Advertisement

প্রেম, পুরান ঢাকা আর হারানো দিনের টান ‘গুলবাহার’

প্রথম আলো

প্রকাশ: ৭ আগস্ট, ২০২৫

১৭ মে ২০২৫ তারিখে ‘ঈশান এর গান’ ইউটিউব চ্যানেলে মুক্তি পায় ‘গুলবাহার’কোলাজ
১৭ মে ২০২৫ তারিখে ‘ঈশান এর গান’ ইউটিউব চ্যানেলে মুক্তি পায় ‘গুলবাহার’কোলাজ

‘গান গাই আমার মনরে বুঝাই / মন থাকে পাগলপারা / আর কিছু চাই না মনে গান ছাড়া’—ভালোবেসে গানেই ভালোবাসার এ মর্মবাণী লিখে গেছেন শাহ আবদুল করিম। কেবল শিল্পী বা সংগীতসংশ্লিষ্ট মানুষই নন, গানপ্রেমী মানুষ মাত্রই গানে শান্তি খুঁজে পান। সুখে–দুঃখে, প্রেমে–বিরহে গান হৃদয়কে আলোড়িত করে, প্রশান্তি দেয়। তাই তো মন খারাপে কেউ যেমন কানে হেডফোন লাগিয়ে গানে ডুব দেন, আবার আনন্দে গান বাজিয়ে আনন্দকে বাড়িয়েও নেন অনেকে। কিছু গান হৃদয় জুড়ে থাকে। খুব অল্প সময়ে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মুখে মুখে। বর্তমান সময়ে যদিও সিনেমাসংশ্লিষ্ট গানের বাইরে দ্রুত মানুষ গ্রহণ করেছে এমন গানের খবর খুব একটা পাওয়া যায় না। এই আক্ষেপ, হতাশা কিছুটা হলেও মিটিয়েছে, ‘গুলবাহার’। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে ইউটিউবে প্রকাশের প্রায় দেড় মাস পরে গানটি পৌঁছেছে মানুষের কাছে। নতুন করে আশার আলো দেখেছে। সেই আশার জোয়ার এখনো চলছে। সব বয়সী শ্রোতা মুগ্ধতা নিয়ে যেমন শুনছেন, তেমনি গুনগুন করে কেউ কেউ গেয়েও উঠছেন, ‘লাল বাজারে গলির মোড়ে / পান দোকানের খরিদ্দার / বাকের আলীর আদুরে মেয়ে / নাম ছিল তার গুলবাহার’। কিন্তু এমন কী ঘটল যে প্রকাশের দেড় মাস পরে ‘গুলবাহার’ ছড়িয়ে পড়ল? তা ছাড়া শ্রোতারাই বা গানটিকে কেন এভাবে গ্রহণ করলেন?

১৭ মে ২০২৫ তারিখে ‘ঈশান এর গান’ ইউটিউব চ্যানেলে মুক্তি পায় ‘গুলবাহার’। প্রথম আলোকে দেওয়া গানটির শিল্পী ঈশান মজুমদার বলেন, ‘“গুলবাহার” শুরুতে না ছড়ালেও রেসপন্স ভালো ছিল। কাছের মানুষজন ও নিয়মিত শ্রোতারা আমাদের সাধুবাদ জানিয়েছেন ও অনুপ্রাণিত করেছেন। গানে কিংবা ভিডিওতে যেসব বিষয় ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলাম, দর্শকেরাও সেটা লক্ষ করেছেন। আমাদের কাজের প্রশংসা করেছেন।’

