ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ভূমিধস বিজয় পেয়েছে। তাদের এমন ফল বিস্ময়কর হলেও অসম্ভব ছিল না বলে মন্তব্য করছেন বিশ্লেষকরা। সেইসঙ্গে শিবিরের এমন একচেটিয়া বিজয়ে অনেকটা হতভম্ব ও বিস্মিত বিএনপির নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে ছাত্রদল ও অন্য অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা।
ডাকসু নির্বাচনে ভোটের নানা সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের সামনে নানা প্রশ্ন হাজির হয়েছে। বিশেষত বিএনপি ও ছাত্রদলের সাংগঠনিক অবস্থা; প্যানেল নির্বাচনে কোনো সমস্যা ছিল কি না; ছাত্ররা কীসের ভিত্তিতে ছাত্রশিবিরকে ভোট দিল ইত্যাদি। এসব বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নেতাকর্মীরা নানা ধরনের আত্মসমালোচনামূলক লেখা পোস্ট করছেন। বিএনপির হাইকমান্ডকে দল গোছাতে কঠোর হওয়া এবং ‘মাইম্যান’ কমিটি গঠনের পরিবর্তে দক্ষ-ত্যাগীদের দিয়ে কমিটি গঠনের কথা বলছেন। দলটির একাধিক নেতা বলেছেন, এই ধাক্কা থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে চান। বিএনপি মনে করে, এতদিনে তারা রাজনৈতিক শত্রু নির্ধারণ করতে পেরেছে, এখন শত্রুকে টার্গেট করে তারা পরিকল্পনা নেওয়া তাদের জন্য সহজ হবে। বিশেষ করে আগামী নির্বাচনে তারা জামায়াতে ইসলামীকে কীভাবে মোকাবিলা করবে, সেই পরিকল্পনা নিয়ে চিন্তা করছে।
ডাকসু নির্বাচনে মোট ২৮টি পদের ২৩টিতেই ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ জয় পেয়েছে। ডাকসুর শীর্ষ তিন পদের প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে মূলত বিএনপির ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের। তবে ডাকসুর অন্য পদগুলোতে ছাত্রদলের প্রার্থীরা উল্লেখযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে পারেনি।
ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের এমন অভাবনীয় জয় প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, এ নিয়ে মন্তব্য করার সময় এখনো আসেনি। সব বিষয় জানতে হবে। কেননা, অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ রয়েছে। সবটা না জেনে কথা বলা ঠিক হবে না।
ডাকসু নির্বাচন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে কি না—এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা সেভাবে বলা মুশকিল। তবে কিছুটা প্রভাব তো থাকবেই। সেটা বিস্তারিত বলা যাবে আরও কিছুদিন পর। যেহেতু নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় এখনো ছয় মাসের মতো দেরি আছে। ততদিনে পরিস্থিতি কোনদিকে গড়ায়, সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ কালবেলাকে বলেন, ডাকসু নির্বাচনের ফল বিস্ময়কর হলেও অসম্ভব ছিল না। ছাত্রশিবির সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব সুশৃঙ্খলভাবে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছে। সেইসঙ্গে তাদের আচরণের দ্বারা সাধারণ ভোটারদের অন্তরকে আকৃষ্ট করতে পেরেছে। সম্ভবত তাদের সব প্যানেলের প্রার্থীরা একাডেমিক্যালি তথা পড়াশোনার দিক দিয়ে বেশ ক্যালিবারেট। তাদের মধ্যে দু-একজনের ক্যারিশমাও আছে। যেমন তাদের ভিপি প্রার্থী জিএস প্রার্থীর চেয়েও ৪ হাজার ভোট বেশি পেয়েছে। তার মানে হলো, ব্যক্তিরও গুরুত্ব ছিল। সে তার প্যানেলকে লিড দিয়েছে এবং অন্যদেরও ভোট টানতে সুবিধা করেছে।
তিনি বলেন, মতাদর্শগতভাবে স্বচ্ছ না হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পেতে পারেন না। আমি ইসলামী ছাত্রশিবিরের আদর্শ পছন্দ করি বা না করি, তারা একটা পরিষ্কার আইডিওলজি শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করতে পেরেছে। অন্যদিকে, ছাত্রসংগঠন হওয়ার জন্য যে গুণাবলি অর্জন করা দরকার, সেখানে ছাত্রদলের বেশকিছু ঘাটতি রয়ে গেছে। সেটি সাংগঠনিক বা আদর্শগত দুর্বলতা যে কোনো কারণেই হোক। বিশেষ করে আমাদের দেশের মানুষ এখন প্রচণ্ডভাবে ভারত এবং আওয়ামী লীগবিরোধী। ফলে এই আবহের মধ্যে কেউ যদি ভারতীয় আধিপত্যবাদ, ফ্যাসিবাদ ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কঠিন বক্তব্য দিতে না পারে, তাহলে সাধারণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পারবে না।