সাংবাদিকতার ব্যস্ততা পেরিয়ে নীল সমুদ্রের কোলে গৌরনদী প্রেস ক্লাব
প্রকাশ: ৯ আগস্ট, ২০২৫

নোনা হাওয়ায় ভেসে আসা ঢেউয়ের গর্জন, নীল আকাশের নিচে অনন্ত সমুদ্রের বিস্তার, এ যেন এক অনাবিল মুক্তির নাম কক্সবাজার। সূর্যোদয়ের আলো যখন সোনালি রঙে রাঙিয়ে দিল বালুকাবেলা, তখন মনে হলো পৃথিবীর সমস্ত ক্লান্তি ধুয়ে যাচ্ছে নীল ঢেউয়ের গায়ে। ঠিক এই নীলিমার আহ্বানে বন্ধুত্বের বাঁধন আর আনন্দের রঙে রাঙাতে বরিশালের গৌরনদী প্রেস ক্লাব আয়োজন করেছিল এক অবিস্মরণীয় পুনর্মিলনী ও কক্সবাজার ভ্রমণ। যেখানে ঢেউয়ের সাথে ভেসে এসেছে হাসি, সমুদ্রের গর্জনে মিশেছে গল্প, আর নোনা বাতাসে লিখে গেছে স্মৃতির অমলিন অধ্যায়।
প্রথম ভোরে সমুদ্রের বুক থেকে সূর্যোদয়
২৮ জুলাই বিকেলে গৌরনদী থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আনন্দঘন যাত্রা শুরু করেন প্রেস ক্লাবের সদস্যরা। প্রত্যেকের চোখে ছিল এক অন্যরকম উচ্ছ্বাস আর সামনে অপেক্ষা করছিলো নীলিমা, ঢেউয়ের মৃদু গর্জন আরপ্রকৃতির বিস্ময়কর সৌন্দর্য। রাতের অন্ধকারে বাস যখন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছিল তখন জানালার বাইরে সড়ক বাতির মৃদু আলোয় ঝলমল করছিল নদী-খাল আর নিস্তব্ধ গ্রাম। বাসের ভেতর ভেসে আসছিল শিশুদের হাসি আর আনন্দঘন কথোপকথনের সরলতা।
দীর্ঘ পথ পেরিয়ে ২৯ জুলাই ভোরে যখন সমুদ্রের বুক থেকে ভেসে এলো ঢেউয়ের মৃদু গর্জন তখন মনে হলো প্রকৃতি যেন দরজা খুলে দিয়েছে। এক অসীম সৌন্দর্য দেশের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের ঢেউ যেন তাদেরকে স্বাগত জানায় এক অদ্ভুত আবেশে।
ভোরের আলো ফোটার আগেই প্রেস ক্লাবের সদস্যরা পরিবারের সবাইকে নিয়ে ছুটলেন লাবণী পয়েন্টে। তখনও চারপাশে অন্ধকারের আবেশ কিন্তু সমুদ্র যেন ধীরে ধীরে নতুন ভোরের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। হঠাৎই আকাশের কিনারায় চোখের সামনে সমুদ্রের বুকে ধীরে ধীরে উঠে আসা লাল সূর্যের দৃশ্য ছিল যেন এক স্বপ্ন। ঢেউয়ের সাথে সূর্যের প্রতিফলন মিলেমিশে সৃষ্টি করছিল সোনালি আভায় মোড়ানো এক দৃশ্যপট। নোনা বাতাসের স্পর্শ, গর্জনরত ঢেউয়ের শব্দ আর সেই মুহূর্তে নিস্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে থাকা সবাই যেন প্রকৃতির কোলে হারিয়ে গিয়েছিলেন।
ঈদ পুনর্মিলনী : আনন্দের মিলনমেলা
৩০ জুলাই কক্সবাজার সমুদ্রপাড়ের এক মনোরম রিসোর্টের সাজানো-গোছানো হল রুমে অনুষ্ঠিত হয় প্রেস ক্লাবের ঈদ পুনর্মিলনী। এ সময় প্রধান অতিথি ছিলেন প্রেস ক্লাবের প্রধান উপদেষ্টা, বরিশাল-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এম জহির উদ্দিন স্বপন।
