৪০ টাকার ভাসমান হোটেল, বুড়িগঙ্গার বুকে নিম্নবিত্তের আশ্রয়
প্রকাশ: ৯ আগস্ট, ২০২৫

ঢাকার মিটফোর্ড ঘাটে বুড়িগঙ্গার বুকে নোঙর করা কয়েকটি পুরনো নৌযান-যা স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ‘ভাসমান হোটেল’ নামে। একসময় যেখানে অভিজাত ব্যবসায়ীদের পদচারণা ছিল, এখন তা নিম্নবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষের রাতযাপনের সস্তা ভরসা। মাত্র ৪০ টাকায় ঢালাও বিছানা কিংবা ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় কেবিন ভাড়া নিয়ে কাটছে তাদের রাত।
অতীতে দেশের বিভিন্ন নৌরুটে চলা লঞ্চগুলো অচল হয়ে পড়লে সেগুলোকে অস্থায়ী আবাসিক হোটেলে রূপান্তর করা হয়। বর্তমানে নদীর তীরে সারিবদ্ধভাবে থাকা পাঁচটি দোতলা নৌকায় প্রায় ২০০ মানুষের বসবাস। প্রতিটি নৌকায় ৩০ থেকে ৫২টি কক্ষ রয়েছে। সিঙ্গেল সিটের ভাড়া ৪০-১০০ টাকা, ডাবল কেবিন ১৫০ টাকা। ছোট আকারের কক্ষে লেপ-কম্বল, বালিশ, বিশুদ্ধ পানি, বিদ্যুৎ ও মোবাইল চার্জের সুবিধা রয়েছে। শীতকালে বিনামূল্যে গরম কাপড় দেয়া হয়, তবে খাবারের ব্যবস্থা নেই।
গোসলের জন্য নদীর পানি ব্যবহার নিষিদ্ধ। তবে পাশের সরকারি কল থেকে ১০ টাকায় গোসল করা যায়। রিকশাচালক, হকার, দিনমজুর ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ বহু মানুষ প্রতিদিন এখানে রাত কাটান। প্রতিটি হোটেলের মাসিক আয় গড়ে ১২-১৫ হাজার টাকা, যার একটি অংশ ভাড়া হিসেবে দিতে হয় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষকে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯৬০-এর দশকে ব্যবসায়ীদের থাকার সুবিধার্থে ভাসমান বোর্ডিং চালু হয়। প্রথমদিকে শুধু খাবারের জন্য টাকা নেয়া হতো, থাকার জন্য নয়। স্বাধীনতার পর থেকে থাকা বাবদ ভাড়া নেওয়া শুরু হয়। নব্বইয়ের দশকে কাঠের বদলে লোহার বডি দিয়ে বোর্ডিংগুলো সংস্কার করা হয়।

পাকিস্তান আমলে সদরঘাট এলাকায় ১০-১১টি ভাসমান বোর্ডিং ছিল। কিন্তু বাবরি মসজিদ ইস্যুতে দাঙ্গার সময় এক বোর্ডিংয়ে আগুন লাগার পর সংখ্যা কমতে কমতে এখন দাঁড়িয়েছে পাঁচে। ২০২০ সালের শুরুতে লঞ্চ টার্মিনালের উন্নয়ন কাজের কারণে এগুলো মিটফোর্ড ঘাটে স্থানান্তর করা হয়।
বোর্ডিংগুলোর বর্তমান অবস্থা
‘উমা উজালা হিন্দু হোটেল’, ‘ফরিদপুর মুসলিম হোটেল’, ‘শরীয়তপুর মুসলিম হোটেল’ এবং ‘বুড়িগঙ্গা বোর্ডিং’-এই চারটি বর্তমানে সক্রিয়। ‘উমা উজালা’ সবচেয়ে বড়; একসময় তিনতলা হলেও আগুনে পুড়ে এখন দোতলা। এখানে ঢালাও বিছানার ব্যবস্থা নেই, মূলত মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী ও চিকিৎসার জন্য আসা ভাসমান মানুষ থাকেন।
অন্যদিকে ‘ফরিদপুর’ ও ‘শরীয়তপুর’ বোর্ডিং কম ভাড়ার কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে জনপ্রিয়।
সব বোর্ডিংয়েই বাঁশ বা কাঠের সাঁকো দিয়ে ওঠা যায়। দুইতলা কাঠামোয় নিচতলা ও দোতলায় সারিবদ্ধ কক্ষ রয়েছে-প্রথম কক্ষ ম্যানেজারের, এরপর সিঙ্গেল ও ডাবল কেবিন এবং ঢালাও বিছানার ঘর। ঢালাও বিছানায় ভাড়া ৪০ টাকা, তবে নিজের বিছানাপত্র আনতে হয়। সিঙ্গেল কেবিন ১০০ টাকা, ডাবল ১৫০ টাকা, যেখানে তোশক, কাঁথা, ফ্যান ও লাইট রয়েছে।
অতিথি ও মালিকদের অভিজ্ঞতা
ফরিদপুর মুসলিম বোর্ডিংয়ের মালিক মোস্তফা মিয়া বলেন, ‘পাকিস্তান আমল থেকেই আমাদের পরিবারের এই ব্যবসা চলছে। আগে শুধু খাওয়ার টাকা নিলেও থাকার ব্যবস্থা ছিল ফ্রি। এখন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ভাড়া নিতে হয়। বিআইডব্লিউটিএ’র নির্দেশে ২০২০ সালে সদরঘাট থেকে মিটফোর্ড ঘাটে আসার পর প্রথমে ক্রেতা কমে গেলেও এখন আবার জমে উঠছে।’
তিনি আরো জানান, ‘মূলত শ্রমিক, হকার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাই এখানে থাকেন। এত অল্প টাকায় থাকার সুযোগ ঢাকায় আর নেই। রাতে বেশি ভিড় হলে ছাদেও মানুষ থাকে।’ এ ফরিদপুর মুসলিম বোর্ডিং (হোটেল) ৩৬ বছর ধরে চলছে বলেও জানান তিনি।
পাশের অন্য আরেকটি হোটেল- শরীয়তপুর মুসলিম বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার শাহ জামাল জানান, ১৯৬০ সালে আবদুস সাত্তার এই ব্যবসা শুরু করেন, বর্তমানে তার ছেলে পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে।
শরিয়তপুর থেকে আসা আব্দুল হালিম (ফল বিক্রেতা) বলেন, ‘আগে মেসে মাসে দুই হাজার টাকা ভাড়ায় থাকতাম। এখন ১০০ টাকায় কক্ষে থাকতে পারছি। কম্বল, পানি, বিদ্যুৎ-সব বিনামূল্যে পাচ্ছি।’

