সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় সাদাপাথর পর্যটন এলাকা ধীরে ধীরে ফিরছে আগের রূপে। গতকাল ছুটির দিনে পর্যটকদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। গতকাল বিকেলেছবি: আনিস মাহমুদ

আবারও পর্যটকে মুখর সাদাপাথর

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের পর্যটনকেন্দ্র সাদাপাথর দুই সপ্তাহ পর আবারও যেন চিরচেনা রূপে ফিরল। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে সাদাপাথরে গণলুটের পর পর্যটকদের উপস্থিতি আশঙ্কাজনক হারে কমে যায়। তবে গতকাল শুক্রবার আবার পর্যটকদের ভিড়ে এলাকাটি মুখর ছিল।

গতকাল সাত থেকে আট হাজার পর্যটক সাদাপাথরে এসেছেন বলে স্থানীয় প্রশাসন ও বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেছে। এতে স্বস্তি ফিরেছে এখানকার পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীদের মধ্যে। তাঁরা জানান, গণলুটের আগে ছুটির দিনগুলোতে ১০ থেকে ১৫ হাজার পর্যটক আসতেন। দুই সপ্তাহ ধরে পর্যটক না আসায় তাঁদের ব্যবসায় মন্দাভাব দেখা দেয়। এখন আবার পর্যটক ফিরতে শুরু করেছে।

যোগাযোগ করলে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম প্রথম আলো কে বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য স্বস্তির বিষয় যে আবারও পর্যটকেরা আসতে শুরু করেছেন। সাদাপাথর এলাকায় পর্যটকবান্ধব সব ধরনের ব্যবস্থা দ্রুততার সঙ্গে নেওয়া হচ্ছে। নির্বিঘ্নেœবেড়ানোর সব পরিবেশ সাদাপাথরে আছে।’

একাধিক পর্যটক জানান, গতকাল দিনভর থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় পরিবেশ ছিল স্নিগ্ধ। সীমান্তের ওপারে ভারত অংশে সবুজে আচ্ছাদিত সারি সারি পাহাড় আর আকাশে ছিল মেঘ-বৃষ্টির খেলা। ‘জল-পাথরের বিছানা’খ্যাত পাথরের ওপর দিয়ে প্রবল বেগে প্রবাহিত স্বচ্ছ শীতল পানিতে পর্যটকেরা গা ভাসিয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করেন।

খুলনা থেকে সপরিবার বেড়াতে এসেছেন সেলিনা আক্তার নামের এক নারী। তিনি বলেন, ‘আমি আরও কয়েকবার সাদাপাথরে এসেছি। তখন যে পরিমাণ পাথর ছিল, তা এখন নেই। লুট হওয়া পাথর আবার আনা হচ্ছে, এতে যদি আবারও আগের রূপ কিছুটা ফেরে, ভালো লাগবে।’

দৃষ্টিনন্দন সাদাপাথরের অবস্থান সিলেটের সীমান্তঘেঁষা কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের শূন্যরেখার কাছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর এখানকার পাথর চুরি শুরু হয়। ধীরে ধীরে লুটপাট বাড়তে থাকে। সর্বশেষ চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এখানে রীতিমতো গণলুট হয়। সব মিলিয়ে এখানকার প্রায় ৮০ শতাংশ পাথর লুটপাট হয়।

‘অপরাধীর পরিচয় দেখার সময় এখন নয়’

গতকাল সকালে সাদাপাথর পরিদর্শন করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোখলেস উর রহমান। পরে বেলা পৌনে ১১টার দিকে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় সাদাপাথরের মতো একটি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটনকেন্দ্রে ভয়াবহ লুটপাট দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নœকরেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

মো. মোখলেস উর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লুটের ঘটনায় যে দলেরই প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা প্রশাসনের যত বড় কর্মকর্তাই জড়িত থাকুক না কেন, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, বিজিবি ক্যাম্পের পাশেই সাদাপাথরে ভয়াবহ লুটপাট হয়েছে। এ ধরনের ঘটনায় বিজিবি কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না। এখানে বড় লুটপাট হয়েছে। আইন সবার জন্য সমান, অপরাধীর পরিচয় দেখার সময় এখন নয়।