স্বপন বলেন, ‘সাংবাদিকতা কেবল পেশা নয় এটি সমাজের বিবেক। আজকের এই মিলনমেলা সাংবাদিকদের পেশাগত বন্ধনকে যেমন দৃঢ় করছে, তেমনি হৃদয়ের সম্পর্ককেও গভীর করছে।’
প্রেস ক্লাবের আহবায়ক খোন্দকার মনিরুজ্জামানের সভাপতিত্বে আয়োজিত আলোচনা সভায় সাংবাদিকদের ঐক্য, দায়িত্বশীলতা এবং মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্যানেল আহবায়ক জহুরুল ইসলাম জহির, গিয়াস উদ্দিন মিয়া, আসাদুজ্জামান রিপন, মোল্লা ফারুক হাসান, এসএম মিজান, হাসান মাহমুদ, আরিফিন রিয়াদ, রাজিব ইসলাম তারীমসহ অন্যান্যরা।
সভায় বক্তারা বলেন,‘সমুদ্রের মতোই সাংবাদিকতার মাটিও বিস্তৃত। এখানে দায়িত্ব, নৈতিকতা আর সত্যের জন্য সংগ্রাম কখনো থামে না।’
সভা শেষে সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিজ কণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি করেন এম জহির উদ্দিন স্বপন। এরপর মিলনমেলায় পরিবার-পরিজনসহ হাসি-আনন্দে মেতে ওঠেন প্রতিটি সাংবাদিক পরিবার। দেশবরেণ্য শিল্পীদের গান আর সাগরের গর্জনের মিলিত সুরে যেন কক্সবাজারের রাত রঙিন হয়ে ওঠে।
পাটুয়ারটেক থেকে হিমছড়ি
ভোরের আকাশে মেঘের ঘন সঞ্চারের সাথে টুপটাপ বৃষ্টির শব্দে ভ্রমণের সকালটা যেন শুরু হয়েছিল এক আলাদা আবেশে। বৃষ্টিভেজা জানালা দিয়ে সমুদ্রের পথে যাত্রায় প্রকৃতি সেজেছিলো এক অন্যরকম রূপে।
পাটুয়ারটেক : বৃষ্টিভেজা নীরবতার পর প্রশান্তির ছোঁয়া
সকালে বৃষ্টি থাকলেও থেমে গেল পাটুয়ার টেকে পৌঁছাতেই। প্রকৃতি যেন নিজেই স্বাগত জানাল ভ্রমণ পিয়াসুদের। বৃষ্টির ফোঁটায় ধুয়ে যাওয়া বালির ওপর পা রাখতেই মনে হলো সভ্যতার সমস্ত কোলাহল যেন কোথাও মিলিয়ে গেছে। সাদা বালুর ওপর হালকা ভেজা পরশ, নোনা বাতাসের ঘ্রাণ আর দিগন্তজোড়া সমুদ্রের নীলিমা সব মিলিয়ে যেন চোখের সামনে ফুটে উঠল এক স্বপ্নের ক্যানভাস। শিশুরা উচ্ছ্বাসে ছুটে বেড়াচ্ছিল বালির ওপর। ছোট্ট হাতে বালুর দুর্গ গড়ে তুলছিল হাসির ঝংকারে। সেই হাসি আর ঢেউয়ের গর্জন মিলেমিশে সৃষ্টি করছিল এক অনাবিল ছন্দ। সময় যেন ধীরে বইছিল এখানে। ঢেউয়ের ছন্দে, বাতাসের মৃদু স্পর্শে আর বৃষ্টিভেজা প্রকৃতির শীতলতায় মনে হচ্ছিল পৃথিবী থেমে গেছে। যেন প্রকৃতি নীরবে ফিসফিস করে বলছে, ‘এসো, কিছুক্ষণের জন্য সবকিছু ভুলে আশ্রয় নাও আমার কোলে।’
ইনানি সৈকতের নীল পাথর আর স্বপ্নিল নীলিমার গল্প
পাটুয়ার টেকের শান্তি পেছনে ফেলে যখন ইনানি সৈকতের পথে, তখন পথের দু’পাশে পাহাড়ের সবুজ আর মেঘলা আকাশ যেন একে অপরের হাত ধরে আঁকছিল স্বপ্নের ছবি। সমুদ্রের নোনা গন্ধে ভরা বাতাস মনে করিয়ে দিচ্ছিল সামনে অপেক্ষা করছে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য, যা হৃদয় ছুঁয়ে যাবে অনন্তকাল।

