আগামী নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির মধ্যে এক ধরনের ঐকমত্য দেখা গিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি এই দুটি দলের মধ্যে এক ধরনের টানাপোড়েন বা দূরত্বও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বিশেষ করে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও পিআর পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন দাবিতে জামায়াত-এনসিপি-খেলাফত-ইসলামী আন্দোলনসহ আটটি দলের যুগপৎ আন্দোলনের কথাও ছিল।
সোমবার ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিসসহ চারটি দলের সাথে জামায়াতে ইসলামী যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করলেও সেখানে নেই এনসিপি।
গত কয়েকমাস ধরে জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে এক ধরনের ঐকমত্য দেখা গেলেও হঠাৎ জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে কেন এই টানাপোড়েন তৈরি হলো সেই প্রশ্নও সামনে আসছে।
এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন নেতা ও দলটির ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছেন, নির্বাচন সংস্কারসহ বেশ কিছু ইস্যুতে বর্তমানে এনসিপির মধ্যে দুইটি স্পষ্ট ধারাও তৈরি হয়েছে।
যে কারণে এখনই জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনি সমঝোতায় যেতে এনসিপিতে আপত্তিও রয়েছে। অন্যদিকে, সংস্কার নিয়ে জামায়াতের কিছু দাবির সাথে এনসিপির মত পার্থক্য থাকায় দলটি জামায়াতের সাথে যুগপৎ আন্দোলনে যাচ্ছে না।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, সংস্কারের সব দাবিতে একমত না হওয়া ও নির্বাচনি জোট হওয়া নিয়ে নানা অস্পষ্টতা থাকায় আপাতত জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধতা নিয়ে এখনো কোন সিদ্ধান্ত নেয় নি এনসিপি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাজনীতির মাঠ বুঝে আপাতত কিছুটা কৌশলী অবস্থান নিয়েছে এনসিপি। আপাত দৃষ্টিতে যেটিকে দূরত্ব বা টানাপোড়েন মনে হলেও ভোটের সময় ঘনিয়ে আসলে এনসিপির সেই অবস্থানেও পরিবর্তন আসতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, লক্ষ্যের জায়গা এক ছিল, কিন্তু লক্ষ্য অর্জনের পর বিভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই দূরত্ব তৈরি হয়।

ছবির উৎস, CA PRESS WING
ছবির উৎস, CA PRESS WING
জুলাই সনদ নিয়ে মত পার্থক্য
বিবিসি বাংলার সর্বশেষ খবর ও বিশ্লেষণ এখন সরাসরি আপনার ফোনে।
ফলো করুন, নোটিফিকেশন অন রাখুন
বিবিসি বাংলার সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ বিবিসি বাংলার হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গত কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে টানা আলোচনা চালাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষিত ঐকমত্য কমিশন।
এই সংস্কার প্রস্তাবের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিএনপির দ্বিমত থাকলেও এ নিয়ে অনেকটাই কাছাকাছি অবস্থানে ছিল জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠন।
এমনকি সনদ বাস্তবায়নে গণভোট কিংবা গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিও তুলেছিল জামায়াত ও এনসিপি।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও পিআর পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচনসহ পাঁচ দফা দাবিতে জামায়াতে ইসলামী সোমবার যুগপৎ আন্দোলনের বিক্ষোভ কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে।
জামায়াতের সাথে এই যুগপৎ আন্দোলনে যাওয়ার বিষয়ে অনেকটা অগ্রগতি হলেও শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে পিছু হটেছে এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ ও এবি পার্টি।
যে কারণে শেষ পর্যন্ত জামায়াত খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশে খেলাফত মজলিস ও নেজামে ইসলাম পার্টির একাংশকে নিয়ে আগামী ১৮ই সেপ্টেম্বর থেকে আন্দোলনে নামছে।
এনসিপি বলছে, যুগপৎ আন্দোলনের যে সব দাবিগুলো রয়েছে সেগুলোর সবগুলোর সাথে একমত না থাকায় আপাতত জামায়াতের সাথে আন্দোলনে নামছে না তারা।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ও লিয়াজো কমিটির প্রধান আরিফুল ইসলাম আদীব বিবিসি বাংলাকে বলেন, "জামায়াত-ইসলামী আন্দোলন খেলাফত মজলিসসহ কিছু দল উচ্চ ও নিম্নকক্ষ দুই কক্ষেই পিআর পদ্ধতি চায়। কিন্তু আমাদের দাবি শুধু উচ্চকক্ষে পিআরের পক্ষে। যুগপৎ আন্দোলনে না যাওয়া এটি অন্যতম একটি কারণ"।
তবে জামায়াত ইসলামী মনে করছে, ঠিক এই মুহূর্তে জামায়াতের সাথে আন্দোলনে না গেলেও পরবর্তীতে আবারও তারা অবস্থান বদলাতে পারে।
জামায়াতের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বিবিসি বাংলাকে বলেন, "আমাদের সাথে এনসিপির অনেক দাবিরই মিল রয়েছে। তবে আপাতত তারা কোনো কর্মসূচিতে যাচ্ছে না এটা তারা বলছে"।