মো. মোখলেস উর রহমান আরও বলেন, ‘আমরা দুইটা সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিক দিয়েছি। ডিসি সাহেবকে উইথড্র করে নিয়েছি, নতুন ডিসি সাহেব দিয়েছি। অ্যান্ড হি ইজ দ্য বেস্ট। ইউএনওকে উইথড্র করেছি, এসি ল্যান্ডকে ডিসফাংশনাল করেছি। এখানে ফাংশনাল, সিলেকটেড যে লোকগুলো কাজ করবে, জনগণের সঙ্গে আপনাদের সঙ্গে মিলেমিশে।’

সাদাপাথর পরিদর্শনকালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব পর্যটনকেন্দ্রটিকে ২৪ ঘণ্টা সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনার নির্দেশনা দেন। তাঁর পরিদর্শকালে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার দেবজিৎ সিনহা, সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সাদাপাথরে লুট হওয়া পাথর উদ্ধার করে প্রতিস্থাপনের কার্যক্রমটি পরিবেশবিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম এ সময় জানান, পাথর ফেলে হয়তো আগের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনা যাবে না, কিন্তু ক্ষতিপূরণ যতটুকু করা যায়, সে চেষ্টা করা হচ্ছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক তদন্তে সাদাপাথর লুটে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) নির্লিপ্ততার অভিযোগ আসা প্রসঙ্গে মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, যার নামই আসুক, যারই সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে গতকালও লুট হওয়া পাথর উদ্ধারে যৌথ বাহিনী ও টাস্কফোর্সের অভিযান পরিচালিত হয়েছে।

লোভাছড়া পাথর কোয়ারির পাথর স্থানান্তর ও পরিবহন বন্ধে নির্দেশনা

সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লোভাছড়া পাথর কোয়ারির সব ধরনের পাথর স্থানান্তর ও পরিবহন বন্ধে নির্দেশনা দিয়েছে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি)। এ নির্দেশনা–সংক্রান্ত বিএমডির একটি চিঠি স্থানীয় প্রশাসনের কাছে এসেছে।

কানাইঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানিয়া আক্তার প্রথম আলো কে জানান, গত মঙ্গলবার তিনি বিএমডির চিঠি পেয়েছেন। এখন সব ধরনের পাথর স্থানান্তর ও পরিবহন বন্ধ আছে। রাতেও যেন কেউ পাথর সরাতে না পারে, সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একটি পাথরও এখন অপসারণ ও পরিবহন করতে দেওয়া হবে না বলেও তিনি জানান।

বিএমডির নির্দেশনায় লেখা আছে, লোভাছড়া পাথর কোয়ারি এলাকার লোভা নদীর দুই পাশে জব্দ করা পাথরের মধ্যে রিট মামলার আওতাবহির্ভূত মোট ৪৪ লাখ ২৩ হাজার ১১৩ ঘনফুট পাথর সরকারের অনুমোদনক্রমে উন্মুক্ত নিলাম দরপত্র বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে। নিলামের পাথর অপসারণের সময়সীমা গত ২৩ জুলাই শেষ হয়েছে। তবে নিলাম ক্রেতা ইতিমধ্যে মেয়াদ বাড়ানোর জন্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন করেছেন, যা আদালতে বিচারাধীন।

নির্দেশনাসংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়, পাথর অপসারণের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নতুন করে মেয়াদ না বাড়ানোয় কোয়ারি এলাকা থেকে আর কোনো পাথর অপসারণ ও পরিবহনের সুযোগ নেই। এ ছাড়া সরকারি নির্দেশনায় লোভাছড়া পাথর কোয়ারি ইজারা দেওয়া আপাতত বন্ধ আছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমে লোভাছড়া পাথর কোয়ারি থেকে অবৈধ বা অননুমোদিতভাবে পাথর উত্তোলন, আহরণ, পরিবহন ও অপসারণ করা হচ্ছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

সরকারি স্বার্থে জরুরি ভিত্তিতে লোভাছড়া পাথর কোয়ারি থেকে অবৈধ, অননুমোদিতভাবে পাথর উত্তোলন, আহরণ, পরিবহন ও অপসারণ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা প্রয়োজন বলে বিএমডি নির্দেশনায় জানিয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিএমডির মহাপরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. আনোয়ারুল হাবীব স্থানীয় প্রশাসনকে অনুরোধ জানান।