সৈকতে পৌঁছতেই চোখে পড়ল অসংখ্য নীলাভ পাথর। এ যেন প্রকৃতির আঁকা এক বিশাল চিত্রকর্ম। সূর্যের আলোয় জোছনার মতো সাগরের বুকে ছড়িয়ে থাকা সেই নীল পাথরগুলো ঝলমল করছিল এক অপরূপ নীলিমায়। যেন সেগুলো প্রকৃতির হাতে সাগরে ছিটিয়ে দেয়া নীলকান্তমণি। সমুদ্রের ঢেউ পাথরের গায়ে এসে আছড়ে পড়ছিল ছন্দের মতো। প্রতিটি ঢেউ এসে পাথরে ধাক্কা মেরে ফিরে যাচ্ছিল আর সাগর পৃথিবীকে শোনাচ্ছিলো তার গভীর হৃদস্পন্দন। চারপাশে শুধু নীলের রাজত্ব। সূর্যের আলোয় ঝিকিমিকি করছিল পাথরের ফাঁকে জমে থাকা নোনা জল, যা যেন সমুদ্রের গভীর থেকে উঠে আসা এক অসীম সৌন্দর্যের প্রকাশ। বাতাসে ভেসে আসা সমুদ্রের গন্ধ আর ঢেউয়ের কোমল গর্জনে মিশে গিয়েছিল এক অজানা প্রশান্তি, যা ভাষায় বন্দী করা কঠিন। ইনানি সৈকতের নীল পাথর শুধু সৌন্দর্য নয় এ যেন প্রকৃতির হাতে লেখা এক নীরব কবিতা। এখানে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল প্রকৃতি ফিসফিস করে বলছে ‘এসো, নীলিমার অন্তরে সব বেদনা ঝরিয়ে অন্য এক জগতের স্বপ্ন দেখি।’
কাকড়া বিচ : জীবন্ত ছন্দের মেলা
কাকড়া বিচে পা রাখতেই মনে হলো যেন এক শান্ত অথচ প্রাণবন্ত জগতে এসে পড়েছি। চারপাশে সমুদ্রের অবিরাম সো সো শব্দ। সেই সুরে মিশে আছে নোনা বাতাসের গন্ধ। এদিক-সেদিক দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে ভেজা বালুর ওপর ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ছোট্ট কাঁকড়া। আর তাদের পায়ের চিহ্নে বালুর ক্যানভাসে ফুটে উঠছে সূক্ষ্ম আঁকিবুঁকির নকশা। যেন প্রকৃতির তুলি দিয়ে আঁকা এক শিল্পকর্ম।
মুগ্ধ চোখে কাঁকড়ার পিছু ছুটছে শিশুরা। কেউ হাত বাড়িয়ে ধরতে চাইছে কেউবা আনন্দে করছে চিৎকার। একটু দূরে একদল শিশু ভেজা বালুর ওপর গড়ে তোলা ছোট ছোট বালুর দুর্গগুলোকে হঠাৎই আলতো ঢেউ এসে ভেঙে দেয় আর পরক্ষণেই যেন আবার নতুন করে গড়ার আমন্ত্রণ জানায়। ঢেউয়ের নরম আছড়ে পড়ার শব্দের সাথে মিশে যাচ্ছিল শিশুদের হাসি। নোনা বাতাসে ভেসে থাকা সমুদ্রের গন্ধ বুক ভরিয়ে দিচ্ছিল আর দূরে তাকালে দেখা যাচ্ছিল অসীম নীল সমুদ্রের সাথে আকাশের মিতালী। কাকড়া বিচের এই মুহূর্ত যেন ছিল প্রকৃতির জীবন্ত এক ছন্দ। যেখানে সমুদ্রের ডাক, ঢেউয়ের ছন্দ আর খেলায় মগ্ন শিশুদের উল্লাস মিলেমিশে তৈরি করেছিল এক অমলিন অভিজ্ঞতা। যেখানে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল ‘এ যেন এক জগৎ, যেখানে ঢেউয়ের সুরে হারিয়ে গিয়ে জীবনের সব ক্লান্তি ধুয়ে যায় অনন্ত নীলিমায়।’
