বজ্রপাত আটকাতে বাঁশের খুঁটি, তামার তার দিয়ে স্কুল ছাত্ররা যে যন্ত্র বানিয়েছে
প্রকাশ: ৬ আগস্ট, ২০২৫

ছবির উৎস, Ambarsih Nag Biswas
পশ্চিমবঙ্গের কৃষক পঞ্চানন মণ্ডল সোমবার দুপুরে যখন কথা বলছিলেন, তখন তিনি কর্ণাটকের একটা জমিতে ধান রুইছিলেন।
কর্ণাটকের জমিতে কাজ করতে করতেই মি. মণ্ডল বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, "এখানেও মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে, বাজ পড়ছে। যদি দেশে আমার জমিতে যে যন্ত্র আছে, সেটা যদি এই জমিতেও থাকত, নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারতাম।"
তার নিজের প্রায় আড়াই বিঘা জমি আছে সুন্দরবন ঘেঁষা গোসাবার বিপ্রদাসপুর গ্রামে। কয়েক বছর আগে তার জমিতে একটা বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র বসিয়েছেন।
বাংলাটা যদি একটু অপরিচিত লাগে, তার জন্য বুঝিয়ে দিই, এটার ইংরেজি হল 'লাইটনিং অ্যারেস্টার', বজ্রপাত হলে যে দণ্ডটির মাধ্যমে অতি উচ্চমাত্রায় ধেয়ে আসা বিদ্যুৎ ভূমিগত করে দেওয়া হয়।
তবে বাজারচলতি যেসব লাইটনিং অ্যারেস্টার পাওয়া যায়, সেগুলির থেকে মি. মণ্ডলের চাষের ক্ষেতে বসানো যন্ত্রটি অনেকটাই ভিন্ন – একেবারে দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি, এবং সস্তা।
উত্তর ২৪ পরগণা জেলার এক স্কুল শিক্ষক ও তার ছাত্ররা কয়েক বছর আগে এই যন্ত্র বানিয়েছেন অ্যালুমিনিয়াম পাত, তামার তার আর একটি বাঁশের খুঁটি দিয়ে।
পরপর কয়েকবার স্কুল পর্যায়ের স্থানীয় ও জাতীয় বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে ওই যন্ত্র দেখানোর পরে ওই শিক্ষক ব্যাঙ্গালোরের কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ গবেষণা কেন্দ্র থেকে পরীক্ষাও করিয়ে এনেছেন।
ওই শিক্ষক, মি. পশুপতি মণ্ডল বিবিসিকে বলছিলেন, "আমিও ছিলাম সেদিন পরীক্ষাগারে। কয়েক মিলি-সেকেন্ডের মধ্যে দেখলাম প্রায় এক লক্ষের বেশি ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে গেল আমাদের তৈরি যন্ত্রটার মধ্যে দিয়ে।"
ওই বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্রই কৃষক পঞ্চানন মণ্ডল তার চাষের জমিতে লাগিয়েছেন। তার দেখাদেখি গ্রামে মোট ১৬-১৭টি তড়িৎ-সঞ্চালক বসিয়েছেন অন্য কৃষকরা।
যে প্রতিষ্ঠান ভারতে সমস্ত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করে সনদ দিয়ে থাকে, সেই সেন্ট্রাল পাওয়ার রিসার্চ ইন্সটিটিউট এই যন্ত্রটি পরীক্ষা করে কার্যকারিতার বিষয়ে সনদ দিয়েছে।

বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়ছে ভারতে
বিবিসি বাংলার সর্বশেষ খবর ও বিশ্লেষণ এখন সরাসরি আপনার ফোনে।
ফলো করুন, নোটিফিকেশন অন রাখুন
বিবিসি বাংলার সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ বিবিসি বাংলার হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল
