে তা ন্যায্য মূল্যে সহজলভ্য থাকে, তবে তা নিষিদ্ধ মজুতদারির অন্তর্ভুক্ত হবে না। একইভাবে, বড় শহরে কেউ শস্য বা খাদ্যসামগ্রী মজুত করলেও যদি তাতে মানুষের কোনো ক্ষতি না হয়, তবে সেটি বৈধ হবে।
উপরোক্ত শর্তগুলো না থাকলে অর্থাৎ খাদ্য ও শস্য ছাড়া অন্য কোনো জিনিস মজুত করা নিষিদ্ধ মজুতদারির মধ্যে পড়বে না। (আদ-দুররুল মুখতার ও হাশিয়াতু ইবনে আবেদীন, খণ্ড: ৬, পৃষ্ঠা ৩৯৮)
লেখক: শিক্ষক, মারকাযুস সুন্নাহ মাদরাসা ঢাকা। মাতুয়াইল, ডেমরা, ঢাকা।