হিমছড়ি ঝরনা : পাহাড়ি শীতলতার পরশ
শেষ গন্তব্য হিমছড়ি। ইনানির নীলিমা আর কাকড়া বিচের ছন্দময় উল্লাস পেছনে ফেলে পাহাড়ি পথে যাত্রা শুরু হতেই যেন ধীরে ধীরে অন্য এক রূপ নিতে লাগল চারপাশের দৃশ্য। রাস্তার দু’পাশে ঘন সবুজ গাছপালা, পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা বুনো লতা আর বাতাসে ভেসে আসা ভেজা মাটির গন্ধ যেন আগাম ইঙ্গিত দিচ্ছিল প্রকৃতি তার নিখুঁত সৌন্দর্য নিয়ে অপেক্ষা করছে এখানে। দূর থেকেই কানে ভেসে এলো পানির টুপটাপ শব্দ। যেন পাহাড় নিজেই ডাকছে তার গোপন শীতলতার রাজ্যে।
ঝরনার কাছে পৌঁছাতেই চোখে ধরা দিল পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা স্ফটিক স্বচ্ছ পানির ধারাপাতের এক অপূর্ব দৃশ্য। চারপাশের ঘন সবুজের ফাঁকে ঝরে পড়া রোদের কণা পানির ফোঁটায় লেগে যেন ঝিলমিল করে উঠছিল হীরের মতো। বাতাসে ভেসে আসা জলকণা মুখে এসে পড়তেই মনে হলো পাহাড় যেন তার বুকের গভীরে জমে থাকা সতেজতা ঢেলে দিচ্ছে এখানে। সেই ঠাণ্ডা পানির স্পর্শেই যেন মুহূর্তেই গলে গেল শরীরের সব ক্লান্তি। সমুদ্রের নোনা গন্ধ ছেড়ে পাহাড়ের কোলে এসে এই সতেজতার স্পর্শে মনে হচ্ছিল প্রকৃতি যেন আমাদের আবার নতুন করে শ্বাস নিতে শিখিয়ে দিচ্ছে। চারদিকে ঘন সবুজে ঘেরা নিসর্গ পাতার ফাঁকে খেলা করছে সূর্যের নরম আলো তার ফাঁকে ভেসে আসছে পাখির ডাক। সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল প্রকৃতি যেন নিজেই বলছে, ‘এসো সব ব্যস্ততা ভুলে, তোমার ক্লান্তি আমার স্রোতে ভাসিয়ে দাও। আমি তোমাকে নতুন করে জাগিয়ে তুলব।’
হিমছড়ি ঝরনার এই অভিজ্ঞতা শুধু চোখে দেখার নয়। এটি এমন এক অনুভূতি, যা ভাষায় বাঁধা অসম্ভব। যা শরীরের শিরা-উপশিরায় মিশে গিয়ে আত্মাকে ছুঁয়ে থাকে। যা ফিরে এসেও বারবার মনে করিয়ে দেয় পাহাড়ের সেই শীতল আহ্বানের কথা।
সন্ধ্যার সূর্যাস্ত : নীলিমার বুকে সোনালি রঙের খেলা
দিনের শেষ আলো গড়িয়ে এলো সুগন্ধা সৈকতে। আকাশ তখন লাল-কমলা রঙে রঙিন আর সূর্য ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে সমুদ্রের বুকে। সেই দৃশ্য যেন এক অদ্ভুত মায়া ছড়িয়ে দিচ্ছিল চারপাশে। ঢেউয়ের গর্জনের সঙ্গে মিলেমিশে তৈরি হচ্ছিল এক রূপকথার আবহ।ঠিক এই মনোমুগ্ধকর মুহূর্তের আগেই সূর্যাস্তের পটভূমিতে প্রথমে লাল পলো টি-শার্টে তারপর সাদা টি-শার্টে দুটি দলগত ছবি তুললেন প্রেসক্লাবের সদস্যরা। হাসিখুশি মুখ আর পেছনে সমুদ্রের অনন্ত নীলিমা যেন জীবন্ত করে তুলেছিল ছবিগুলোকে। সেই ফ্রেমগুলোয় ধরা পড়ল এক আনন্দময় মিলনের স্মৃতি যা বছরের পর বছর ফিরে তাকানোর মতো সম্পদ হয়ে থাকবে সবার কাছে।