শুরুর দিকে কী বলেছিলেন দর্শক
দুই মাস আগে ইউটিউবের মন্তব্যের ঘরে নিশীতা মিতু লিখেছিলেন, ‘১৭ মে আমার বিবাহবার্ষিকী ছিল। গানটা যেন বিশেষ দিনের উপহার। আমি আর আমার হাজব্যান্ড প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ বার গানটা শুনি।’ জয়া মল্লিকের মন্তব্য, ‘আমি ঠিক কি না জানি না। কিন্তু আমার মনে হলো গানটার স্থায়ীতে দুটো গানের টিউন আছে। একটা হলো বাচ্চাদের গান “একদিন ছুটি হবে”, আরেকটা আমার খুব প্রিয় গান “কফি হাউসের সেই আড্ডাটা” গানের এক অংশ “কাকে যেন ভালোবেসে আঘাত পেয়ে যে শেষে পাগলাগারদে আছে রমা রায়”। কিন্তু আমি কখনো ভাবিনি যে এটা এত সুন্দর শোনাবে। প্রতি কলিতে আলাদা আলাদা সুর। আর লাস্টের ওই হারমোনিয়াম অংশটা। এত সুন্দর! সব মিলিয়ে আ কমপ্লিট মাস্টারপিস।’

আবির চৌধুরী প্রত্যাশা ব্যক্ত করে লিখেছিলেন, ‘আহা, কী মিষ্টি কণ্ঠ আর সাথে ভিডিওগ্রাফি। গানটা যেদিন মিলিয়ন ভিউ হবে সেদিন আবার এসে শুনব।’ না, আবির চৌধুরীর প্রত্যাশা ভেঙে যায়নি। এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত ইউটিউবে ‘গুলবাহার’–এর ভিউ হয়েছে ১১ মিলিয়নের বেশি। তাই আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে শ্রোতারা খুব আগ্রহ নিয়েই শুনছেন গানটি।

শিল্পের সার্থকতা প্রকাশে। আর আনন্দ আলোড়নে। আলোড়িত হলে শিল্পের সৌন্দর্য বাড়ে। বর্তমান সময়ে ভালো-মন্দ যে কোনো কিছু মানুষের কাছে পৌঁছানোর সহজ উপায় হচ্ছে সামাজিক মাধ্যম।

দেড় মাস পর ‘গুলবাহার’ যেভাবে পৌঁছাল আরও শ্রোতার কাছে
শিল্পের সার্থকতা প্রকাশে। আর আনন্দ আলোড়নে। আলোড়িত হলে শিল্পের সৌন্দর্য বাড়ে। বর্তমান সময়ে ভালো-মন্দ যে কোনো কিছু মানুষের কাছে পৌঁছানোর সহজ উপায় হচ্ছে সামাজিক মাধ্যম। যেন একপ্রকার স্বীকৃতই হয়ে উঠেছে যে সামাজিক মাধ্যমে আলোচিত হলেই তার ভালো ফলাফল মিলবে। তা ভালো কিংবা মন্দ যে বিষয়ই হোক না কেন। সাম্প্রতিক কিংবা তদানীন্তন নানা ঘটনা বিশ্লেষণ করলে উদাহরণ বা বাস্তবতা অনুমান করতে কষ্ট হবে না। যদিও দুঃখজনক, তারপরও সত্য যে সামাজিক মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক শিল্প–সাহিত্যেরও প্রচার তথা বিজ্ঞাপনের বড় মাধ্যম। নাটক–সিনেমা–গানের প্রমোশন অনেকাংশে সামাজিক মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ‘গুলবাহার’–এর ক্ষেত্রেও তাই ব্যতিক্রম ঘটেনি। ইউটিউবে প্রচারের দেড় মাস পর্যন্ত গানটি সেই অর্থে ভাষা না পেলেও দেড় মাস পর হঠাৎ গানটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে শ্রোতারা গানটি নিয়ে মেতে ওঠেন। গানের নানা দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এখনো স্টোরি, রিলস ও নিউজফিডে গানটির নানা দৃশ্য ভেসে বেড়াচ্ছে। তাই এ কথা বলা মোটেও অনুচিত হবে না যে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরই ‘গুলবাহার’–এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে শিল্পী ঈশান মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গানটা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যাওয়ায় আরও ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করেছে। এ কারণে আমরা সব বয়সী মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি। আমাদের প্রাপ্তি, আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পেরেছি।’

