সবুজ গালিচার মতো বিছানো মৌলভীবাজারের মাজদিহি চা-বাগানছবি: প্রথম আলো

মৌলভীবাজার যেন ক্যানভাসে আঁকা সুন্দর একটি ছবি

মৌলভীবাজার মানেই সবুজের অন্তহীন মায়া। সকালের হালকা আলোয় এখানকার চা-বাগানগুলো কোথাও সমতলের মতো পরিপাটি করে সাজানো, কোথাও টিলা থেকে গড়িয়ে পড়া সবুজ গালিচার মতো শুয়ে আছে। আঁকাবাঁকা পথগুলো সেই গালিচার বুক চিরে চলে গেছে গহিন অরণ্যের দিকে। ভোরের নির্জনতায় কেবল শোনা যায় চা-শ্রমিকদের পদধ্বনি আর কখনোবা পর্যটকদের গাড়ির শব্দ।

এখানে সবচেয়ে পরিচিত দৃশ্য চা-বাগান আর সেই বাগান ঘিরে থাকা মানুষের জীবন-জীবিকার গল্প। মৌলভীবাজারে প্রায় ১০০ চা-বাগান। শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, বড়লেখা কিংবা কুলাউড়া—সব জায়গাতেই চোখে পড়বে পাহাড়-টিলা আর চা-বাগানের সবুজ বাহু আগলে রাখা প্রকৃতি। আছে হাওর-বাঁওড়, পাহাড়-টিলা, বন-বাদাড়, দিগন্তজুড়ে ফসলের মাঠ। প্রকৃতি সাজিয়ে রেখেছে জেলাটির চারপাশকে।

মাত্র বর্ষা গেছে। শরৎ ডানা মেলছে সাদা মেঘের পালকে। কোথাও হয়তো ফুটতে শুরু করেছে কাশফুল। প্রকৃতি এ রকমই, কোথায় কী ঘটছে, এ নিয়ে তার কৌতূহলের প্রয়োজন নেই। সে আছে তার নিজের নিয়ম নিয়ে। এত রূপ দিকে দিকে, যে কেউ বলতেই পারে ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ/খুঁজিতে যাই না আর...।’ তারপরও কেউ রূপ খুঁজতে সাত সাগর-তের নদী পারও হতে পারেন। তবু এখানে মানুষের ঘরদোরের পাশে এ রকমই—‘চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ/জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের অশ্বত্থের করে আছে চুপ;/ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে’—আরও কত কিছু! চাইলে এখানেও চুপ করে এমন রূপ নিয়ে বসে থাকা যায়, যুগ যুগ ধরে কেউ তো আছেনই।

বর্ষা গিয়েছে ঠিকই, তবে এখনো বৃষ্টি ফুরিয়ে যায়নি। মাঝেমধে৵ই আকাশ মন ভার করছে, ছাইমাখা মেঘ ভেসে আসছে। ঝরঝর বৃষ্টি নামছে। বৃষ্টি ধুয়া পাতার সবুজ চকচকে হয়ে উঠছে। পাতার শরীরে শিশিরের মতো ফুটছে জলের ফোঁটা। বর্ষার রেশ এখনো প্রকৃতির সবদিকে। তবু সময় বলছে এখন আর বর্ষা নেই; এখন ‘কে ভাসাল সাদা মেঘের ভেলা’র সময়।

কোথাও ঝরনা, কোথাও হ্রদ, কোথাও বন, কোথাও হাওরের বুকভরা জল থইথই করছে। বড়লেখার পাথারিয়া পাহাড়ের ভেতর সেই কোন কাল থেকে ঝরছে জলের স্রোত। পাহাড়ের বুক চিরে নেমে এসেছে মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত। ওপর থেকে নিচে নেমে আসা এই জলপ্রপাতের স্রোতে এখন জলের পরিমাণটাও বেশি। ওই পথে চা-বাগান, বনেও রূপ ফুটেছে।

তার উল্টোদিকে হাকালুকি হাওর। মৌলভীবাজার-সিলেটের পাঁচটি উপজেলায় বিস্তৃত এই হাওর। হাওর এখন জলে টইটুম্বুর। এখানে জলের ঢেউ লুটিয়ে পড়ছে হাওরপারে। স্থানীয় লোকজন এই ঢেউকে বলেন ‘আফাল’। একেকটি আফাল কয়েক ফুট উচ্চতায় যখন লাফিয়ে ওঠে, তাতে রোদ পড়ে মনে হতে পারে রুপার থালা নাচছে জলের চূড়ায়। সারাবেলা হাওরের কোথাও না কোথাও ভাসছে জেলের নৌকা।

হাওরের কুলাউড়া, বড়লেখা, জুড়ীর যেকোনো প্রান্ত থেকেই হাওরটিকে দেখা যায়। আছে বড়লেখার হাল্লা পাখিবাড়ি। সারা বছর ধরেই ওখানে পাখির বসতি আছে, আনাগোনা আছে। এখনো অনেক পাখি আকাশ সাজিয়ে নামে বাড়িতে।

