পাপ আরও অনেক জায়গাতেই আছে, শিল্পীদের এত পাপী ভাববেন না: কনকচাঁপা
প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

টানা ১৪ দিন হাসপাতালের বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলেন লালনসংগীতের বরেণ্য শিল্পী ফরিদা পারভীন। গতকার শনিবার রাত ১০টা ১৫ মিনিটে তিনি মারা যান। দীর্ঘদিন ধরে তিনি কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। ফরিদা পারভীনের মৃত্যুর খবর শুনে তাঁকে শেষবারের মতো দেখতে শনিবার রাতেই হাসপাতালে ছুটে যান দেশের আরেক জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী কনকচাঁপা। মুখোমুখি হন সংবাদকর্মীদের। এ সময় ফরিদা পারভীনকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন কনকচাঁপা। একই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমে কথা বলতে গিয়ে নিজের ভেতরে জমে থাকা আক্ষেপের কথাও শোনান।
গণমাধ্যমকে শুধু কথাগুলো শোনাননি, অনুরোধ করেছেন কথাগুলো যেন ঠিকঠাকভাবে প্রচার করা হয়। শিল্পীদের নিয়ে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কিছু অংশের বিরূপ মন্তব্য তাঁকে আহত করে বলেও জানান তিনি।
মানুষ শিল্পীদের গান শোনেন, অভিনয় উপভোগ করেন, আবার অকারণ সমালোচনায়ও মেতে ওঠেন, যা মোটেও ঠিক নয়। উল্টাপাল্টা মন্তব্য করেন, যা রীতিমতো ভয়ের।
কনকচাঁপা জানান, মানুষ শিল্পীদের গান শোনেন, অভিনয় উপভোগ করেন, আবার অকারণ সমালোচনায়ও মেতে ওঠেন, যা মোটেও ঠিক নয়। উল্টাপাল্টা মন্তব্য করেন, যা রীতিমতো ভয়ের।
কনকচাঁপা বলেন, ‘মিডিয়ার ভাইয়েরা, দয়া করে আমার কথাগুলো কাটবেন না। কথাগুলো সবাইকে প্রচার করার জন্য অনুরোধ করছি। সাধারণ জনগণ নিজেদের সময় আনন্দময় করতে, সুললিত করতে সারাক্ষণ গান শোনেন, সিনেমা-নাটকে শিল্পীদের অভিনয় দেখেন। কিন্তু একজন শিল্পী যখন মারা যায়, তখন তারা পাপ-পুণ্য, বেহেশত-দোজখ—এগুলো নিয়ে এত কথা বলেন, সেই মন্তব্যগুলো দেখলে আসলে আমরা খুব ভীত হয়ে যাই। আমরা খুব ভেঙে পড়ি, আমাদের খুব খারাপ লাগে।’
সাধারণ মানুষ যাঁরা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেন, তাঁদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, আমাদের শিল্পীদের এত পাপী ভাববেন না। পাপ আমাদের দেশে আরও অনেক জায়গাতেই আছে, অনেক ক্ষেত্রেই আছে। শিল্পীরা আমরা শুধু গানই করে যাই, শিল্পীরাই একমাত্র জাতি, যাঁদের কোনো ঘুষ খাওয়ার জায়গা নাই, দুর্নীতি করার জায়গা নাই, মিথ্যাচার করার জায়গা নাই, অন্যায় করার জায়গা নাই।
শিল্পীদের মৃত্যুর পর মানুষের ভাবনাচিন্তার বিষয়টিও তুলে ধরেন কনকচাঁপা। কথা বলার এক পর্যায়ে কনকচাঁপা বলেন, ‘একজন শিল্পী মারা যাওয়ার পর তাঁর মরদেহ দাফন করার আগেই তিনি দোজখের কয় নাম্বারে যাবেন, সেগুলো নিয়ে কথা বলা শুরু করেন মানুষেরা। সারা জীবন কিন্তু তাঁরাই আমাদের গান শোনেন, লালনের গান শুনতে হলে ফরিদা পারভীনকেই শুনতে হতো। সাধারণ মানুষ যাঁরা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেন, তাঁদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, আমাদের শিল্পীদের এত পাপী ভাববেন না। পাপ আমাদের দেশে আরও অনেক জায়গাতেই আছে, অনেক ক্ষেত্রেই আছে। শিল্পীরা আমরা শুধু গানই করে যাই, শিল্পীরাই একমাত্র জাতি, যাঁদের কোনো ঘুষ খাওয়ার জায়গা নাই, দুর্নীতি করার জায়গা নাই, মিথ্যাচার করার জায়গা নাই, অন্যায় করার জায়গা নাই। অথচ আমরা মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কয় নম্বর দোজখে যাব, মানুষ তা নির্ধারণ করে ফেলে! সত্যি সত্যি আমি আবেগপ্রবণ হয়ে অনেক অপ্রিয় সত্যি কথা বলে ফেললাম। আপনারা সবাই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। শিল্পীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন।’
ফরিদা পারভীন প্রসঙ্গে কনকচাঁপা বলেন, ‘আমাদের ফরিদা পারভীন আপা লালনগীতির যে জনপ্রিয়তা তৈরি করেছিলেন, সেই জায়গাটা আসলে তিনি পুরোটাই শূন্য করে নিজের সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন। কারণ, আধুনিক সমাজে আমরা যারা লালনের গান শুনতাম, একমাত্র ফরিদা আপাকেই শুনতাম। যাঁরা লালন সাঁইজির আখড়ায় গান করেন, তাঁদের গান এক রকম, কিন্তু ফরিদা আপা ওখান থেকে লালনের গানটা তুলে এনে আধুনিকায়ন করে আমাদের কাছে উপস্থাপন করেছেন।’
আমাদের ফরিদা পারভীন আপা লালনগীতির যে জনপ্রিয়তা তৈরি করেছিলেন, সেই জায়গাটা আসলে তিনি পুরোটাই শূন্য করে নিজের সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন। কারণ, আধুনিক সমাজে আমরা যারা লালনের গান শুনতাম, একমাত্র ফরিদা আপাকেই শুনতাম। যাঁরা লালন সাঁইজির আখড়ায় গান করেন, তাঁদের গান এক রকম, কিন্তু ফরিদা আপা ওখান থেকে লালনের গানটা তুলে এনে আধুনিকায়ন করে আমাদের কাছে উপস্থাপন করেছেন।কনকচাঁপা
