প্রকাশ: ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ইলিয়াস মশহুদ
মানবতার শিক্ষক, দুঃখী ও অসহায় মানুষের আশ্রয়স্থল নবিজি (সা.) শিশুদের ভালোবাসতেন। সব শিশুকেই নিজের সন্তানের মতো আদর করতেন। কোলে নিতেন। শিশুসুলভ গল্প করতেন। চুমু খেতেন। আদর-সোহাগ ও ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের উন্নত নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। বিশেষত অনাথ-এতিম শিশুদের প্রতি তার এই স্নেহ-ভালোবাসা ছিল অন্য মাত্রার। কেননা, নবিজি (সা.) নিজেও একজন এতিম ছিলেন। পৃথিবীতে আসার আগেই তিনি পিতৃহারা হন; জন্মের কয়েক মাস আগে তার পিতা আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। আর মাত্র ছয় বছর বয়সে মা আমেনাও দুনিয়া ত্যাগ করেন।
ফলে অতি অল্প বয়সেই তিনি পিতা-মাতার ছায়া থেকে বঞ্চিত হন। শৈশবকালেই তিনি আশ্রয় নেন দাদা আবদুল মুত্তালিবের কাছে, তবে এই আশ্রয়ও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, দুই বছর যেতে না-যেতেই অর্থাৎ মাত্র আট বছর বয়সেই দাদাকেও হারান। এরপর তিনি চাচা আবু তালিবের স্নেহ-ছায়াল লালিত-পালিত হন।
এজন্য কোরআনে আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবিবকে (সা.) স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, আল্লাহ কি আপনাকে এতিম অবস্থায় পাননি, অতঃপর তিনি আপনাকে আশ্রয় দিয়েছেন? (সুরা দুহা, আয়াত: ৬)
এই আয়াত নবিজির জীবনের শুরুটা স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। এতিমই ছিল তার প্রথম পরিচয়, আর আল্লাহর দয়া ও মানুষের সহানুভূতিই ছিল তার আশ্রয়। যেহেতু তিনি নিজেই এতিম ছিলেন, তাই অন্য এতিমদের প্রতি তার দয়া ও সহানুভূতি ছিল সীমাহীন।
নবিজি (সা.) এভাবে জীবনের প্রতিটি ধাপে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন। এই বাস্তব অভিজ্ঞতাই তাঁকে করে তুলেছিল এতিম ও অসহায় মানুষের প্রতি অতুলনীয় দয়ালু। তিনি সারাটি জীবন সমাজের এতিম-অনাথদের জন্য কাজ করেছেন। কারণ, ইসলাম এতিমদের মর্যাদা ও তাদের অধিকারের প্রতি অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছে। কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, আর লোকেরা আপনাকে এতিমদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে; বলুন, তাদের জন্য সুব্যবস্থা করা উত্তম। তোমরা যদি তাদের সাথে একত্রে থাকো, তবে তারা তো তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ জানেন কে উপকারকারী এবং কে অনিষ্টকারী।’ (সুরা বাকারা: ২২০)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, যে ব্যক্তি এতিমের অর্থ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে, সে তার পেটকে আগুনে পূর্ণ করে, শীঘ্রই সে জাহান্নামে যাবে। (সুরা নিসা: ৬)
এতিমের সঙ্গে কঠোর ও রূঢ় আচরণ ইসলামে নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা বলেন, তুমি এতিমের প্রতি কঠোর হয়ো না, ভিক্ষুককে ধমক দিও না, এবং তোমার রবের নেয়ামতের কথা বর্ণনা করো। (সুরা দুহা: ৯-১১)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, এক ব্যক্তি নবিজির (সা.) কাছে এসে বললো, হে আল্লাহর রাসুল, আমার হৃদয় কঠিন হয়ে গেছে। নবিজি (সা.) বললেন, তুমি যদি চাও তোমার হৃদয় কোমল হোক, তবে এতিমের মাথায় হাত বুলাও এবং মিসকিনকে খাবার দাও। (আল-মু’জামুল কাবির: ২৮৭১)
মহানবি (সা.) এতিম শিশুদের নিজের পরিবারের অংশ মনে করতেন। তিনি তাদের মাথায় হাত বুলাতেন, খাওয়াতেন, শিক্ষা দিতেন। তার শিক্ষা হচ্ছে, এতিম হলো আমাদের সন্তানদের মতো, তাদের ভালোবাসা, সুরক্ষা ও শিক্ষার দায়িত্ব সমাজের প্রতিটি মানুষের।
হজরত সাহল বিন সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, আমি ও এতিম প্রতিপালনকারী জান্নাতে এভাবে থাকব (তিনি তর্জনী ও মধ্যমা আঙুল দিয়ে ইঙ্গিত করেন এবং এ দুটির মধ্যে তিনি সামান্য ফাঁক করেন অর্থাৎ কাছাকাছি থাকব)। (সহিহ বুখারি: ৫৩০৪)
এতিমের সাহায্যকারীর মর্যাদা সম্পর্কে মহানবি (সা.) আরও বলেন, বিধবা, এতিম ও গরিবের সাহায্যকারী ব্যক্তি আল্লাহর পথে মুজাহিদের সমতুল্য। অথবা তার মর্যাদা সেই (নামাজের জন্য) রাত জাগরণকারীর মতো, যে কখনো ক্লান্ত হয় না। অথবা তার মর্যাদা সেই রোজাদারের মতো, যে কখনো ইফতার (রোজা ভঙ্গ) করে না। (সহিহ মুসলিম: ৫২৯৫)
অন্য হাদিসে আছে, যে ব্যক্তি কোনো এতিমকে আপন মাতা-পিতার সঙ্গে নিজেদের (পারিবারিক) খাবারের আয়োজনে বসায় এবং (তাকে এই পরিমাণ আহার্য দান করে যে) সে পরিতৃপ্ত হয়ে আহার করে, তাহলে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। (মুসনাদে আহমদ: ১৮২৫২)
বস্তুত এতিম হওয়া আল্লাহর বিশেষ পরীক্ষার একটি অংশ। আর এতিমদের প্রতি দয়া করা হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম পথ। তা ছাড়া এতিমরা হলো সমাজের সবচেয়ে অসহায় শ্রেণি। তাদের প্রতি ভালোবাসা ও যত্ন নেওয়া মানবিক কর্তব্য ও ইমানের দাবি।
লেখক: সম্পাদক, কালান্তর প্রকাশনী