এখনো স্টোরি, রিলস ও নিউজফিডে গানটির নানা দৃশ্য ভেসে বেড়াচ্ছে। তাই এ কথা বলা মোটেও অনুচিত হবে না যে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরই ‘গুলবাহার’–এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে।

শ্রোতারা গানটিকে কেন গ্রহণ করলেন

বাংলা গানের ইতিহাসে চরিত্রনির্ভর গানের সংখ্যা নেহাতই কম নয়। ‘বেলা বোস’, ‘মালা’, ‘অঞ্জনা’, ‘রুবি রায়’ ইত্যাদি গানের জনপ্রিয়তাও ঈর্ষণীয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে নতুন কোনো চরিত্রকে গানে জনপ্রিয় করে তোলার কাজটা শুধু কঠিনই নয়, বেশ দুরূহও। তারপরও শিল্পী ঈশান মজুমদারের প্রচেষ্টা আশার আলো দেখেছে। ‘গুলবাহা’র ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের মুখে মুখে। সামাজিক মাধ্যমে রিলস ও স্টোরিতে ভেসে বেড়াচ্ছে গানটি। ফেসবুকে বন্ধুদের মধ্যেও গানটি নিয়ে চলছে খুনসুটি। গানটি নিয়ে এত আহ্লাদ কেন, ‘গুলবাহার’ শ্রোতাদের ভালো লাগার নেপথ্যে কারণ কী?ইউটিউবে মন্তব্যের ঘরে সাজিয়া পায়েল লিখেছেন, ‘স্বামী আমাকে প্রেম করার সময় নাম দিয়েছিল গুলবাহার। হঠাৎ এই গানটা রিলে শোনার পর এখানে এসে পুরো গানটা শুনেছি আমার স্বামী আর আমি, দুজনেরই বেশ পছন্দ হয়েছে। শুধু পছন্দ বললে ভুল হবে, হৃদয় ছুঁয়ে গেছে, চমৎকার। গানটির শেষে আমার উনি কানে কানে বললেন, “আমার গুলবাহার” আর কি চাই জীবনে...’।

সাজিয়ার কথার সূত্র ধরে বলা যায়, ‘গুলবাহা’র ভালো লাগার নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ গানের গল্প। গল্পই গানটিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। আর অস্বীকার করার উপায় নেই যে কম–বেশি সবার জীবনে প্রেম–ভালোবাসা, বিরহ কখনো না কখনো পরশ দিয়ে যায়। গানটির গল্প জীবনের সেই অতীত বা বর্তমান স্মৃতিকে খুব সহজেই স্পর্শ করেছে।‘গুলবাহা’র জনপ্রিয় হওয়ার আর একটি কারণ সম্ভবত মেলোডির ব্যবহার। ঈশান খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গেই তাঁর গল্পনির্ভর গানে মেলোডির সংযোগ ঘটিয়েছেন। কারণ, মানুষের স্মৃতিকে নাড়িয়ে দিতে মেলোডি খুব ভালো ভূমিকা রাখে। মেলোডির ক্ষেত্রে এমনও বলা হয়, সব বয়সের, সব শ্রেণির শ্রোতাকে মেলোডি দিয়ে স্পর্শ করা যায়। তা ছাড়া গানটির গল্পে যে নাটকীয়তা, মেলোডি ব্যবহার না করলে তা পরিপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়তো কঠিন হতো।‘গুলবাহা’র প্রসঙ্গে মেহেদী হাসান লিখেছেন, ‘এই গুলবাহার অনেকটা জীবনানন্দের বনলতা সেনের মতো, যার সরাসরি পরিচয় দেওয়া হয়নি। যার যাকে ইচ্ছা, কল্পনা করতে পারবে।’ সবুজ দাশের মন্তব্যও মেহেদী হাসানের কাছাকাছি। তাঁর বক্তব্য, ‘গুলবাহারের চেহারা নেই, আছে অনুভব। সুরের প্রতিটি ছায়ায় তিনি আড়ালেই থেকেও থেকেছেন সর্বত্র। যেন শ্রোতার কল্পনায় জন্ম নেওয়া এক স্বপ্ন-নারী।’গানটির মূল আকর্ষণ গুলবাহার। গুলবাহারকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে সম্পূর্ণ গান। গানটির ভিডিও চিত্রে গুলবাহারকে দেখতে পাননি দর্শক। যা দর্শকের আকর্ষণ বাড়িয়েছে। শ্রোতা নিজের মতো

