প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

সুধীর সাহা
বাঙালি হিন্দুদের দুর্গাপূজা। রাজা কংসনারায়ণের হাত ধরে ৫৪০ বছর আগে বাংলায় দুর্গাপূজা শুরু হয়েছিল। অবিভক্ত ভারতবর্ষের বরেন্দ্র অঞ্চলের শহর রাজশাহীর তাহেরপুরের সামন্ত রাজা ছিলেন কংসনারায়ণ। মোগল শাসক থেকে রাজা উপাধি প্রাপ্তি উপলক্ষে তিনি দুর্গাপূজার সূচনা করেছিলেন। রাজা কংসনারায়ণ এমন কিছু করতে চাইলেন, যার ফলে হিন্দুসমাজ তাঁকে আজীবন মনে রাখবে। রাজা পণ্ডিতদের ডাকলেন রাজসভায়। জানালেন, তিনি আয়োজন করতে চান অশ্বমেধ যজ্ঞ। কিন্তু পণ্ডিতেরা রাজার এ ইচ্ছে নাকচ করে দিলেন। তারা বললেন, কলিযুগে অশ্বমেধ যজ্ঞের বিধান শাস্ত্রে নেই। পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী রাজাকে বিকল্প হিসেবে দেবী দুর্গতিনাশিনীর পূজা করার পরামর্শ দিলেন। রাজা সম্মত হলেন।
মহা সমারোহে হয়ে গেল এরপর দুর্গোৎসব। রাজা খরচ করলেন সেসময়ের সাড়ে ৮ লাখ টাকা। রাজা কংসনারায়ণের দুর্গাপূজার রীতি অনুযায়ী এখনো রাজশাহীর তাহেরপুরে দুর্গাপূজা হয়। সেখানে মাটির প্রতিমায় দুর্গাপূজা হয় না; প্রতিমা বিসর্জনও হয় না। অষ্টধাতুর স্থায়ী একটি দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করা হয়েছে। প্রতি বছর সেই প্রতিমা দিয়েই সেখানে হচ্ছে দুর্গাপূজা। রাজবংশের পরবর্তী বংশধর ১৯৪৭ সালে ভারতভাগের পর দেবীবিগ্রহসহ ভারতের জলপাইগুড়ি চলে গেলে তারপরও স্থানীয় উদ্যোগে একই পদ্ধতিতে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয় এখানে।
বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা। ৩২ হাজার ছাপিয়ে যায় পূজামণ্ডপের সংখ্যা। অন্যদিকে, কলকাতার কথা ছেড়ে দিলেও পশ্চিমবঙ্গের সর্বস্তরে সব মানুষই সেজে ওঠে নতুন করে দুর্গাপূজার আনন্দোৎসবে। এবার কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গে মোট ৪২ হাজারের বেশি ক্লাব-প্রতিষ্ঠানে সর্বজনীন দুর্গাপূজা হবে। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে অনুদান পাবে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা করে। একেকটি পূজামণ্ডপ যেন জাদুর ছোঁয়ায় পরিণত হয় প্রাসাদ, মন্দির কিংবা দূর্গে। তখন দুই বাংলার পুরোটা জুড়েই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটে নিঃশব্দে। একান্তই বাংলার আবেগ। পরিশীলিত, রুচিশীল সৃষ্টিশীলতার এক অদম্য প্রতিযোগিতা। এ উৎসব আমাদের শেখায়—ধর্ম আলাদা হলেও উৎসব সবার। এই থিমের দীর্ঘদিনের সংস্কৃতির পরম্পরার স্বীকৃতিও মিলেছে কলকাতার উৎসবের ইউনেস্কোর হাত ধরে। ২০২১ সালে ইউনেস্কোর আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় ‘কলকাতার দুর্গাপূজা’ স্থান করে নিয়েছে।
বাঙালি অপেক্ষায় বেঁচে থাকে। অপেক্ষা—তা সে স্বাধীনতার জন্য হোক, কী অধিকারের জন্য, প্রেম-ভালোবাসা কিংবা বৈষম্যবিরোধী উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য। অপেক্ষার মধ্যেই সে দেখতে পায় তার তপস্যার ছায়া। তেড়েফুড়ে সে কিছু করতে পারে না—পিঠ ঠেকে না যাওয়া পর্যন্ত সে অপেক্ষা করে। এমন হাল ছেড়ে দেওয়া নিয়তিবাদ থেকে আশাবাদের জীবনদর্শনই বাঙালি হিন্দুসমাজের দুর্গাপূজা। তাই সে অপেক্ষাও দুর্গাপূজার জন্য। বছরের পাঁচটি দিনের জন্য আকুলভাবে চেয়ে থাকা। অষ্টমীর অঞ্জলি, সন্ধিপূজার একশ আটটি প্রদীপে কারো আগ্রহ থাকুক বা না-ই থাকুক, আলো-মেলা-মাইক-বাজনা, নতুন জামা, খাওয়া-দাওয়া, প্রতিমা দেখার ভিড়-হুল্লোড়—এসবের জন্য বাঙালি হিন্দুদের অপেক্ষা চোখে পড়ার মতো। এ যেন এক অন্য স্তরের অপেক্ষা! এ মূলত দশভূজাকে স্রেফ পূজা করার অপেক্ষা নয়, পূজাকে বাঙালি হিন্দুরা মেলাতে চেয়েছে সামগ্রিকতার সঙ্গে, সামাজিকতার সঙ্গে।