গোপালগঞ্জের আরেক ফল বিক্রেতা, যিনি ২০০১ সাল থেকে অনিয়মিতভাবে এখানে থাকেন তিনি জানান, ‘এখানে অল্প খরচে টাকাপয়সা বা মালপত্র নিয়ে নিরাপদে থাকা যায়’।
চাঁদপুর জেলার বাসিন্দা ইমদাদুল(ব্রাশ বিক্রেতা) বলেন, ‘সারাদিন ব্রাশ বিক্রি করে এখানে এসে অল্প টাকায়, নিরাপদে থাকতে পারছি, এখানে খুব একটা খারাপ লাগে না’।
রিকশাচালক এক অতিথি জানান, ‘আগে রিকশাতেই রাত কাটাতাম। তিন বছর আগে এখানে থাকার সুযোগ পাই। এখন প্রতিরাত ৪০ টাকা দিয়ে আরামে ঘুমাতে পারি।’
বরিশাল থেকে চাকরির খোঁজে আসা রবিউল ইসলাম বলেন, ‘ইউটিউবে এ বোর্ডিং সম্পর্কে জানি। ভোটার আইডি নিয়ে এলেই ১০০ টাকায় থাকা যায়। অন্য কোথাও এত কম টাকায় ভালো থাকার ব্যবস্থা মেলে না।’
প্রবাসী মনির হোসেন বলেন, ‘১০০ টাকায় এত সুবিধা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। দু’য়েক রাতের জন্য আত্মীয়দের বাড়ি গিয়ে বিরক্ত করার দরকার নেই’।
রাজশাহী থেকে আসা পণ্যবাহী ট্রাকের হেলপার জাকির হোসেন বলেন, ‘ঢাকায় এলে হোটেলে থাকার টাকা নেই, আবার রাস্তায় শোয়া যায় না। এখানে কম খরচে রাত কাটানো যায়। যদিও জায়গা ছোট, কিন্তু নিরাপদ মনে হয়।’
পটুয়াখালী থেকে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে আসা মাঝি রহিম উদ্দিন জানান, ‘নদীতে দিনের পর দিন থাকতে হয়, কিন্তু কখনো তীরে এসে বিশ্রাম দরকার হয়। মিটফোর্ডের এই ভাসমান হোটেলগুলো আমাদের মতো মানুষের জন্য অনেক সুবিধাজনক।’
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
বর্তমানে শুধুমাত্র পুরুষরাই এসব হোটেলে থাকতে পারেন। বোর্ডিংগুলো থেকে উৎপন্ন সব বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হয়, যা বুড়িগঙ্গার পানি দূষণের অন্যতম কারণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাসমান হোটেলগুলোকে স্বাস্থ্যসম্মত ও নান্দনিকভাবে সংস্কার করলে ঢাকার পর্যটনে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে এবং বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করাও সম্ভব হবে।
বুড়িগঙ্গার বুকে এই ভাসমান হোটেলগুলো হয়তো রাজধানীর উন্নয়নের ঝলমলে ছবিতে জায়গা পায় না, কিন্তু হাজারো নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে এগুলো এক টুকরো নিরাপত্তা, সাশ্রয় ও মানবিক আশ্রয়ের প্রতীক হয়ে আছে।
লেখক : নয়া দিগন্তের ইন্টার্ন শিক্ষার্থী।