সূর্য যখন সাগরের বুকে ডুবে গেল, তখন আকাশ যেন হয়ে উঠল এক রঙিন ক্যানভাস। ঢেউয়ের ডাক যেন মৃদু সুরে নিজেই ফিসফিস করে বলছে ‘যখনই ক্লান্ত হবে ফিরে এসো, আমি এখানে নীলিমার কোলে অপেক্ষায় থাকব।’
কক্সবাজারের নৈশবাজার : আলো, গন্ধ আর প্রাণচাঞ্চল্যের শহর
দিনশেষে সূর্যাস্তের রঙ মুছে গিয়ে নেমে এলো রাতের আবেশ আর সেই অন্ধকারকেই যেন হাজারো রঙিন আলোয় জাগিয়ে তুলল কক্সবাজারের নৈশবাজার। চারপাশের সাজানো দোকানপাট, উজ্জ্বল বাতি, সি-ফুডের সুগন্ধ আর মানুষের ভিড়ে বাজার যেন রাত্রির বুকে জীবন্ত হয়ে উঠল এক অনন্য উৎসবে। প্রতিটি গলি থেকে ভেসে আসছিল সদ্য ভাজা চিংড়ি, কাঁকড়া আর সাগরের নানান স্বাদের খাবারের ঘ্রাণ। যেন লোনা বাতাসে মিশে গিয়ে ক্ষুধার্ত ভ্রমণকারীদের আহ্বান জানাচ্ছিল সেই ভিন্ন স্বাদের দুনিয়ায়। দোকানিরা হাসিমুখে ডাকছিল, পর্যটকেরা আনন্দমুখর হাসিতে দামাদামি করছিল। শিশুরা বেলুন হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল রঙিন আলোয় মোড়া দোকানগুলোর সামনে। কেউ খেলনা কিনে উচ্ছ্বসিত, কেউবা বাবা-মায়ের হাত বিস্ময়ভরা চোখে যেন আবিষ্কার করছিল রাতের কক্সবাজারের উচ্ছ্বল সৌন্দর্য। নৈশবাজারের এই প্রাণচাঞ্চল্য যেন ভ্রমণের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিচ্ছিল মুহূর্তেই। এখানে প্রতিটি আলো, প্রতিটি গন্ধ আর প্রতিটি হাসি যেন বলে দিচ্ছিল, কক্সবাজার রাতেই তার আসল সৌন্দর্যে জেগে ওঠে।
রাতের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা : আনন্দে ভরা মিলনমেলা
সন্ধ্যার সেই মনোমুগ্ধকর সূর্যাস্তের পর রাত নামতেই শুরু হলো দ্বিতীয় দিনের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। আলো ঝলমলে রিসোর্টের হলরুম যেন মুহূর্তেই রূপ নিল রঙিন মঞ্চে। প্রথমেই সিনিয়র সাংবাদিকদের দীর্ঘদিনের সংবাদ সংগ্রহের অভিজ্ঞতা ও অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রদান করা হলো সম্মাননা। এরপর একে একে শুরু হলো গান, কবিতা আবৃত্তি এবং শিশুদের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা। শিশুদের সরল হাসি আর নিষ্পাপ আবৃত্তি যেন পুরো পরিবেশে এনে দিল নতুন প্রাণের ছোঁয়া। সবশেষে অনুষ্ঠিত হলো লটারির ড্র আর পুরস্কার বিতরণী পর্ব যেখানে ছিল প্রতিটি পরিবারের জন্য বিশেষ আকর্ষণীয় পুরস্কারের আয়োজন। হাসি, করতালি আর আনন্দের উচ্ছ্বাসে রিসোর্টের হলরুম যেন পরিণত হলো পারিবারিক মিলনমেলায়।