জুড়ীতে লাঠিটিলা পাহাড় শুধু উদ্ভিদই না, জীববৈচিত্র্যের এক অন্যতম আশ্রয়। অনেক বিরল, দুর্লভ প্রাণী আছে লাঠিটিলা পাহাড়ে। এখানেও এখনো বর্ষার মায়া লেগে আছে।

সিলেট বিভাগের সর্বোচ্চ পাহাড়চূড়া হচ্ছে কালাপাহাড়। এটি কুলাউড়ায় পড়েছে। স্থানীয়ভাবে এই পাহাড়কে হারারগজ নামেও অনেকে চেনেন। এর অন্য পাশে ভারত সীমান্ত। কালাপাহাড় তার বুক গভীর সবুজে এখন সাজিয়ে রেখেছে। যতই ভেতরে যাই, শুধুই সবুজ। দেশের অন্যতম সংরক্ষিত বনাঞ্চল লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে যেমন অনেক বিরল উদ্ভিদ আছে, আছে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী উল্লুকসহ অনেক প্রাণী। বানর তো দেখাই যায়, খুব বেশি ভিড় না হলে এই উল্লুকও কাউকে দয়া করে দেখা দিতে পারে। মাঝেমধে৵ ডাকতে শোনা যায়।

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান পড়েছে জেলার কমলগঞ্জে। কমলগঞ্জে আরও একটি সংরক্ষিত বন আছে, রাজকান্দি-আদমপুর। এই বনগুলো এখনো বর্ষাকেই মনে রেখেছে। ওখানেও এখন ঘুমিয়ে আছে সবুজ পাহাড়। আছে কুরমা চা-বাগানের পথ ধরে গভীর পাহাড়ের ভেতর হামহাম জলপ্রপাত। বর্ষাই এই জলপ্রপাতের প্রাণ, যৌবনের কাল। যাদের পায়ে এখনো একটু জোর আছে, তারা ওইদিকে পা বাড়ালে ভালো। উঁচুনিচু টিলার পথটা অনেকটা পিচ্ছিল, পা ফসকানোর ঝুঁকিতে ভরা।

কমলগঞ্জের মাধবপুর লেক, তার চারপাশে এখন চা-বাগানের সবুজ চাদর মেলেছে। লেকের জলে ফুটছে শাপলা-শালুক। সীমান্তে ধলই চা-বাগানে আছে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অংশ যেমন আছে সেখানে, তেমনি চা-বাগানের প্রকৃতিও মন ভোলানো।

রাজনগর ও মৌলভীবাজার সদর নিয়ে বহুকাল ধরে এক জলাভূমি কাউয়াদীঘি হাওর। এই হাওরে এখন থইথই করছে জল। হাওরপারের অন্তেহরিতে জলাবনে ফুটছে হাওরের অন্য রূপ। হাওরের জলে এখন জেলেদের নাও ভাসছে। কোথাও ছোট ছোট ডিঙিগুলো পাল তুলে ছুটছে। চা-বাগানতো আছেই শ্রীমঙ্গলে। সঙ্গে আছে দার্জিলিং টিলা, লাসুবন গিরিখাত, হাইল হাওরে বাইক্কা বিলের মতো বিল-বাঁওড়।

ভারতের দার্জিলিংয়ের মতো দেখতে বলেই হয়তো এম আর খান চা-বাগানের সাজানো-গুছানো স্থানটি দার্জিলিং টিলা নামেই পরিচিতি পেয়েছে। অন্যদিকে সিন্দুরখান ইউনিয়নের ঘন জঙ্গলবেষ্টিত স্থানে আছে প্রাচীন ‘লাসুবন গিরিখাত’। খাসি ভাষায় লাসুবন শব্দের অর্থ হচ্ছে পাহাড়ি ফুল বা জংলি ফুল। ছোট-বড় অনেক গিরিখাতে এখন জলের ঝিরি বইছে। তিনটি গিরিখাতের পরিচিতি খাসি ভাষায় তৈরি হয়েছে ক্রেম ক্লু, ক্রেম কেরি ও ক্রেম উল্কা। খাড়া পাহাড়ের মাঝ দিয়ে ঝিরিগুলো প্রবাহিত। রোদ-ছায়ায় জল-পাথরের অনেক কারুকাজ চলছে এই ঝিরিতে।

হাইল হাওরের দিকে যেতে যেতে চোখে পড়ে পথের দুই পাশে ডোবা-নালায় অনেকগুলো সাদা-নীল শাপলা ফুটেছে। অনেকটা দূরে বিলের বুকে ভাসছে কিছু নৌকা। হয়তো মাছ ধরছে কেউ। কিছু শঙ্খচিল উড়ছে ডানা মেলে, তাদের ডানা ছুঁয়ে লাফিয়ে পড়ছে রোদ। প্রকৃতির উদারতা বলে যদি কিছু থাকে, জেলার সবখানে তার ছোঁয়া লেগেছে। যে দিকেই পা বাড়ানো যায়, সেদিকেই প্রকৃতির চোখজুড়ানো লাবণ্য।