নির্বাচনি সমঝোতায়ও আপত্তি
এই মুহূর্তে জামায়াতে ইসলামী তার মিত্র দলগুলোকে সাথে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনে নেমেছে। আর আগামী ফেব্রুয়ারিতে ভোটের আগে বিএনপিবিরোধী বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা রয়েছে জামায়াত ও ইসলামী দলগুলোর।
কিন্তু সেই জোটে কী থাকবে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দল এনসিপি? এই প্রশ্ন গত কয়েকদিন ধরে রাজনীতির মাঠে বেশ আলোচনায়।
গত কয়েকমাস জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের সাথে এক ধরনের সখ্যতা দেখে ধারণা করা হচ্ছিল জামায়াতের সাথে নির্বাচনি জোট করতে পারে এনসিপি।
তবে, এই মুহূর্তে নির্বাচনি জোটকেন্দ্রীক আলোচনা থেকে কিছুটা পেছনে সরে এসেছে এনসিপি। দলটি বলছে, বিএনপি কিংবা জামায়াত আপাতত কোন জোটেই যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়নি দলটি।
কারণ হিসেবে এনসিপির কয়েকজন নেতা জানিয়েছে, বর্তমানে নেতাদের একাংশ ধর্মভিত্তিক কোনো দলের সঙ্গে জোটে রাজি নন।
এনসিপির একজন সিনিয়র নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধ নির্বাচন করে এইবারই ক্ষমতায় যাওয়া যেতো তাহলে আমরা সেটা করতাম। জামায়াতের সাথে ভোট করে যদি বিরোধী দলই হই, তখন দীর্ঘমেয়াদে আমরা রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবো। এটা হলো আমাদের পলিসির জায়গা"।
গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপি যখন যাত্রা শুরু করে সেখানে যেমন ইসলামপন্থী বলয়ের ব্যক্তিরাও যুক্ত হয়েছিল। তেমনি যুক্ত হয়েছিল বাম ঘরানার তরুণদের অনেকেই। যে কারণে দলের বাম বলয়ের অংশটির জামায়াতের সাথে জোট গঠনের আপত্তিও রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান মনে করেন, "এনসিপি একটা নতুন দল। এখানে অনেক ব্লক থেকে তরুণরা এসেছে। তাদের ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। মতাদর্শগত জায়গা থেকে অনেকে হয়তো চাইছে না এখনই কোন জোটের সাথে একাত্ম হোক। সেখান থেকে হতে পারে এটা তাদের রাজনৈতিক অবস্থান কিংবা কৌশল"।

জামায়াত ইস্যুতে মতবিরোধ
সম্প্রতি ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফলাফলে এনসিপির সমমনা ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ বা বাগছাসের ফল বিপর্যয় হয়।
দুটি বিশ্ববিদ্যালয়েই সেই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় জামায়াত সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির।
ডাকসু ও জাকসুতে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের সংগঠনের এমন ভরাডুবির পর এ নিয়ে চরম হতাশা কাজ করছে এনসিপির শীর্ষ নেতৃত্বের।
ডাকসু ও জাকসুর ফলাফলের পরই শনিবার রাতে এক ফেসবুক স্টাটাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম লিখেছেন, "বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে আরেকটি 'ছায়া মওদুদীবাদী' দল প্রয়োজন নেই"।
যদিও তিনি ঠিক কোন দলকে উদ্দেশ্য করে এ বক্তব্য দিয়েছেন তা লেখেননি।
পোষ্টে তিনি আরো লিখেন, "ইতিমধ্যে অন্তত আধা ডজন এমন ছায়া দল রয়েছে দেশে। আপনারা বাড়তি কিছু যোগ করবেন না।"
অনেকেই ধারণা পোষণ করছেন, ডাকসু-জাকসুতে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের পরাজয়ে এনসিপি কিংবা ছাত্র উপদেষ্টাদের মধ্যেও এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়েছে।
এছাড়াও সংস্কার-নির্বাচনি জোট কিংবা দলের কিছু কিছু নেতাকর্মীদের মধ্যে এসব বিষয় নিয়ে নানা বিরোধও স্পষ্ট হচ্ছে।
এনসিপির একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র বিবিসি বাংলাকে বলেন, এনসিপির মধ্যে বাম বলয় ও ইসলামপন্থি অংশের মধ্যে সম্প্রতি বেশ কিছু ইস্যুতে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। এরমধ্যে একটি ইস্যু ছিল বিশ্ববিদ্যালগুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচন।
দলের মধ্যে বাম বলয়ের অংশটি এনসিপিকে জামায়াত ঘেঁষা অবস্থান থেকে সরে আসারও পরামর্শও দিচ্ছে।
তবে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বিবিসি বাংলাকে বলেন, "জামায়াতের সাথে এখন আমাদের দূরত্ব বা সখ্যতা কোনটিই নেই। শিগগিরই তাদের সাথে যুগপৎ আন্দোলনের সম্ভাবনাও নেই। আমরা আপাতত নিজস্ব রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়েই রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের পরিচিত করার চেষ্টা করবো"।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অবশ্য এটিকে একটি কৌশল হিসেবেই দেখছেন। বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, "এখন যেখানে যে মতাদর্শ, ব্যক্তিগত স্বার্থ, ইচ্ছা অনিচ্ছা চেয়ার বিভিন্ন কিছু নিয়ে মতভেদ তৈরি হবে। সেটা নিয়ে পার্টির রাজনীতি আলাদা কি না সেটা বোঝা যায় না। পার্টির রাজনীতি ভিন্নও হতে পারে"।