এই রাত শুধু বিনোদনের ছিল না এটি ছিল পারিবারিক সম্পর্কের উষ্ণতা ছড়িয়ে দেয়ার এক অনন্য মুহূর্ত। সাংবাদিকদের পেশাগত ব্যস্ততার বাইরে পরিবার-পরিজন নিয়ে এই মিলনমেলা যেন সবাইকে বেঁধে দিল এক অটুট বন্ধনে, যা স্মৃতির পাতায় রঙিন হয়ে থাকবে চিরকাল।
ফেরার যাত্রা : কর্ণফুলী টানেল, পতেঙ্গা আর মিষ্টি স্মৃতির পথে
১ আগস্ট। ভোরের আলো ফুটতেই বিদায়ের প্রস্তুতি। সমুদ্র তখনও যেন ঢেউ তুলে বলছিল ‘এতো তাড়াহুড়ো কেন? থেকে যাও আরো কিছুক্ষণ।’ কিন্তু সময়ের নিয়মে সমুদ্রের সেই স্নিগ্ধ আহ্বানকে পেছনে ফেলে সবাই পা বাড়ালেন ফেরার পথে।
বাসে উঠতেই কারও মুখে ছিল নীরব হাসি, কারও চোখে রয়ে গেল নীলিমার শেষ প্রতিচ্ছবি। জানালার বাইরে নীল সমুদ্র ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল পাহাড়ের আড়ালে অথচ বুকের ভেতর তখনও ভেসে বেড়াচ্ছিল ঢেউয়ের ডাক, নোনা বাতাসের ঘ্রাণ আর রাতের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার মুহূর্ত। কেউবা শেয়ার করছিল নৈশবাজারের কেনাকাটার হাস্যরসিক স্মৃতি। শিশুদের মুখে তখনও ভ্রমণের উচ্ছ্বাস। শিশুরা উত্তেজনায় একের পর এক শেয়ার করছিল কাকড়া বিচের ছুটোছুটি, হিমছড়ির ঠাণ্ডা ঝরনা আর বালুর দুর্গের গল্প।
চট্টগ্রামে প্রবেশের আগে সবাই উপভোগ করলেন আধুনিকতার এক বিস্ময়কর দৃশ্য। আলো ঝলমলে সেই টানেলের ভেতর দিয়ে গাড়ি চলার অনুভূতি যেন এক মুহূর্তে শহরের বাস্তবতা থেকে ভবিষ্যতের পথে প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছিল। টানেল পেরিয়ে সামনেই অপেক্ষা করছিল পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। এখানকার ঢেউ ছিল আরও শান্ত, আরও কোমল। সৈকতের কাছে কোলাহলহীন বাতাসে ভেসে আসা সমুদ্রের গন্ধ আর প্রশান্ত নীল দৃশ্য বিদায়ের আগে শেষবারের মতো মন ভরিয়ে দিল সবার। সবাই দাঁড়িয়ে যেন বুকভরা শ্বাসে নীলিমাকে স্মৃতির ভাঁজে গেঁথে নিলেন।
পথে ফেরার হোটেল নূরজাহানের বিখ্যাত রসমালাই যেন সবার মাঝে আনন্দে বাড়তি মাত্রা যোগ করে এই ভ্রমণকে দিল মিষ্টি এক সমাপ্তি। নরম মিষ্টির স্বাদে যেন ক্লান্তি গলে গিয়ে রয়ে গেল শুধু একটি ভ্রমণের সুখের স্মৃতি যা মন থেকে মুছে যাওয়ার নয়।
বিদায়ের অনুভূতি
চার দিনের ভ্রমণ শেষে গৌরনদী ফিরেও মনে হচ্ছিল যেন হৃদয়ের গভীরে এখনও বাজছে সমুদ্রের ঢেউয়ের সেই সুর। নোনা বাতাসের গন্ধ শ্বাসে মিশে বারবার ফিরিয়ে আনছে কক্সবাজারের রঙিন দিনগুলোর স্মৃতি। চোখ বন্ধ করলেই যেন ভেসে ওঠে সাগরের অসীম নীলিমা, হিমছড়ির শীতল ঝরনা আর ইনানির নীল পাথরের ঝলমলে দৃশ্য। এ ভ্রমণ শুধু একটি সফর নয় বরং এক অমলিন আবেগ। যা ক্লান্ত দিনের শেষে বারবার ফিসফিস করে বলে উঠে, ‘চলো, আবার ফিরে যাই সেই নীলিমার কোলে।’