Advertisement

নজরুলের স্মৃতিধন্য তেওতা জমিদারবাড়ি

যুগান্তর

প্রকাশ: ২৮ আগস্ট, ২০২৫

24obnd

সকাল ৮টা, আমাদের গাড়ি ছুটে চলছে নতুন গন্তব্যে। সঙ্গে আছি আমি আর প্রকৃতি বাংলাদেশের সুজন সেনগুপ্তের দলবল। শুক্রবার রাস্তায় যানজট কম থাকে, তাই এদিনটিকে আমরা বেছে নিলাম। এদিকে গাড়ির ভেতরেই সব পুরোনো দিনের গানের কালেকশন, মান্না’দের কণ্ঠে অসাধারণ সেই সব গান বেজে চলছে... কফি হাউজের আড্ডা আজ আর নেই, দ্বীপ নিভে গেছে, আকাশ এত মেঘলা যেও নাকো একলা, সেসব কালজয়ী গান। টঙ্গী এসে আমাদের গাড়ি থামল ফিলিং স্টেশনে। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ৯টা; সবাই গাড়ি থেকে নেমে ফ্রেস হয়ে নিলাম। এদিকে সবারই কম-বেশি খিদে লেগেছে, আমাদের মাঝে সবচেয়ে কম বয়সি আনন্দ বলে উঠল, মামারা সকালে তো কিছু পেটে পড়েনি, খাবার দেবেন না, খাবার সঙ্গে বোঝাই করে এনেছেন, বেশি ঠান্ডা হয়ে গেলে খেতে ভালো লাগবে না। শেষ পর্যন্ত সবাইকে খাবারের প্যাকেট দেওয়া হলো। খাবার তালিকায় বাংলাবাজারে বিখ্যাত চৌরঙ্গীর পরোটা-ভাজি অসাধারণ টেস্ট। তবে এর কৃতিত্ব সব পৃথুর। ও সকালের খাবারে দায়িত্বে ছিল; যা হোক আমাদের সকালের ভরাপেট আপ্যায়নের পর আমাদের গাড়ি ছুটে চলল আবদুল্লাপুর, আশুলিয়া দিয়ে আমাদের ভ্রমণ গন্তব্যে।

আমাদের আজকের ভ্রমণ গন্তব্য বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত তেওতা জমিদার বাড়ি। দেশের পুরাকীর্তি স্থাপনার মধ্যে মানিকগঞ্জের তেওতা জমিদার বাড়ি ইতিহাসে অন্যতম। রাস্তার পাশে বড় বড় কলকারখানা, গার্মেন্টস পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। দেখতে দেখতে আমরা এসে পৌঁছালাম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। সুজন সেনগুপ্ত এ জমিদার বাড়ির ইতিহাস আমাদের মাঝে তুলে ধরলেন। শিবালয় উপজেলার যমুনা নদীর কূলঘেঁষা সবুজ-শ্যামল গাছপালায় ঢাকা তেওতা গ্রামটিকে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে দিয়েছে জমিদার শ্যামশংকর রায়ের প্রতিষ্ঠিত নবরত্ন মঠটি। এক সময়ে জমিদারের বাড়ির আঙিনার মঠকে ঘিরে দোলপূজা আর দুর্গাপূজার রঙিন উৎসব পালিত হতো। মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার এ তেওতা গ্রামটি আরও বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী প্রমীলার স্মৃতি জড়িয়ে থাকায়। তেওতা গ্রামের মেয়ে প্রমীলা জমিদার বাড়ি পাশেই বসন্তকুমার সেন আর গিরিবালা সেন দম্পতির মেয়ে আশালতা সেন বা প্রমীলা নজরুল। এর ডাক নাম দুলি। ছন্নছাড়া, ভবঘুরে নজরুল কয়েক দফায় এসেছিলেন এ গ্রামে।