পঞ্চানন মণ্ডল বলছিলেন, "এই তো কদিন আগে খবর পেলাম আমাদের কাছের এক গ্রামে একজন মানুষ বাজ পড়ে মারা গেছেন, দুটো গরুও মরেছে। তবে কর্ণাটক থেকে ফিরে গিয়ে নিজের জমিতে যখন ধান রুইব, তখন আমি নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারব।"
শুধু তার পাশের গ্রামের একজন মানুষ নয়, গত বৃহস্পতিবার একদিনের বজ্রপাতে গোটা পশ্চিমবঙ্গে অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছেন বলে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলি হিসাব দিয়েছে।
পরিবেশ সংক্রান্ত পত্রিকা 'ডাউন টু আর্থ' এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, "ভারতের ১২টি রাজ্যে ২০২৫ সালের মার্চ থেকে ১৭ই এপ্রিল পর্যন্ত ১৬২ জন বজ্রপাতের আঘাতে মারা গেছেন।"
গত বছর ওই একই সময়কালে সংখ্যাটা ছিল ৫৭। 'ডাউন টু আর্থ' লিখেছে একবছরে ১৮৪ শতাংশ মৃত্যু বেড়েছে। এর মধ্যে ১৪২ জন মারা গেছেন এবছরের এপ্রিলের প্রথম ১৭ দিনেই।
উত্তর ২৪ পরগণা জেলার 'সোদপুর দেশবন্ধু বিদ্যাপীঠ (বালক)' -এর পদার্থবিদ্যার শিক্ষক ড. পশুপতি মণ্ডল বলছিলেন, "যারা বজ্রপাতে নিহত হন, তাদের বেশীরভাগই প্রান্তিক মানুষ – কৃষক আর মৎস্যজীবী। বর্ষাকালেও যাদের মাঠে ঘাটে কাজ করতে হয় বা মাছ ধরতে হয়। অথচ বজ্রপাত থেকে এদের কোনও নিরাপত্তা নেই। বাজ কিন্তু শহরাঞ্চলের থেকেও বেশি গ্রামের দিকেই পড়ে – যেখানে এইসব প্রান্তিক মানুষ থাকেন। গত সপ্তাহে যারা মারা গেছেন পশ্চিমবঙ্গে, তারা কিন্তু সবাই কৃষক।''
"সেই থেকেই আমার মাথায় চিন্তা ঢোকে যে এদের জন্য কম খরচে কীভাবে লাইটনিং অ্যারেস্টার বানানো যায়," বলছিলেন মি. মণ্ডল।
অনেক গবেষণা পত্র পড়ে তার মনে হয়েছিল যে সাইকেলের রিম দিয়ে এরকম বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র বানানো যায় কী না।
তবে প্রথমে যে যন্ত্রটি বানিয়েছিলেন, পরে তা অনেকবার পরিমার্জিত হয়েছে।

ছবির উৎস, Ambarish Nag Biswas
ছবির উৎস, Ambarish Nag Biswas
কী আছে যন্ত্রটিতে?
পশুপতি মণ্ডল এই বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র বানানোর জন্য সাইকেলের রিম নিয়ে হাতেকলমে কাজ শুরুর আগে প্রায় শ দেড়েক গবেষণা পত্র পড়েছিলেন।
"সাইকেলের রিমের কিনারাগুলো মুড়ে দেওয়া থাকে। আমরা সেটাকে খুলে দিয়ে পিটিয়ে ধারালো করে দিয়েছিলাম। আর সাইকেলের রিম থেকে স্পোকগুলো কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। সেটাতে বেশ ভালই এরিয়া কভার করছে দেখলাম। হাতে কলমে পরীক্ষার জন্য দক্ষিণ ২৪ পরগণার গোসাবা এলাকাটিকে বেছে নিয়েছিলাম।
"এরপরের পরিমার্জনের সময়ে আমরা স্পোকগুলো তামার তার দিয়ে বানালাম আর রিমের বাইরে যে অংশটা বেরিয়ে থাকল, তার মাথাগুলো সূচালো করে দিয়েছিলাম। রিমের মাঝখানে যে হাব থাকে, সেটাকেও ধাতুর করে দিয়েছিলাম। ওই পর্যায়ে ভালই এরিয়া কভার করছিল। আর এখন তো আরও উন্নততর হয়েছে আমাদের এই যন্ত্র," বলছিলেন পদার্থবিদ্যার শিক্ষক।