গানটির ভিডিও দৃশ্যে পুরান ঢাকার নানা স্থান, পথ, অলিগলি, পুরোনো বাস, চায়ের দোকান, সেলুন গানটিতে ভিডিও চিত্রকে গতানুগতিক ধারা থেকে পৃথক করেছে। গল্প, সুর, ভিডিও চিত্রের দৃশ্যায়ন—সব মিলিয়ে দর্শক গানটিতে আকর্ষণ বোধ করেছেন।‘

গুলবাহারের ছবি এঁকে নিতে পেরেছেন মনে। পাশাপাশি গানটির ভিডিও দৃশ্যে পুরান ঢাকার নানা স্থান, পথ, অলিগলি, পুরোনো বাস, চায়ের দোকান, সেলুন গানটিতে ভিডিও চিত্রকে গতানুগতিক ধারা থেকে পৃথক করেছে। গল্প, সুর, ভিডিও চিত্রের দৃশ্যায়ন—সব মিলিয়ে দর্শক গানটিতে আকর্ষণ বোধ করেছেন। ‘গুলবাহা’র প্রসঙ্গে মোহাইমেনউর রহমানের মন্তব্য, ‘একটা গানে এত ধরনের ট্রানজেশন, এত ইনস্ট্রুমেন্টের ব্যবহার, গানটাকে এক অনন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। জেনারেশন গ্যাপ যে কোনো বিষয় নয়, একই সাথে এক টেবিলে বসে তিন জেনারেশনের মানুষ এই গানকে নিঃসন্দেহে পছন্দ করবে। এই যুগে এসে একটা গান কোনো রকম অশ্লীলতা ছাড়া গানের কথা ও ভিডিওগ্রাফির মাধ্যমে এত সুন্দর করে উপস্থাপন করে যে সবার ভালোবাসা পাওয়া যায়, তা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ হ্যাঁ, গানে ইনস্ট্রুমেন্টের ব্যবহার গানটিকে শ্রুতিমধুর করেছে তো বটেই। পাশাপাশি গানের কথায় অপেক্ষাকৃত কম প্রচলিত শব্দের ব্যবহারও গানটিতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। শব্দগুলো গানে এত চমৎকারভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে যে এক অকৃত্রিম যোজনা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে খরিদ্দার, আদুরে¬মেয়ে, নাস্তানাবুদ, দরখাস্ত, ইনতেজার, কাফেলায়, মেহফিল, ইশতাহার, খোশমেজাজি, হাঙ্গামা প্রভৃতি শব্দ গানটিকে প্রাণ দিয়েছে। তাই তো খুব সহজে পুরোনো দিনের স্মৃতি হাতড়ে কেউ যেমন গেয়ে উঠছেন, আবার কেউ প্রিয় মানুষকে ফোনের অপর প্রান্তে রেখে গুনগুন করে কিংবা খানিকটা চিৎকার করেই গাইছেন, ‘নাম ছিল তার… (গুলবাহার) / দেখতে ভারী চমৎকার / তুলনা যে হয় না তার /… (হোসনে আরা গুলবাহার)’। তাই অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘গুলবাহার’–এর জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে।

Lading . . .