তবে জনশ্রুতি মতে, ১৯২২ সালে প্রমীলার সঙ্গে একবার এসেছিলেন, ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসে নজরুলের লেখা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি ধূমকেতু পত্রিকায় প্রকাশ হলে ব্রিটিশ সরকার তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে। প্রমীলাকে নিয়ে তেওতা গ্রামে আত্মগোপন করেন নজরুল। আত্মগোপনে থাকতে এলেও দুরন্ত নজরুল অবশ্য ঘরের কোণে বসে থাকেননি। যমুনার ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা সবুজ-শ্যামল পাখিডাকা তেওতা গ্রামে ছুটে বেরিয়েছেন। গান, কবিতা আর অট্টহাসিতে পুরো গ্রামের মানুষকে আনন্দে মাতিয়েছেন। কখনো বা জমিদার বাড়ির শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে রাতের বেলায় করুণ সুরে বাঁশি বাজিয়ে বিমোহিত করেছে রাতজাগা গ্রামের মানুষকে।

জমিদার কিরণশংকর রায়ের আমন্ত্রণে একবার নজরুল তার অতিথি হয়ে আসেন। আর সে সময়ই নজরুল এবং প্রমীলার দেখা হয়েছিল। জমিদার বাড়ির পাশের বাড়ি বসন্তকুমারের মেয়ে দুলি (প্রমীলা) ছিলেন তখনকার জমিদার কিরণশংকর রায়ের স্নেহধন্য। বেড়াতে এসে নজরুল জমিদার বাড়িতে প্রতি রাতেই গান-বাজনার আসর বসাতেন। আর সেখানে একমাত্র গায়ক ছিলেন নজরুল। দুলি তখন মাত্র কয়েক বছরের বালিকা। নজরুল গানের ফাঁকে ফাঁকে পান খেতেন। আর দুলির দায়িত্ব ছিল তার হাতে পান তুলে দেওয়া। হয়তো এর মাধ্যমেই নজরুল প্রমীলার পরিচয় আরও ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। বিয়ের পর তেওতার জমিদার কিরণশংকর রায়ের আমন্ত্রণে নজরুল নববধূকে নিয়ে আবার তেওতায় আসেন। প্রায় দুই সপ্তাহ থাকার সময় জমিদার বাড়িতে নজরুলের গান ও কবিতার আসর বসত। দর্শকের আসনে জমিদার পরিবারের পাশে প্রমীলাও থাকত। আর নজরুল যখন ‘‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সেকি মোর অপরাধ.... অথবা, মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী দেব খোঁপায় তারার ফুল, গান গাইতেন তখন লজ্জায় রক্তিম হতেন প্রমীলা। ভবঘুরে জীবনে নজরুল যেখানেই গেছেন, সেখানেই তিনি কিছু না কিছু রচনা করেছেন। তেওতার স্মৃতি নিয়েও তিনি অনেক কবিতা-গান সৃষ্টি করেছেন বলে নজরুল গবেষক রফিকুল ইসলামের গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে। এমনই একটি হচ্ছে নজরুলের ‘লিচু চোর কবিতা’। তেওতার জমিদারদের স্থানীয়ভাবে বলা হতো বাবু। আর তাদের বিশাল পুকুর ঘিরে তালগাছ থাকায় বলা হতো তালপুকুর। প্রাচীর ডিঙিয়ে এই পুকুর পাড়ের গাছ থেকে একটি বালক লিচু চুরি করতে গিয়ে মালি ও কুকুরের তাড়া খাওয়ার প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে নজরুল এ কবিতাটি রচনা করেছেন বলে রফিকুল ইসলাম তার গবেষণায় উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়াও তেওতা গ্রামের পাশ দিয়ে যমুনা নদীর স্মৃতিতে বেশকিছু গান ও কবিতা লিখেছেন। যেমন নীল শাড়ি পরে নীল যমুনায় কে যায়। কেন প্রেম যমুনা আজি হলো অধীর। আজি দোল ফাগুনে দোল লেগেছে...বৃন্দাবনে প্রেম যমুনায়।