গোটা যন্ত্রটি একটি বাঁশের খুঁটির ওপরে বসানো থাকে। এবং ওই যন্ত্র থেকে 'আর্থিং'-এর জন্য তামার তার বাঁশের খুঁটি বেয়ে কিছুটা দূরে শুকনো মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়।
"সাইকেলের রিমের বদলে আমরা এখন পাতলা অ্যালুমিনিয়াম পাত ব্যবহার করি আর আর্থিং-এর তামার তারটি সর্বোচ্চ ৩৫ ফুট পর্যন্ত রাখা হয় সবথেকে ভাল ফলাফলের জন্য। বাজার চলতি যে লাইটনিং অ্যারেস্টার পাওয়া যায়, তাতে তিন থেকে পাঁচটি সূচাগ্র প্রান্ত থাকে। কিন্তু আমাদের যন্ত্রে প্রায় তিন হাজার এরকম সূচাগ্র প্রান্ত আছে," বলছিলেন মি. মণ্ডল।
এখন ১৯০ থেকে ২১০ মিটার পর্যন্ত এলাকায় বজ্রপাত আটকাতে পারে তাদের তৈরি এই যন্ত্র।

'হ্যাম রেডিও' অপারেটররা যেভাবে যুক্ত এই প্রকল্পে
শিক্ষক পশুপতি মণ্ডল স্কুলে ছাত্র পড়ানোর বাইরে ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ কমিউনিকেশন অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের অধ্যক্ষ।
ওই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেই হ্যাম রেডিও অপারেটররা লাইসেন্স নেওয়ার জন্য পরীক্ষায় বসেন।
হ্যাম রেডিও অপারেটরদের সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল রেডিও ক্লাবের সম্পাদক অম্বরীশ নাগ বিশ্বাস বলছিলেন, "আমরা যারা হ্যাম রেডিও অপারেট করি, তাদের দামী যন্ত্রপাতি খোলা জায়গায় রাখতে হয়। এছাড়া আমাদের একটা ট্র্যান্সপন্ডার আছে। তাই আমাদের ভাবনাতেও ছিল যে কী করে বজ্রপাতের হাত থেকে আমাদের যন্ত্রপাতি সুরক্ষিত রাখা যায়। অন্যদিকে আমাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ওই অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষ শিক্ষক পশুপতি মণ্ডলও ভাবনা চিন্তা করছিলেন এরকম একটা বজ্রনিরোধক বানানোর জন্য।"
সেই থেকেই বজ্রনিরোধক যন্ত্র বানানোর উদ্যোগ এবং স্কুলের ছাত্রদের দিয়ে বানানো হয় এই যন্ত্র। একেকটি যন্ত্র বানাতে হাজার দুয়েক ভারতীয় টাকা খরচ পড়ছে বলে জানিয়েছেন মি. নাগ বিশ্বাস।
গোড়ার দিকে তারা বিনা খরচেই গ্রামের দিকে চাষের ক্ষেতে বসিয়ে দিতেন বজ্রনিরোধক যন্ত্র।
"যেখানে আমরা যন্ত্রগুলো বসাই, সেখানে কয়েকটি জিনিষ খেয়াল রাখতে হয়। আশেপাশে যেন বড় গাছ না থাকে, যেখানে বাঁশের খুঁটিটি পোঁতা হচ্ছে, সেখানে যেন জল না থাকে। যদি জলের মধ্যে বাঁশের খুঁটি পোঁতাও হয়, তা থেকে আর্থিং-এর যে তারটি আসবে, সেটা যেন শুকনো জায়গায় পোঁতা হয় – যেমন ক্ষেতের আল ইত্যাদি জায়গায়," জানাচ্ছিলেন মি. নাগ বিশ্বাস।
তিনি এও বলছিলেন যে আর্থিং-এর তারটি যেন শুকনো জায়গায় ভাল করে পুঁতে দেওয়া হয় – যাতে কেউ চট করে খুলে ফেলে না দিতে পারে।
তবে এক্ষেত্রে কোনও ঝুঁকি নিতে চান না দক্ষিণ ২৪ পরগনার কৃষক পঞ্চানন মণ্ডল।
কর্ণাটকে ধান রোয়ার কাজে যাওয়ার আগে তিনি গোটা যন্ত্রটাই ভুলে ফেলে ঘরে রেখে গেছেন।
"ওতে তামার তার রয়েছে অনেকটা। চোরের ভয় আছে না! তাই যন্ত্রটা খুলে রেখে এসেছি। ফিরে গিয়ে যখন নিজের জমিতে ধান রুইব, তার আগে ওটা আবার লাগিয়ে নে," বলছিলেন পঞ্চানন মণ্ডল।