আরও পড়ুন
মর্তলোকে আসছেন দেবী
যে দুর্গা থাকেন কৈলাসে, বাঙালি তাকে ঘরের মেয়ে করে বাড়িতে আনে বছরে পাঁচদিন। চার ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘরের মেয়ে আবার ফিরে যান শিবের কাছে বিজয়া দশমীতে। বাঙালির এই দুর্গাকে নিজের মতো করে গড়ে নিতে কোনো বিধি-নিষেধ নেই। এই দুর্গা বাঁচতে শিখেছে নিজের শর্তে। এই দুর্গাকে বাপের বাড়ি আনতে গেলে কোনো শাশুড়ির অনুমতি নিতে হয় না। ছেলেমেয়ে নিয়ে একাই দিব্যি চলে আসেন। মায়ের হাতে রান্না খেয়ে একটু নির্ভেজাল শান্তিতে থাকবে বলে আসেন পূজার ক’টা দিন। সেই আনন্দ আবার বিজয়া দশমীতে বিষাদের চিহ্ন দিয়ে যায় বাঙালি হৃদয়ে। চন্দ্রনাথ বসুর কথা যেন আমারই কথা—‘আবার ভোরে বাজনা শুনিয়া ঘুম ভাঙিল—অমনি প্রাণ কাঁপিয়া উঠিল, আজ যে বিজয়া দশমী—মা আজ বাড়ি যাচ্ছেন। আনন্দের পরিবর্তে ঘোর নিরানন্দ; কিন্তু বড়ই আনন্দময় এই নিরানন্দ।’
মায়ের আগমনের পূর্বেই পৃথিবীর মানুষ দেখেছে মৃত্যুর হোলিগান মধ্যপ্রাচ্যের গাজা আর ইউক্রেনের শহরে শহরে। চলছে এখনো যুদ্ধ। হানাহানির অভিঘাত ভয়ংকর। গাজায় খাদ্য নেই, আলো নেই, পানীয় জল নেই, মানবাধিকারের বালাই নেই দশকের পর দশক। মুহুর্মুহু শুধু ধেয়ে আসছে রকেট আর বিধ্বংসী বোমা, মরছে মানুষ। অশান্তির চিহ্ন নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক ও ফ্রান্সে। চারদিকে যেন অশান্তি আর অশান্তি! মা দুর্গা, এসো এবার; শেষ করো আমাদের অপেক্ষার পালা। এসো, অসহায় মানুষের ঘরের অতি সাধারণ মেয়েটি হয়ে। দশপ্রহরধারিণী-দশহাতি দুর্গারূপে নয়—এসো দয়াময়ী, মানবতাবাদী হয়ে।
‘পুজো আসছে, পুজো আসছে...’—এই অপেক্ষার গানের সঙ্গে সেই মা যেন আসে আমাদের ঘরে আলোর বাতাস নিয়ে। হোক আজ সে গান সমাজের মূল গান—অপেক্ষার গান। আর একবার স্বামীগৃহে চলে গেলে আবার কবে সে বাড়ি আসবে, তারও নিশ্চয়তা নেই—আবার পুরো একটি বছর হয়তো! তবে অপেক্ষার সান্ত্বনা ওইটুকু অন্তত থাকুক—এই পুরুষতন্ত্র আর তথাকথিত আর্থ-সামাজিক শেকলের বন্ধন থেকে মুক্তি দিতে সে একদিন আসবে। এমন একটি অপেক্ষার গান নিয়েই তো অপেক্ষায় থাকি দুর্গোৎসবের মহামিলনের। দুর্গার শরণাগত ভক্তদের সব দুর্গতি কেটে যাক; সেই মুক্তিসুখে লেপ্টে থাক দুর্গাপূজা থেকে ব্যাপ্তিপ্রাপ্ত দুর্গোৎসব।
দুর্গাপূজা এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মিলনমেলা এবং অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির অনন্য উদাহরণ হিসেবেই স্বীকৃত। দুর্গা যেন এবার সৌহার্দ্যের নতুন রূপে সাজিয়ে দেয় বাংলাদেশকে; উৎসবে ভরিয়ে দেয় মানুষকে, ভুলিয়ে দেয় হিংসা-দ্বেষ-প্রতিহিংসা। শিশিরভেজা ঘাসে ঘাসে অরুণ রাঙা চরণ ফেলে এগিয়ে এসে দশহাত দিয়ে মেঘের আবরণ ছিঁড়ে ছিঁড়ে সে যেন সবকিছুকে সুন্দর করে দেয়; আমাদের হিয়ার মাঝে সোনার নূপুর বাজিয়ে দেয়। কথা দিচ্ছি, বিনিময়ে তোমাকে আত্মার আত্মীয় করে আমাদেরই ঘরে ঠাঁই দেবো, স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে প্রিয় বস্ত্র ও অলংকার পরাবো। সবচেয়ে সুস্বাদু খাবারটি খাওয়াবো। পাখা নেড়ে হাওয়া করবো, ঘুম পাড়াবো, গান শোনাবো। তোমাকে ঘিরে বাদ্যসহকারে নৃত্য করবো—আমাদের ইহজাগতিক সব সুন্দর উজার করে দেবো তোমার কাছে। তুমি শুধু শান্তি নিয়ে এসো, আনন্দ নিয়ে এসো।
লেখক: কলামিস্ট।
আরও পড়ুন