ফরিদা পারভীনের গায়কির প্রশংসা করে কনকচাঁপা বলেন, ‘ওনার কণ্ঠে যে মায়া, শুধু লালনসংগীত কেন বলব? তিনি দেশের গান কিছু গেয়েছেন—“এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদী তটে”সহ আরও কিছু আধুনিক গান গেয়েছেন—তা অতুলনীয়। আমি যদি উদাহরণস্বরূপ “তোমরা ভুলেই গেছ মল্লিকাদির নাম” গানটির কথা বলি, ওই গান অনবদ্য। ওনার কণ্ঠ অনবদ্য, ওনার সুর একদম তিরের মতো সোজা অন্তরে এসে লাগে। এই সব স্মৃতিচারণা করতে গেলে আমি আসলে এখন আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছি।’
একদম শেষে এসে কনকচাঁপা বলেন, ‘সত্যি সত্যি আমরা অনেককেই হারিয়ে ফেলছি। সংগীতাঙ্গনে আমাদের মাথার ওপর যাঁরা বটবৃক্ষের মতো ছিলেন, তাঁদের প্রায় সবাইকে আমরা হারিয়ে ফেলছি। আমরা খুব অসহায় হয়ে যাচ্ছি। আমি যে ভরাট একটি সংগীতাঙ্গন দেখে বড় হয়েছি, ঋদ্ধ হয়েছি, তার মধ্যে অনেকগুলো মানুষকে হারিয়ে ফেলেছি। ফরিদা আপাও চলে গেলেন। আমি তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমার সমাবেদনা রইল।’
সত্যি সত্যি আমরা অনেককেই হারিয়ে ফেলছি। সংগীতাঙ্গনে আমাদের মাথার ওপর যাঁরা বটবৃক্ষের মতো ছিলেন, তাঁদের প্রায় সবাইকে আমরা হারিয়ে ফেলছি। আমরা খুব অসহায় হয়ে যাচ্ছি। আমি যে ভরাট একটি সংগীতাঙ্গন দেখে বড় হয়েছি, ঋদ্ধ হয়েছি, তার মধ্যে অনেকগুলো মানুষকে হারিয়ে ফেলেছি।কনকচাঁপা
দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন ফরিদা পারভীন। নিয়মিত ডায়ালাইসিসের অংশ হিসেবে ২ সেপ্টেম্বর মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় তাঁকে। কিন্তু ডায়ালাইসিসের পর তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তখন চিকিৎসক তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরামর্শ দেন। অবশেষে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে গতকাল শনিবার রাতে তিনি চলে যান না-ফেরার দেশে।
দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন ফরিদা পারভীন। কিছুদিন ধরে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছিল, সপ্তাহে দুই দিন তাঁকে ডায়ালাইসিস করাতে হয়। নিয়মিত ডায়ালাইসিসের অংশ হিসেবে ২ সেপ্টেম্বর মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় তাঁকে। কিন্তু ডায়ালাইসিসের পর তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তখন চিকিৎসক তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরামর্শ দেন। এর পর থেকে তিনি হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত বুধবার অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ভেন্টিলেশনে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অবশেষে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে গতকাল শনিবার রাতে তিনি চলে যান না-ফেরার দেশে।
ফরিদা পারভীনের মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে সংগীতাঙ্গনে। গতকাল শনিবার রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভরে উঠেছে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও স্মৃতিচারণায়।
১৯৫৪ সালে ৩১ ডিসেম্বর নাটোরের সিংড়া থানায় জন্ম নেওয়া ফরিদা পারভীন গানে গানে কাটিয়েছেন ৫৫ বছর। ১৪ বছর বয়সে ১৯৬৮ সালে ফরিদা পারভীনের পেশাদার সংগীতজীবন শুরু হয়। এরপর পার হতে হয় অনেক চড়াই-উতরাই। পারিবারিক সূত্রেই গানের ভুবনে আসা। গানের প্রতি বাবার টান ছিল বেশি। দাদিও গান করতেন। বাবার চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলায় যেতে হয়েছে তাঁকে। শৈশবে যখন মাগুরায় ছিলেন, তখন ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে সংগীতের হাতেখড়ি হয়। এরপর নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তালিম থেকে দূরে থাকেননি। নানা ধরনের গান করলেও শিল্পীজীবনে পরিচিতি, জনপ্রিয়তা, অগণিত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন মূলত লালন সাঁইয়ের গান গেয়ে। যখন থেকে লালনের গান গাওয়া শুরু হয়েছিল, তারপর আর থেমে থাকেননি। শুরুতে নজরুলসংগীত, পরে আধুনিক গান দিয়ে ফরিদা পারভীনের যাত্রা শুরু হলেও জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে লালন সাঁইয়ের গান গেয়ে।
রোববার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফরিদা পারভীনকে শেষ শ্রদ্ধা জানালেন শিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা হয়েছে। ফরিদা পারভীনের মরদেহ নিয়ে পরিবারের সদস্যরা রওনা হয়েছেন কুষ্টিয়ায়। বাদ মাগরিব তাঁকে সেখানে সমাহিত করা হবে।