আমাদের আজকের ভ্রমণের কাণ্ডারি সুজন সেনগুপ্তের বর্ণনার পর আমরা রাজবাড়ি দেখা শুরু করলাম। জমিদার বাড়িটি এখনো তার কাঠামোতে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও খয়ে গেছে এর ইটের দেওয়াল। বাড়ির সামনে বিশাল একটি পুকুর, এ পুকুরের জল তরঙ্গে পুরো রাজবাড়ির অবয়ব দর্শন করা যায়। আর একটি পুকুর পেলাম আমরা ভেতরে, কিন্তু খুবই করুণ অবস্থা তার। বাড়ির সামনে আছে একটি বহুতল মন্দির। কারুকাজময় মন্দিরটি আজ বিলিন হওয়ার পথে। এখনো যেটুকু সৌন্দর্য অবশিষ্ট রয়েছে, তার আকর্ষণও কম নয়। এদিকে আনন্দ তার ক্যামেরা নিয়ে একের পর এক ছবি তুলতে থাকল। আমরা বাড়িতে ঘুরছি হঠাৎ চোখে পড়ল দোতালায় ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলাম। ছাদ থেকে পুরো বাড়ির গঠন কাঠামো দেখতে পেলাম অসাধারণ কারুকার্য খচিত। বাড়ির সামনে মাঠের কোণায় একটি কুয়া আবিষ্কার করলেন আমাদের বলাই ভাই। বাড়ির সামনেই আছে সবুজ ঘাসের বড়সড় মাঠ। মাঠেই রয়েছে জমিদারদের তৈরি টিনের চালার এক কাচারি বাড়ি। এখানে সেখানে ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গেছে। জায়গায় জায়গায় পরিধেয় জামা-কাপড় শুকাতে দেওয়া হয়েছে। দেখে মন খারাপ হয়। উন্নত বিশ্বে যেসব স্থাপনা হেরিটেজ হিসাবে সংরক্ষিত হয়, আমাদের দেশে সেসব স্থাপনা পড়ে থাকে অবহেলায়, ক্ষয়ে যায় অস্থি-মজ্জা সব, ঘুণে ধরে বিচূর্ণ হয় ইতিহাসের পাতা। অপূর্ব সব স্থাপনা আর নির্মাণশৈলী নিয়ে আমাদের বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে পড়ে আছে অসংখ্য জমিদার বাড়ি, রাজবাড়িসহ আরও কত স্থাপনা। তেওতা জমিদার বাড়ি দেখে আমরা আরিচাঘাটে এসে টাটকা মাছ-ভাত-ডাল দিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম। নদীর পাড়ে শেষ বিকাল কাটিয়ে আমরা যখন ফিরতি পথ ধরলাম, তখন সন্ধ্যা মিইয়ে গিয়ে রাতের ঝাঁপি চারপাশে। রাত ৯টা নাগাদ ঢাকা শহরের জ্যাম ঠেলে যখন বাসায় পৌঁছলাম রাত তখন প্রায় ১০টা।

কীভাবে যাবেন

কয়েকটি পথ ধরে আপনি যেতে পারবেন তেওতা রাজবাড়ি। ঢাকা থেকে আরিচার দূরত্ব ৯০ কিমি। গাবতলী থেকে যাত্রীসেবা, বিআরটিসি, পদ্মা লাইন ইত্যাদি বাসে আরিচা ঘাট যেতে পারবেন। আরিচা ঘাট থেকে রিকশায় যাওয়া যাবে তেওতা জমিদার বাড়ি অথবা ঢাকা থেকে বাসে আরিচা ঘাট এসে নামতে হবে। এরপর সিএনজি অটোরিকশা অথবা রিকশাযোগে তেওতা যেতে হবে। এছাড়া নদীপথেও আসা যাবে। এজন্য নৌকায় আরিচাঘাটে এসে নামতে হবে। যমুনা নদী দিয়ে বাংলাদেশের যে কোনো পয়েন্ট থেকে তেওতা জমিদার বাড়ি আসা যাবে।

আরও পড়ুন

Lading . . .